রেহমান রাহী: ‘কাশ্মীরীয়তের’ পুরোহিত

ধ্রুব সাদিক

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:৫২ পিএম

রেহমান রাহী। ছবি: সংগৃহীত

রেহমান রাহী। ছবি: সংগৃহীত

‘বেঁচে থাকার জন্য মানুষ মরে যায়। তুমি কি মরবে না?’ জীবনের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলি এবং এর ঝুলন্ত সান্ত্বনাগুলি অনুসরণে বিশ্বাসী এবং অভিনব উপায়ে রূপক ব্যবহার করে কাশ্মীরি ঐতিহ্য তুলে ধরা রাহী নিজের অমরত্ব এভাবেই প্রকাশ করেছেন। জীবনের গভীর প্রশ্নগুলোর সাথে গুরুতরভাবে জড়িত থাকা কবি জীবনকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করা নয়, জীবনকে তীব্রভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুভব করেছেন, তাঁর কল্পনায় পুনরুজ্জীবিত করেছেন।

ভারতে প্রচলিত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ইন্দো-ইরানীয় শাখার দার্দীয় দলের একটি ভাষা কাশ্মীরি। প্রায় ৭১ লক্ষ লোক কথা বলেন ভাষাটিতে- রেহমান রাহী এই ভাষারই একজন সাহিত্যিক। কবিতা এবং গদ্যের বহুমুখী বিষয় নিয়ে তিনি কাজ করেছেন।

কাশ্মীরের সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে নিজেকে শক্তিশালী সাহিত্যিক হিসেবে অধিষ্ঠিত করা রাহী- কাশ্মীরি ভাষাকেও ভারতে বিদ্যমান ভাষাগুলির সারিতে উচ্চতর স্থানে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বেরও দাবিদার। তাঁর শব্দভাণ্ডার, বহু-সাংস্কৃতিক ইঙ্গিত এবং অর্থ ও চিন্তার সান্দ্রতা ভারতীয় উপমহাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক হিসেবেও তাকে অধিষ্ঠিত করেছে।

রেহমান রাহী। ‘কাশ্মীরীয়তের’ একজন প্রকৃত কবি বলে সমধিক বিবেচিত। দুই দশকের সহিংসতার সময় শান্তি ও ভালোবাসার ভূমিটির কষ্ট ও যন্ত্রণাকে সাহসের সাথে তাঁর সাহিত্যকর্মে শুধু তুলে ধরেছেন তাই নয়, হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সমানভাবে আদৃত।

ছোটবেলা থেকে কবিতার প্রতি আকৃষ্ট কবি মূলত প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের প্রভাবে কবিতা লিখতে শুরু করেন। তাঁর প্রথমদিকের কবিতাগুলোতে রোমান্টিকতার পাশাপাশি প্রগতিশীল আদর্শ দারুণভাবে প্রতীয়মান। রোমান্টিক আকাঙ্ক্ষা আর প্রগতিশীল আদর্শ এই মিশ্রণের ছাপ তাঁর কবিতাগ্রন্থ নওরোজ-ই সাবা দারুণভাবে বহনও করে।

তবে একটি নিখুঁত বিশ্বের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী কবি প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রভাবে লেখা অন্যান্য কবির মতো শিল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে ছিলেন অল্প বয়স থেকেই সচেতন। তাঁর প্রথমদিকের কবিতায় এটি বেশ দৃশ্যমানও। এই বিষয়টি কেবল একজন কবি হিসাবে রাহীর বিবর্তনকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করে না বরং শিল্পের সাধনার সাথে তাঁর চিরন্তন প্রবৃত্তিকে বুঝতেও সাহায্য করে।

একজন ইংরেজ কবি আছেন। শেলি নাম। অল্প বয়েসে মারা গেছেন। কবিতা-মহুয়ায় মাতাল কবি বলেছেন, একজন কবি কোকিলের মতো, যে কিনা একাকিত্বের অন্ধকার কোণে নিজেকে আনন্দিত করতে মিষ্টি সুরে গান গায়।

বিশুদ্ধ শিল্পের প্রতি রাহীর আবেগ তেমনই, এর সাথে রোমান্টিকতার সংমিশ্রণ তাঁর শায়ের (দি পোয়েট), হুসনে লাজাওয়াল (দি ইমমরটাল বিউটি) এবং সর্বোপরি ফান বড়ায়ে ফানসহ (আর্ট ফর আর্ট’স সেইক) অনেক সাহিত্যকর্মে দৃশ্যমান। তবে আত্ম-আবিষ্কারের দিকে যাত্রা এবং কাশ্মীরের সভ্যতার সাথে সাংস্কৃতিক সখ্যের দিকটিরও প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কবিতায়। কাশ্মীরকে স্থানিক নয়, কাল্পনিক হিসেবে দেখেন তিনি। ঘৃণাই করতেন কবি কাশ্মীরের সাংস্কৃতিক বাগধারা হারানোকে।

সেজন্য মৃতপ্রায় সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, শব্দ এবং বাগধারাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করতে নিজেকে নিযুক্ত বলে মনে করতেন। ফলত সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিগুলোকে কাশ্মীরের অতীতের জানালা হিসাবে হামেশা ব্যবহারও করেছেন।

যদিও একসময় কবি বাগধারা ধার করতেন; কিন্তু পরিপক্ব হওয়ার সাথে সাথে ধার করা বাগধারার প্রয়োগ বন্ধ করে নিজের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাশ্মীরি কবিতার নিজস্ব বাগধারা প্রবর্তন করার সাধনা শুরু করেন। ফলে কাশ্মীরের সাংস্কৃতিক গঠনের ঐতিহ্যগত পরিবর্তন হয়েছে।

শব্দচয়নের মধ্যে প্রতিফলিত তাঁর বহুসংস্কৃতির চেতনার জন্যও তিনি পরিচিত। গ্রিক, রোমান থেকে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক সম্পর্কে তাঁর পাঠের বিস্তৃতি এবং সচেতনতা তাকে একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে। কবিতায় নিপুণভাবে এইসব বিষয় ও বস্তু একীভূতও করেছেন তিনি।

মূলত কবিতাগ্রন্থ শিয়াহ রুদ জারেন মান বা ইন ব্লাক ড্রিজল-ই রাহীকে কবি হিসেবে সমধিক প্রতিষ্ঠিত করেছে। গ্রন্থটি তাঁর কল্পনাপ্রসূত ক্যানভাস এবং সর্বজনীন থিম এবং সাধারণভাবে মানুষের অবস্থার প্রতি তাঁর স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি চিত্রিত করে। কবির চিত্রায়ণ, ‘হে কাশ্মীরি ভাষা!/ তোমার নামে শপথ করছি/ তুমি আমার সচেতনতা,/ আমার দৃষ্টি আর আমার উপলব্ধির দীপ্তিময় রশ্মি/ আমার বিবেকের ঘূর্ণায়মান বেহালা তুমি।’

অধ্যাপক জিআর মালিক গ্রন্থটি সম্পর্কে বলেছেন, এই চাবিটি দিয়ে আমাদের তাঁর কবিতা ভাণ্ডারের তালা খুলতে হবে। এছাড়া বাশির মানজার নামে একজন কবি এবং শ্রীনগর থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক রেহমান রাহী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তিনি কাশ্মীরি ভাষাকে ফার্সি ও উর্দুর প্রভাব থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাঁর প্রতিটি লিখিত এবং কথ্য শব্দের মাধ্যমে তিনি কাশ্মীরি সংস্কৃতির অপরিহার্য অন্তর্ভুক্তি কাশ্মীরীয়তকে সামনে আনার চেষ্টা করেছেন।’

‘বেঁচে থাকার জন্য মানুষ মরে যায়। তুমি কি মরবে না?’ জীবনের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলি এবং এর ঝুলন্ত সান্ত্বনাগুলি অনুসরণে বিশ্বাসী এবং অভিনব উপায়ে রূপক ব্যবহার করে কাশ্মীরি ঐতিহ্য তুলে ধরা রাহী নিজের অমরত্ব এভাবেই প্রকাশ করেছেন। জীবনের গভীর প্রশ্নগুলোর সাথে গুরুতরভাবে জড়িত থাকা কবি জীবনকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করা নয়, জীবনকে তীব্রভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুভব করেছেন, তাঁর কল্পনায় পুনরুজ্জীবিত করেছেন এবং তারপর রূপকায়ন করেছেন।

তাঁর কবিতায় বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসেবে গজলের বিপরীতে নাজমে যা করেছেন তা হলো প্রথাগত মেট্রিকাল প্যাটার্নের বদলে আবেগ ও আবেগের সূ²তা প্রকাশের জন্য পরিভাষাসহ নির্ভুল এবং স্বতঃস্ফূর্ত নিজস্ব প্যাটার্ন সৃষ্টি করা। এছাড়া ‘তখলীক’ নামের কবিতায় প্রেমের ধারণাকে আমূল পরিবর্তন করেছেন।

জাবারওয়ান বালে থাঙ্গি কবিতাটি আবার কবির এমনই একটি কবিতা যেখানে আধুনিক সময়ে এর পৌরাণিক, ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক গুরুত্ব পুনর্বিবেচনা করে তিনি জাবারওয়ান শিখরকে নাটকীয়ভাবে সম্বোধন করেছেন। ফলে কাশ্মীরের পুরাকীর্তি চরিত্র, এর পৌরাণিক উপাখ্যান এবং সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলো কবির কবিতায় রেফারেন্স হিসাবে রয়ে গেছে।

এছাড়া রাহীর কবিতায় সমসাময়িক সংবেদনশীলতাও সমানভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। জীবনের ট্র্যাজিক অনুভূতি, এর দুর্বলতা, চেতনার উচ্চস্তরের কারণে সমসাময়িক সময়ে অনুভব করা বিভক্তির অনুভ‚তি সম্পর্কে সচেতনতা, ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং ভালোবাসার মতো মৌলিক মানবিক আবেগের পরিবর্তিত অর্থও তাঁর কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে। কা’রি দারইয়া সালসাবিল, সাদা, আওলুন প্রভৃতি এমন কিছু কবিতা যা কাশ্মীরিদের কল্পনা, ভাব ও বাণী এবং কাশ্মীরি নান্দনিক জগতের সম্পূর্ণ অভিনব অভিজ্ঞতার প্রতিবিম্বন।

‘আর কত কান্না আমার মরুভূমিতে মিশে যাবে?/কত কাল আর এই আকাশ আমার অচেনা থাকবে।’ একজন প্রকৃত সাহিত্যিক তো তিনি যিনি তাঁর নিজভূম, নিজ অঞ্চলের মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। পদকে ভূষিত হওয়ার কালে প্রধানমন্ত্রীর সামনে বলতে পারেন আমার লোকেরা দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। রেহমান রাহীর এই উচ্চারণটি ভাবনায় কাজ করলে পরিতাপও কাজ করে।

কেননা বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা কিনা প্রকাশ্যে উচ্চস্বরে বলে সাহিত্যিকের কোনো দায় নেই! কাশ্মীরের সাংস্কৃতিক ল্যান্ডস্কেপের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতে দারুণভাবে নিমগ্ন রেহমান রাহী ৮৩ বছর বয়সে জ্ঞানপীঠ সম্মাননায় ভূষিত হয়ে বলেছিলেন, ‘পুরস্কারটি শুধু আমার কবিতার জন্যই একটি সম্মান নয়, ভাষার স্বীকৃতির জন্যও। আমি একইসাথে খুশি এবং দুঃখিত। খুশি, কারণ আমি সম্মানিত হলাম। দুঃখজনক, কারণ আমার লোকেরা দুর্দশার মধ্যে রয়েছে।’

কবিতার পাশাপাশি রাহী একজন সমালোচক ও প্রাবন্ধিকও ছিলেন। তিনি তাঁর অনবদ্য শৈলীর মাধ্যমে কাশ্মীরি গদ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং তার সমালোচনামূলক লেখাগুলোও যথেষ্ট গুরুত্ববহ। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংকলন ‘কাহওয়েত’ কাশ্মীরিভাষা ও সাহিত্যের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন হিসাবে সমধিক স্বীকৃত।

গ্রন্থটি ধ্রুপদী এবং আধুনিক কাশ্মীরি কবিতার অনাবিষ্কৃত মাত্রা, পরিবর্তিত সময়ে সৃজনশীল সাহিত্যের উপর আলোকপাত করে লেখা। তাঁর আরেকটি গ্রন্থ ‘শর শাইনসি’ কাশ্মীরের রহস্যবাদী নীতির উপর একটি অগ্রণী কাজ। কাশ্মীরের সুফি এবং মরমি কবিতার মানবতাবাদী শিকড় এবং এখনও কেন প্রাসঙ্গিক।

জম্মু ও কাশ্মীর থেকে একমাত্র জ্ঞানপীঠ পুরস্কার বিজয়ী রেহমান রাহী। রেহমান রাহীর আসল নাম আব্দুর রেহমান মীর। ১৯২৫ সালে  শ্রীনগরে জন্মগ্রহণ করেন কবি। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে ফার্সি এবং এরপর ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাঠ নেওয়ার পর একটি কলেজে কয়েক বছর অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন।

কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল ফার্সি বিভাগে অধ্যাপনা করে ১৯৭৭ সালে নব্য প্রতিষ্ঠিত কাশ্মীরি বিভাগে যোগদান করেন। অবসর গ্রহণ পর্যন্ত এখানেই তিনি অধ্যাপনা করেন।

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কাশ্মীরে সাংস্কৃতিক মৌলিক বিষয়গুলো প্রবাহিত হলে এর নান্দনিক এবং সাংস্কৃতিক আবশ্যিকতায় কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করেছিল। এমন পরিস্থিতিতে প্রগতিশীল লেখকদের আন্দোলন কাশ্মীরি পরিচয়, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে ভাঙনের হাত থেকে বাঁচাতে সাহায্য করেছিল।

রেহমান রাহী ছিলেন এই আন্দোলনেরও একজন পুরোহিত। সম্প্রতি কাশ্মীরি ভাষার এই শক্তিশালী কবি অলোকলোকে বাস নিলেন। তাঁর অলোকলোকে বাস নেওয়ার মধ্য দিয়ে কাশ্মীরি ভাষা ও সাহিত্যে শুধু বিশাল এক শূন্যতারই সৃষ্টি হলো না, এক মহীরুহ প্রাণই।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh