ডলার সংকটের কিনারা কোথায়

এমএইচ রশিদ

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:১৪ এএম

ডলারের চাহিদা ব্যাপকহারে বাড়ার কারণে দাম বাড়েছে বিশ্ববাজারে। ছবি: সংগৃহীত

ডলারের চাহিদা ব্যাপকহারে বাড়ার কারণে দাম বাড়েছে বিশ্ববাজারে। ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন মুল্লুকের মুদ্রা ডলারের তেজে নাজেহাল বাংলাদেশের পণ্যবাজার। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ডলার আয় কমে যাওয়ার পর চাহিদা বেড়ে এর দাম বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ। এই ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, আমদানি পণ্য, শিল্পের কাঁচামালসহ সবকিছুরই দাম বেড়েছে। নিত্যপণ্য কিনতেও হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। 

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ডলারের সংকট সমাধান কবে? বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও খুব শিগগির ডলার সংকট কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের এই সংকট তৈরি হয়েছে কাঠামোগত সমস্যার কারণে। এই সমস্যার কারণে অর্থপাচার, হুন্ডি, আন্ডার ইনভয়েসিং-ওভার ইনভয়েসিং বাড়ছে। এই সমস্যার সমাধান না হলে ডলারের সংকট কাটবে না, বাজারে সাধারণ মানুষের স্বস্তিও মিলবে না। 

করোনা ভাইরাসের তীব্রতা কিছুটা কমার পর থেকেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এরপর থেকেই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় ক্রমশ কমছে। অন্যদিকে বিদেশের বাজারের পণ্যের দাম অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি ব্যয় ব্যাপকহারে বেড়েছে। অনেক পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ, নানা শর্তারোপ করে ব্যয় কিছুটা কমানো গেলেও সংকট কাটেনি।

দেশের রিজার্ভ খরচ করে আমদানি ব্যয় মেটানো হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৮ জানুয়ারির হিসাবে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলার। এক বছর আগে এই রিজার্ভ ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলার। মাত্র এক বছরেই রিজার্ভ কমেছে ১০ বিলিয়ন ডলার। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে এটি বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ নয়। বাংলাদেশ নিট রিজার্ভ হতে পারে ২৩/২৪ বিলিয়ন ডলারের।

রিজার্ভের পরিমাণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার জানান, বাংলাদেশে এখন গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে যা থাকবে, সেটাই নেট রিজার্ভ। সেই হিসাবে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। 

এদিকে ডলারের চাহিদা ব্যাপকহারে বাড়ার কারণে দামও বেড়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার লেনদেন হচ্ছে ১০৭ টাকায়। এক বছরে আগেও প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। ডলারের এই সংকট তৈরির মূল কারণ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ডলারের আয় কমেছে অন্যদিকে ব্যয় বেড়েছে। আয় কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসা এবং পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে দাম কম-বেশি দেখিয়ে অর্থপাচার। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের চাহিদাও কমেছে। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, সরকার আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে ডলার সংকট মোকাবিলা করতে চাইলেও হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। সামনে আরও মেলানো যাবে না।

কারণ বিভিন্ন ধরনের মেগাপ্রকল্প চলছে। তার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানিতে ডলার প্রয়োজন। এগুলো অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পেলে কিছুটা স্বস্তি হয়তো আসবে। কিন্তু সমাধান হবে না। সমাধান করতে হলে রপ্তানির ক্ষেত্রে রূপান্তর দরকার। নতুন নতুন পণ্য দরকার। মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ দরকার।

তিনি আরও বলেন, এই সংকট কোনো মৌসুমি বিষয় না। এটা কাঠামোগত বিষয়। তিন মাস আগে সেপ্টেম্বরে বলেছিল, নভেম্বরে কমে যাবে। অক্টোবরে এসে বলেছে, ডিসেম্বর নাগাদ কেটে যাবে। এখন নভেম্বরে বলছে, জানুয়ারি নাগাদ কেটে যাবে। এ ধরনের আশাবাদের কোনো ভিত্তি নেই। একটি বিষয় হলো বাংলাদেশ যে ডলার আয় করছে সেটা, আরেকটি যেটা ব্যয়ের পর যে আমদানি করছে।

আয়ের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, নেট রপ্তানি পড়ে গেছে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স আয়ও ওঠানামা করছে। ডলার ও টাকার বিনিময় হার একাধিক হওয়ায় এবং টাকা-ডলারের বিনিময় হার বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় অবধারিতভাবে হুন্ডি বাড়ছে। এতে সরকারের কোষাগারে সেভাবে অর্থ না আসায় জাতীয় মুদ্রাকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দিয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় বৈদেশিক হিসাবের ঘাটতি অর্থনীতির স্থিতিশীলতা যেন নষ্ট না করে দেয়, সে জন্য কাজ করতে হবে। 

ডলার সংকট তৈরি হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে অর্থপাচার। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, কানাডা, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়ায় বাড়ি কেনার শীর্ষে বাংলাদেশিরা। এছাড়া সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে টাকা জমানোর শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। বৈধভাবে যেহেতু টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই, তাই পাচারের মাধ্যমেই এই টাকা নেওয়া হয়েছে।

আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে ব্যাংকের মাধ্যমেই অধিকাংশ অর্থপাচার হয়েছে। সরকারি প্রকল্পে ঘুষ, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ঘুষ ও অবৈধ কমিশন, ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা পাচার করা হয়েছে বিদেশে। আরেকটি হচ্ছে রেমিট্যান্সের অর্থ হুন্ডি হওয়ায় কোনো বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা আমাদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা একটা আত্মপ্রসাদে ভুগছিলাম ফরেন রিজার্ভ অনেক আছে, কোনো অসুবিধা নেই। এই ভাবনা আমাদের পেয়ে বসেছিল।

অর্থপাচার কিংবা বৈদেশিক মুদ্রাপাচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে তথ্য দিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু মূল অ্যাকশন নিতে হবে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে। সর্বোপরি বাইরে অর্থপাচারের ব্যাপারে যাদের নাম শোনা গেছে, তাদের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

ভবিষ্যতে যেন এসব না হয়, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বিশেষ করে দুদক- সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। না হলে অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করা কঠিন হবে।


এদিকে সংকট কাটানোর জন্য একটি রূপরেখা তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই রূপরেখা অনেকটাই অনুমান নির্ভর। অনেকগুলো ‘যদি’ একসঙ্গে সত্য হলে এই বছরের মধ্যেই ডলারের সংকট কেটে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমান, উন্নয়ন অংশীদারদের সহায়তার কারণে চলতি আর্থিক বছরের শেষের দিকে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ওপর চাপ কমবে।

চলতি অর্থবছরের শেষে পরিশোধ ঘাটতির ভারসাম্য হবে ১৫০ মিলিয়ন ডলার, যা গত জুনের শেষে ছিল ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরে বাজেট ও নিয়মিত সহায়তা এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে রেকর্ড ১৬ বিলিয়ন ডলার আসবে। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। ওই তিন খাত থেকে এ পরিমাণ অর্থ আসলে জুনের শেষে ঘাটতি কমে ১৫০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে।

এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি ৫৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে, যা আগের বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। যদিও ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে। আমদানি ৮২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে চলতি অর্থবছরে ৯১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রথমবারের মতো ২৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমান। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১০ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া আইএমএফের ঋণ পাওয়া গেলেও অনেকটা স্বস্তি আসবে। 

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সংকট সমাধানের যেসব অনুমানের কথা বলা হচ্ছে, সেটা খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এখানে বেশ কিছু ঝুঁকি আছে। চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে কি না, তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে।

আর গত অর্থবছরের ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের সামগ্রিক ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি মাত্র ১৫০ মিলিয়ন ডলারে কমিয়ে আনার আশা উচ্চাকাঙ্ক্ষী। যদি এসব অনুমানের ওপর ভিত্তি করে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে সামনে বিপদ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই বিপদ সামলানো কঠিন হবে। তাই ডলারের যে সংকট চলছে, এটা সহজে মিটবে তা মনে হয় না। ২০২৩ সাল জুড়েও ডলার সংকট থাকতে পারে। এটা সহজে দূর হবে না।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh