মজুরি চুরির শিকার প্রবাসী শ্রমিকরা

প্রতীক সিফাত

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:৫৫ এএম

শ্রমিকের ইচ্ছাকে মূল্য না দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে অতিরিক্ত কাজ করানো হয়। ছবি: সংগৃহীত

শ্রমিকের ইচ্ছাকে মূল্য না দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে অতিরিক্ত কাজ করানো হয়। ছবি: সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে করোনাকালে অভিবাসী শ্রমিকদের অনেকেই বেতন না পেয়ে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। কারও ভাগ্যে জুটেছে অর্ধেক মজুরি। চিকিৎসাসেবা, আবাসন সুবিধা, খাবারসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অনেকে। নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন কেউ কেউ। যে বেতন বা সুবিধার কথা বলে নেওয়া হয়েছিল, সে চুক্তি লঙ্ঘন করে কিছুই না দেওয়ার ঘটনাও কম নয়।

শুধু করোনাকালের নয়; এটি বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটা কাঠামোগত সমস্যা। এ কারণে অভিবাসী অধিকারকর্মীরা অভিবাসী শ্রমিকদের এভাবে প্রতারিত ও বঞ্চিত হওয়ার ঘটনাকে ‘কাঠামোগত মজুরি চুরি’ হিসেবে অভিহিত করছেন।

ঢাকার কেরানীগঞ্জের ওমর আলী একজন দক্ষ কাঠমিস্ত্রি। লেবাননের একটি আসবাবের দোকানে কাজ করতে গিয়েছিলেন। ৪৫ হাজার টাকা বেতনের কথা বলে নেওয়া হলেও তাকে দেওয়া হতো অর্ধেকেরও কম, মাত্র ২৭ হাজার টাকা। চুক্তির সময় খাওয়া ও চিকিৎসার খরচ মালিকপক্ষের বহন করার কথা থাকলেও তা পাননি।

একই এলাকার রানু বেগম। ভাগ্য ফেরাতে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে গিয়েছিলেন সৌদি আরব। মাসে তাকে এক হাজার রিয়াল দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পেয়েছেন ৬০০ রিয়াল করে। তাও চার বছরের মধ্যে দেড় বছর তিনি কোনো বেতনই পাননি। আরবি লিখতে পারতেন না বলে আঙুলের টিপ নিত মালিক। 

এরপর বলত, বেতন হয়ে গেছে। এমনকি তাকে পর্যাপ্ত খেতে দেওয়া হতো না। ছিল না কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা। পর্যাপ্ত বিশ্রামের সময় পেতেন না। রাত ৩টায় ঘুমিয়ে ভোর ৫টায়ও উঠতে হয়েছে অনেক সময়। কিছু বললেই মারধর করত। ফিরে আসার সময় এক টাকাও দেওয়া হয়নি। কুমিল্লার মিজানুর রহমান দুবাইতে কাজ করেছেন ১১ বছর। চাকরির মেয়াদ শেষে প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা, ইনস্যুরেন্স কিংবা ব্যাংক গ্যারান্টির টাকা নিয়ে ফিরতে পারেননি।

বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। কাঠামোগত মজুরি চুরির বিষয়ে সংস্থাটি বলছে, যেসব শর্তে শ্রমিকদের বিদেশে কাজ করতে নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো না মেনে নানাভাবে বঞ্চিত করা হয়। যেমন তাদের যে চাকরির কথা বলে নেওয়া হয়, অনেক সময় তা না দিয়ে অন্য কাজ করানো হয়।

আবার যে বেতনের কথা বলা হয়, তাও দেওয়া হচ্ছে না। মোটামুটিভাবে মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এটাই বাস্তবতা। কাঠামোগতভাবেই এটা হচ্ছে। শ্রমগ্রহীতা দেশে শ্রম আইন আছে; কিন্তু তার সুবিধা অভিবাসী শ্রমিকরা পাচ্ছেন না নানা কারণে। নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পুরো ব্যবস্থায় এ সমস্যা থাকায় পরিত্রাণেরও কোনো উপায় নেই। মজুরি চুরির ঘটনা শুধু কয়েকটি সূচকে সীমাবদ্ধ নয়।

বীমা, চিকিৎসা পরীক্ষা, পরিবহন খরচ, দক্ষতা প্রশিক্ষণের অজুহাতেও শ্রমিকের মজুরি কাটা যেন সাধারণ বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের উচ্চমজুরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে নিয়ে চুক্তিপত্রের দ্বিতীয় সেটে স্বাক্ষর করতে বলা হয়। বেশিরভাগ শ্রমিকই এসব চুক্তির ভাষা বুঝতে পারেন না। নতুন সেই চুক্তি শ্রমিকদের আগের চুক্তির চেয়ে কম বেতন দেওয়াকে বৈধতা দেয়। শ্রমিকদের জরিমানা আরোপের আড়ালেও মজুরি কর্তন সাধারণ ব্যাপার।

আর এসবই কাঠামোগত মজুরি চুরির অংশ। দেশের রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালাল থেকে শুরু করে বিদেশের নিয়োগ কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত নানান কৌশলের মাধ্যমে রীতিমতো কাঠামোগতভাবে শ্রমিকদের বঞ্চিত করছে। এসব কারণে অভিবাসী শ্রমিকরা মৃত্যুর পরও তাদের মজুরি ও প্রাপ্য অধিকার কেড়ে নেওয়া থেকে রেহাই পান না।

এ বিষয়ে মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ও রামরুর নির্বাহী পরিচালক সিআর আবরার বলেন, ‘অভিবাসী শ্রমিকদের অনেকেই করোনাকালে বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। শ্রমিকের ইচ্ছাকে মূল্য না দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে অতিরিক্ত কাজ করানো হয়। এর জন্য বাড়তি পারিশ্রমিকও দেওয়া হয়নি। নারী গৃহকর্মীকে চুক্তির বাইরে কাজ করানো হয় একাধিক গৃহে।

চাকরির শর্ত অনুযায়ী বছরে তাদের যে ছুটি পাওয়ার কথা, তা দেওয়া হয় না। আলোচনা ছাড়াই বেতন কমানো, চুক্তি শেষে বকেয়া পরিশোধ না করা, এমনকি আটকে রাখার মতো ঘটনাও ঘটছে। এ ধরনের অন্যায্য আচরণ উপসাগরীয় ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের শ্রমিক নিয়োগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। নানাভাবেই চুরি করা হচ্ছে শ্রমিকের মজুরি। এর মধ্যে কাঠামোগত মজুরি চুরিও হচ্ছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এ অধ্যাপক আরও বলেন, “স্বাভাবিক মৃত্যুর দাবিগুলো প্রায়ই সত্য থেকে দূরে থাকে। ‘স্বাভাবিক’ শব্দটির ব্যবহার নিয়োগ কর্তাদের কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও অন্যান্য দায়িত্বের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া থেকে দায়মুক্তি দেয়। সেই সঙ্গে মৃত অভিবাসীদের পরিবারের দাবি ও অভিযোগ দায়ের করার সুযোগ খুব কম থাকে। এ ধরনের অভিযোগ দায়ের করতে যে বিশাল আইনি খরচ রয়েছে, সেটি তাদের ঢাল হিসেবে কাজ করে। ক্ষতিপূরণের ওপর কর আরোপ করা শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের জন্য মজুরি চুরির আরেকটি রূপ।”

মজুরি চুরির বিষয়ে মাইগ্রেন্ট ফোরাম ইন এশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জুলাই ২০২০ থেকে ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনটি থেকে দেখা যায়, অভিযোগকারী বাংলাদেশের এক অভিবাসী শ্রমিকের কাছ থেকে গড়ে ১ হাজার ৭৭৫ ডলার বা ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা মজুরি চুরি হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল ও ফিলিপাইনের দুই হাজার অভিবাসী শ্রমিকের কাছ থেকে ১৯ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মজুরি চুরির তথ্য দেওয়া হয়।

তবে এটি অভিবাসীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ, যারা মজুরি চুরির শিকার। বেশিরভাগ প্রবাসী প্রতিকার পেতে অক্ষম হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই রিপোর্ট করা হয়নি। এই বিপুল পরিমাণ মজুরি চুরির ফলে শুধু যে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ও তার পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, দেশের অর্থনীতিও মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা মানবাধিকারকর্মী সুলতানা ওহাব বলেন, ‘যতগুলো নীতিমালা হয়েছে, সেগুলোর কার্যক্রম নেই। আইন হলেও প্রয়োগ নেই। তাই অভিবাসীদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। এজেন্সিগুলোকে ধরতে গেলে দেখা যায়, তারা রাজনৈতিক বড় কোনো শক্তির সঙ্গে যুক্ত। এসব এজেন্সির অনেক এজেন্ট বিভিন্ন দেশে আছে। ওই সব দেশে যখন কোনো শ্রমিক অভিযোগ করেন তখন তাদের ধরে এনে নির্যাতন করা হয়। এসব অনিয়ম বন্ধে আইনগুলো প্রতিষ্ঠিত হোক, মনিটরিং হোক।’

এদিকে বিমানবন্দরগুলোর দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০০৮ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দেশে ৪৫ হাজার ৩০১ প্রবাসীর মরদেহ এসেছে। এর মধ্যে ২৭ হাজার ২৩১ জনের মরদেহ এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ থেকে। আর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০টি মরদেহ আসে।

মৃত শ্রমিকদের একটা বড় অংশই মধ্যবয়সী কিংবা তরুণ। সঙ্গে আসা নথিপত্র অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি প্রবাসী মারা যান মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা ব্রেইন স্ট্রোকে। এছাড়া হৃদরোগসহ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা কিংবা প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘অভিবাসী শ্রমিকদের ভয়াবহ নির্যাতনের কথা আমরা শুনতে পাই। এখনো প্রতিদিন গড়ে বিদেশ থেকে ৮-১০টি মরদেহ আসে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, তার একটিরও ময়নাতদন্ত হয় না। কীভাবে এসব শ্রমিক মারা যাচ্ছেন, তা আমাদের জানতে হবে। নেপাল ও ফিলিপাইন গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকেও গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করা উচিত। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা নির্যাতনের শিকার হন।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির বড় শক্তি। কিন্তু এর পেছনের যোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা কতটুকু আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি, তা নিয়ে ভাবতে হবে। রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারি একটি ফি থাকলেও এজেন্সিগুলো কয়েকগুণ বেশি টাকা নিচ্ছে। তবে নিয়োগকারী এজেন্সিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে ২০১৩ সালে একটি আইন হয়েছিল। সেটা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।’ 

অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি যে আলোচনা জাতীয়ভাবে হয়, সেটা হচ্ছে তাদের অর্থনৈতিক ভূমিকা। কিন্তু শ্রমিকদের স্বার্থ সবসময় আড়ালেই থেকে যায়। অথচ তাদের চার স্তরে কষ্ট পেতে হয়। প্রথমত বিদেশে যেতে হলে দেড় লাখের জায়গায় ৪-৫ লাখ টাকা দিতে হয়। দ্বিতীয়ত চুক্তি অনুযায়ী বেতন দেওয়া হয় না। তাদের মজুরি চুরি করা হয়।

তৃতীয়ত শ্রমিকদের কর্মঘণ্টার ক্ষেত্রেও চুক্তি মানা হয় না। এক ধরনের মজুরি দাসত্বের মাধ্যমে তাদের কাটাতে হয়। আর সর্বশেষ এসব সমস্যার প্রতিকারে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। এ সমস্যাগুলো যতদিন না সমাধান হবে ততদিন প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণ হবে না।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh