বিলুপ্তির পথে ২০ জাতের দেশি ধান

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:৩০ এএম

ধান ক্ষেতে ব্যস্ত কৃষক। ছবি: প্রতিনিধি

ধান ক্ষেতে ব্যস্ত কৃষক। ছবি: প্রতিনিধি

কৃষকের বীজের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। আউশ, আমন, বোরো সব মৌসুমেই সরকারি কোম্পানি ও বহুজাতিক কোম্পানির নতুন নতুন নামের বীজের ওপর নির্ভরশীল কৃষক। এখন কৃষকরাই ধানের নাম জানেন না। আগের বর্ণিল ধান এখন নেই।

লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে শুধু গেল পাঁচ বছরের ব্যবধানে মুড়ি, চিড়া, খই, পোলাও, বিরিয়ানি আর ফিরনি পায়েস তৈরির অন্তত ২০ জাতের বাহারি দেশি ধান পুরো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। লক্ষ্মীপুর জেলার স্থানীয় পর্যায়ের কৃষক, কৃষি ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

চর মনসা গ্রামের কৃষক মো. ইসমাইল জানান, আউশের মৌসুমে গ্রামের প্রায় কৃষক কমবেশি হলিধান চাষ করত। মিষ্টি চিড়া তৈরির জন্য বিখ্যাত হলিধানে কেউ চাল তৈরি করে ভাত খেত না। গত ৫ বছর থেকে পুরো বিলুপ্ত হয়ে গেছে মিষ্টি এ ধান।

সৈয়দ আহমেদ জানান, উপকূলীয় এ লক্ষ্মীপুর জেলায় খই তৈরির জন্য সুপরিচিত ছিল লোহাচূড়া নামের ধান। খুবই বড় বড় কালো রঙের এ ধান এখন আর নেই। ফলে এখন কেউ খই চেনে না। 

স্থানীয়ভাবে জানা যায়, মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত উপকূলীয় লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর সদর এবং রায়পুর উপজেলার বেশির ভাগ এলাকায় ধান চাষ হয়। ভাতের ধান ছাড়াও মুড়ির জন্য গিগজ ধান, ভূসিহারা, চিড়ার জন্য হলিধান, খইয়ের জন্য লোহাচূড়া এবং পোলাওর জন্য কালোজিরা আর শাক্কর খোরা ধানের চাষ হতো। এখন বৈচিত্র্যময় এসব ধানের চাষ হয় না। এসব ধানের বীজও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

জেলার তিনটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৪০-৫০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৫ বছর আগেও লক্ষ্মীপুর প্রচুর আউশ চাষ হতো। এখন কমে গেছে। আউশ আর আমনে অন্তত পঞ্চাশ জাতের দেশি ধান চাষ হতো। যার মধ্যে আমনে ছিল প্রায় ৩০-৪০ জাতের বাহারি নাম ও রঙের দেশি ধান। বাকিগুলো ছিল আউশ ধান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা সালেহ উদ্দিন পলাশ জানান, গত ৫ বছরের মধ্যে লক্ষ্মীপুর জেলায় আমন মৌসুমে মধুমালতি, কালারাজাশাইল, লোতড়, বাজাইলসাদা, রাজাশাইল, আগুনিশাইল, কাতিশাইল, কুটিয়া মনি, পক্কীরাজ, পাটজাত, লোহাচূড়া, ধলামোডা, নোনাহাইল নামের বৈচিত্র্যময় ১৩ জাতের দেশীয় অদৃশ্য হয়ে গেছে। এগুলোর বীজও এখন নেই।

বর্তমানে গিগজ, ভুষিহারা, কাজলশাইল, কালোজিরা, শাক্করখোরা নামের পাঁচটি দেশীয় জাত খুবই কম পরিমাণে চাষ করছে কৃষক। বর্তমানে আউশ মৌসুমে কালাহাঠিয়া নামের একটি ধান ছাড়া অন্য কোন দেশীয় ধান নেই। আউশ মৌসুমে গত পাঁচ বছরে বোলাইম, গয়াল, হলিধান, মাড়িছা, কেরোনডোল, কটকতারা, পানবিড়া নামের ৭ প্রজাতির ধান বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

ফয়েজ আহমেদ (৬৫)। অবসরপ্রাপ্ত লক্ষ্মীপুর জেলার এ কৃষি কর্মকর্তা জানান, দেশে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গিয়ে কৃষকরা লাভ আর চাপে পড়ে স্থানীয় জাতের ধান উৎপাদন ছাড়তে শুরু করে। ফলে দেশি অনেক জাতের ধান বিলুপ্ত হতে থাকে। এতে করে বৈচিত্র্যময় খাদ্য তৈরির ও বাহারি ধান হারিয়ে যায়।

দেশি ধানের জায়গা দখল করে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত বিআর এবং ব্রি ধান। উচ্চ ফলনশীল এ ধানগুলো বছর বছর সংখ্যা দিয়ে নতুন নতুন নাম নিয়ে ধান আনেন বিজ্ঞানীরা। আরও উৎপাদনের আশায় একসময় চলে আসে অত্যন্ত কৃত্রিম হাইব্রিড ধান। এখন হাইব্রিডের চাপে উচ্চ ফলনশীল বহু ধানও হারিয়ে গেছে। ফলে শুধু ভাত না, বরং বৈচিত্র্যময় খাদ্য তৈরির ধান হারিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. জাকির হোসেন জানান, লক্ষ্মীপুর জেলায়  প্রতিবছর গড়ে আমন ৮২ হাজার, আউশ ২৮ হাজার এবং বোরো ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয়। আমনে বর্তমানে ৩-৪টি, আউশে ২-৩টি জাতের দেশি ধানের চাষ হয়। আবার শতকরা হারে আমন, আউশ, বোরো ধানের প্রায় ৬০ ভাগের মতো উফশী, ৩০ ভাগের মতো হাইব্রিড এবং ১০ ভাগের মতো দেশি ধান চাষ হয় বলে জানান ওই কর্মকর্তা। তিনি জানান, আমন, আউশে অনেকগুলো উফশী জাত থাকলেও মাত্র ৪-৫টি ধানই বেশি চাষ হয়।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানটি ১০৬টি উচ্চ ফলনশীল ধান উদ্ভাবন করে। যার মধ্যে আউশ ২৩টি, হাইব্রিড ৭টি, আমন ৪৬টি এবং বাকি জাতগুলো বোরো ধান। একই সময়ে বাংলাদেশ ইনস্টিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার (বিনা) ৩০টি জাতের ধান উদ্ভাবন করেছিল। পূর্বে দেশি জাতের বিচিত্র ধানকে হটিয়ে গবেষণাগারে উদ্ভাবিত ধানগুলো কৃষকের ক্ষেতে স্থান পায়। তবে ধান উৎপাদনের এলাকা লক্ষ্মীপুরে এখন প্রতি মৌসুমে ৩-৪টি ধানই চাষ হয়। 

বাংলাদেশ জাতীয় বীজ বোর্ডের সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিকে ১৭০টি হাইব্রিড জাতের ধান আমদানির অনুমতি দেওয়া হয় বীজ বোর্ডকে। যার মধ্যে আমন ধান ১৮টি এবং বোরো ধান ১৫২টি।

কৃষক এবং কৃষি পণ্য ব্যবসায়ীরা জানায়, সবার শেষে হাইব্রিড আসলেও বোরো ধান হাইব্রিডের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। এখন আমন মৌসুমেও ব্যাপক পরিমাণ হাইব্রিড ধান চাষ করছে কৃষক। ফলে কৃষকের দেশি ধান বিলুপ্ত হওয়ার পর উফশী জাতগুলো হুমকিতে। ফলে কৃষকরা এখন ধান চিনে রাখতে পারছেন না আবার বীজও সংরক্ষণ করতে পারছে না।

পরিবেশ ও কৃষি বিষয়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবুজ বাংলাদেশের গ্রিনল্যান্ড প্রকল্পের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান জানান, দেশি ধানের বিলুপ্তির পর এখন হাইব্রিড ধানের চাপে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় আবিষ্কৃত উচ্চফলনশীল অনেক ধানও হারিয়ে যাচ্ছে। এখন কৃষকের হাতে কৃষকের বীজ নেই। তাই বিপর্যয় ঠেকাতে দেশি ধানের জন্য জেলা ভিত্তিক জিনব্যাংক স্থাপন জরুরি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh