জিয়াউদ্দীন আহমেদ
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:৩৫ এএম
জিয়াউদ্দীন আহমেদ। ফাইল ছবি
মহামারি করোনার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হওয়ার পথে দ্রুত এগোচ্ছিল, কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তা এখন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে, প্রবৃদ্ধিও মন্থর হয়ে পড়েছে।
বিশ্বের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চেপে ধরেছে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমবেশি সব দেশেই ভোক্তাদের উপর পড়েছে। জ্বালানি তেল-গ্যাসের চড়া দাম প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনীতিকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে।
২০২১ সালের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেলে দেশে দেশে জিনিসপত্রের মূল্যও হু-হু করে বেড়ে গেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা আসায় লক্ষ লক্ষ ব্যবসায়িক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিবিদদের শঙ্কিত করে তোলে। এতদসত্ত্বেও বৈশ্বিক প্রতিক‚লতা বাংলাদেশ ভালোভাবেই মোকাবিলা করছে বলে মনে হয়।
করোনার প্রকোপ হ্রাস পাওয়ার পর পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরায় শুরু হয়েছিল, কিন্তু অকস্মাৎ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বেধে গেলে মানুষের জীবনে আবার মারাত্মক দুর্যোগ নেমে আসে। এর ফলে আবার পৃথিবীর সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ে। রাশিয়ার উপর আমেরিকা এবং ইউরোপের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বিশ্ব পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে। ইউরোপ তাদের ৪০ শতাংশ জ্বালানির জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল ছিল; কিন্তু আমেরিকার লক্ষ্য হচ্ছে রাশিয়ার তেল-গ্যাস বিক্রি বন্ধ করে দিয়ে তাদের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে তোলা।
শুধু তাই নয়, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের গম সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খাদ্য সংকটও দেখা দেয়। শিল্প উৎপাদন ও সভ্যতার বিকাশে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের অবদান বিশ্ব সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর।
কোন দেশ কতটুকু উন্নত বা কতটুকু সভ্য তা পরিমাপ করা হয় মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের ভিত্তিতে; আর বিদ্যুৎ উৎপাদনে লাগে তেল আর গ্যাস। রাশিয়ার তেল-গ্যাস সরবরাহে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ার পর উৎপাদক দেশগুলো তাদের জ্বালানি তেলের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ এবং শিল্পজাত সকল পণ্যের দামও বেড়ে গিয়েছে।
আমেরিকা তাদের রিজার্ভের তেল সরবরাহ করে ইউরোপকে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। জ্বালানি তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে তেলের দর সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে আমেরিকার শক্তিধর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সউদি আরব সফর করেছিলেন; কিন্তু সউদি আরব জো বাইডেনের কথা শোনেনি, সউদি আরবসহ সকল তেল উৎপাদক দেশ উৎপাদন আরও কমিয়ে আনবে।
তাই জিনিসপত্রের দাম শিগগির কমবে বলে মনে হচ্ছে না। এই অবস্থায় মূল্যস্ফীতি হ্রাস করতে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে- সুদের হার বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি কমানোর এই প্রয়াসে বিশ্ব মন্দার সৃষ্টি হতে পারে।
সবল অর্থনীতি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরোপের অবস্থান শীর্ষে। কিন্তু এই তিন শক্তির অর্থনৈতিক সামর্থ্য ক্রমশ ক্ষয় হচ্ছে, অর্থনীতির চাকা দ্রুত গতি হারাচ্ছে। বিশ্ব মন্দা শুরু হলে বাংলাদেশের মতো উঠতি বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে মারাত্মকভাবে।
বিশ্ব বাজারে তাদের পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় চীন তাদের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছিল, এখন ভিন্ন নীতি গ্রহণ করেছে, করোনার নতুন প্রকোপেও চীন দেশের অভ্যন্তরে সকল বাধানিষেধ বাতিল করেছে এবং নিজের দেশকে বহির্বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছে, এতে তাদের অর্থনীতির মধ্যে একটি নতুন গতির সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকায় নতুন চাহিদা সৃষ্টি না হলে বিশ্ব মন্দা ঠেকানো কঠিন হবে। ইউক্রেন-রাশিয়ার বিরোধ শীঘ্রই থামছে না, আমেরিকা রাশিয়াকে শাস্তি দিতে গিয়ে সারা পৃথিবীকে দিচ্ছে। পৃথিবীতে যত বেশি অশান্তি হবে আমেরিকা, ইউরোপ তত বেশি অস্ত্র বিক্রি করতে পারবে। তাই তাদের রিজার্ভের কোনো সমস্যা নেই, রিজার্ভের সমস্যা শুধু গরিব দেশের।
জিনিসপত্রের লাগামহীন দাম বৃদ্ধির কারণে দেশে দেশে জনগণের যেভাবে বিক্ষুব্ধ হওয়ার কথা ছিল তা কিন্তু হচ্ছে না। কারণ মানুষ এখন কিছুটা সচেতন, তারা বিরাজমান বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা অবহিত। তারা বুঝতে পারছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা গরিব দেশগুলোর সরকারের হাতে নেই, এই ক্ষমতা বিশ্ব মোড়লদের হাতে।
ইউক্রেনের চারটি এলাকা রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমেরিকা কখনো ইউক্রেনকে রাশিয়ার সঙ্গে আপস করতে দেবে না। রাশিয়াও সুপার পাওয়ারের অহঙ্কারে দখলকৃত চারটি এলাকা ছেড়ে দেবে না। মানমর্যাদার প্রশ্নটি এখন মীমাংসার পথে প্রধান বাধা। আমেরিকা এবং ইউরোপ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ করে ইউক্রেন সেনাদের উজ্জীবিত করে তুলছে।
এর ফলে একদিকে যুদ্ধ চলবে, অন্যদিকে রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকবে। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে শুধু রাশিয়া নয়, কোনো দেশ মুক্ত থাকতে পারছে না। রাশিয়ার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য পণ্য সামগ্রী নিয়ে আগত রাশিয়ার জাহাজ আমাদের মোংলা বন্দরে ভিড়তে দেওয়া হয়নি। আমরা আমেরিকার নির্দেশনাকে সমীহ করতে বাধ্য হয়েছি।
ভারত এবং চীনের মতো যদি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকত আমরাও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারতাম। আমাদের ছোট্ট একটি ভূখণ্ডে নিজের উৎপাদন দিয়ে ১৭ কোটি লোকের খাবারের জোগান দেওয়ার মতো চাষযোগ্য জমি নেই। বসতভিটার জন্য প্রতিদিন ফসলি জমি ভরাট হচ্ছে, প্রবাসীদের টাকায় গ্রামেগঞ্জে গড়ে উঠছে অট্টালিকা।
যে পরিমাণ চাষযোগ্য জমি রয়েছে তাতে ফলাতে হয় ধান, গম, ভুট্টা, ইক্ষু, ডাল, নানা রকমের সবজি। রেকর্ড পরিমাণ ধান, মাছ, সবজি উৎপাদন সত্ত্বেও আমাদের চাহিদা পূরণ হয় না। লোকসংখ্যার আধিক্য আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাম্পার উৎপাদনও টেকসই হয় না। হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে কিনতে হয় শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি।
করোনার কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন কেনা সম্ভব হয়নি বলে এখন কারখানার সংস্কার ও সম্প্রসারণে অধিক আমদানি হচ্ছে। এ ছাড়াও কিনতে হয় জ্বালানি তেল; কিনতে হয় মোবাইল, টিভি, রাসায়নিক দ্রব্য, বাস, ট্রাক, কার, রেলগাড়ি, বিমান, চাল, গম, পেঁয়াজ, মসলা, ফল, দুধ, দুগ্ধজাত খাবার, ভোজ্যতেল, চিনি, মধু, কোমল পানীয়, চিপস, বিস্কুট, চকলেট-ক্যান্ডি, ছোলা, খেজুর, আলপিনসহ শত শত আইটেম। নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্য আমদানি না হলে সঙ্গে সঙ্গে বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়; ভারত পেঁয়াজ দেওয়া বন্ধ করে দিলে কিছুদিন আগে আমাদের পেঁয়াজের জন্য সারা পৃথিবী চষে বেড়াতে হয়েছে।
আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে শুধু গার্মেন্টস থেকে। রপ্তানির চেয়ে আমদানি খরচ অনেক বেশি এবং এই টাকা সমন্বয় করা হয় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে, না হলে রিজার্ভ থেকে পরিশোধ করা হয়। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বৈধ পথে ৭৮ কোটি ৭৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স কম এসেছে। তবে গত নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বর মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স সাড়ে ১০ কোটি ডলার বেড়েছে।
২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরে রিজার্ভ ছিল ৩৩.৭৭ বিলিয়ন ডলার, ইতোমধ্যে হয়তো আরও এক বিলিয়ন কমেছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় ৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের হিসাব থেকে বাদ দিতে পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ; তবে বিনিয়োগের এই ৮ বিলিয়ন ডলার নিয়মিত ফেরত আসছে এবং তা এখন ৫ বিলিয়ন ডলারে হ্রাস পেয়েছে।
সরকার আছে উভয় সংকটে- একদিকে বিদেশি পণ্যের সীমাহীন চাহিদা, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সীমাবদ্ধতা। স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, বিলাসী দ্রব্যসহ কিছু পণ্যের আমদানি ধীরে ধীরে কমছে এবং রপ্তানি কিছুটা বাড়ছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৯.৩৩ শতাংশ।
তবে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স খুব বেশি বাড়ছে না। অর্থ পাচার রোধ করা সম্ভব হলে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটানো সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে তফসিলি ব্যাংকগুলো তাদের স্ব স্ব ব্যাংকে স্থাপিত এলসি গভীরভাবে মনিটর করছে, পণ্যের প্রকৃত দরের সঙ্গে এলসির ইনভয়েস মূল্য যাচাই করছে।
প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণে উৎসাহ দিতে চলতি জানুয়ারি মাস থেকে প্রণোদনা দুই শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে আড়াই শতাংশ করা হয়েছে। যারা আওয়ামী লীগ সরকারের ঘোর বিরোধী তারা শতভাগ প্রণোদনা দিলেও এই মুহূর্তে বৈধ পথে অর্থ পাঠাবে না। এই অবস্থায় প্রয়োজন হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কঠোর হস্তে দমন করা এবং নেতিবাচক প্রচারণা থেকে সাধারণ প্রবাসীদের মুক্ত রাখা।
সাবেক নির্বাহী পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক