ইসরায়েল থেকে ইউক্রেনে আর্টিলারি শেল পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০১:৩৫ পিএম

ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যাপকভাবে আর্টিলারি গোলা ব্যবহার করছে। ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যাপকভাবে আর্টিলারি গোলা ব্যবহার করছে। ছবি: সংগৃহীত

ইসরায়েলে মজুদ করা গোলাবারুদের একাংশ ইউক্রেনে পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ১৭ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে এ খবর জানানো হয়েছে। কম আলোচিত এই মজুদ যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের মাটিতে রেখেছিল মধ্যপ্রাচ্যে ভবিষ্যৎ কোনো সম্ভাব্য যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। 

জরুরি প্রয়োজনে ইসরায়েলেরও এই মজুদ থেকে গোলাবারুদ ব্যবহার করার অনুমতি রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে উভয় পক্ষ ব্যাপকভাবে আর্টিলারি গোলা ব্যবহার করছে। ফলে উভয় পক্ষই গোলাবারুদের স্বল্পতায় পড়েছে। এমতাবস্থায় কার গোলাবারুদের মজুদ আগে শেষ হয়, সেটার উপরেই নির্ভর করছে যুদ্ধে কে এগিয়ে বা পিছিয়ে থাকবে।  

গোলাবারুদের স্বল্পতার কারণে ইউক্রেন বাধ্য হয়েছে পশ্চিমা ডিজাইনের আর্টিলারির উপরে নির্ভরশীল হতে। এখন পশ্চিমা দেশগুলোও ইউক্রেনকে আর্টিলারি গোলা দিতে গিয়ে নিজেদের মজুদই কমিয়ে ফেলেছে। একই সঙ্গে মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও তত দ্রুতগতিতে আর্টিলারি গোলা উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে না। ইউক্রেন প্রতি মাসে ৯০ হাজার আর্টিলারি শেল ব্যবহার করছে; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের যৌথ উৎপাদন ক্ষমতার দ্বিগুণ। 

ফলে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া ও ইসরায়েলে মজুদ করা গোলাবারুদ থেকে ইউক্রেনকে সরবরাহ করতে। ইউক্রেনকে প্রতিশ্রুত ১০ লাখ আর্টিলারি শেলের অর্ধেকের কিছু কম এই দুই দেশের মজুদ থেকে দেওয়া হয়েছে।

ওয়াশিংটনের এই পদক্ষেপ একদিকে যেমন মার্কিন অস্ত্র নির্মাণ সক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরছে, তেমনি দক্ষিণ কোরিয়া ও ইসরায়েলের মতো দেশগুলো, যারা এতদিন ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি শত্রুতা করতে চাইছিল না, তারাও এখন ইউক্রেন যুদ্ধের অংশ হতে বাধ্য হলো।  

ইসরায়েলি গবেষণা সংস্থা মিতভিমের প্রধান নিমরড গোরেন বলেছেন, ইসরায়েল থেকে আর্টিলারি শেল সরিয়ে ফেলার মার্কিন সিদ্ধান্তে তেল আবিবের খুব বেশি কিছু বলার নেই। কারণ এই অস্ত্রের মালিক যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে ইউক্রেনকে শুধু মানবিক সহায়তা দেওয়ার ইসরায়েলি সিদ্ধান্তে কোনো পরিবর্তন আসেনি। 

ইসরায়েলের মধ্যপন্থিরা ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা জানাচ্ছে; অপরদিকে ডানপন্থিরা সাবধানে কথা বলছে। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেন ইতিমধ্যেই বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে কম কথা বলার নীতিতে রয়েছে। 

ইসরায়েলি ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দেশটির ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক আরকাদি মিলমান বলেন, রাশিয়া এই পদক্ষেপকে ভালোভাবে নাও নিতে পারে। ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্তের কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল ইসরায়েল। তবে এর কারণে রাশিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা নেই। 

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘সিএনএ’-এর ডিরেক্টর মাইকেল কফম্যান বলেছেন, আর্টিলারি শেলের সরবরাহের ঘাটতি পূরণে যুক্তরাষ্ট্র তার মজুদ থেকে জোগান দিতে বাধ্য হচ্ছে। এর অর্থ হলো, ওয়াশিংটন অন্য কোথাও ঝুঁকি নিয়ে সরবরাহ নিশ্চিত করছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা গোলাবারুদের মজুদ পুনরায় পরিপূর্ণ করবে এবং জরুরি প্রয়োজনে অতি দ্রুত গোলাবারুদ সরবরাহ করবে। মার্কিন কংগ্রেসের রিসার্চ সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল ২০০৬ সালে হিযবুল্লাহ এবং ২০১৪ সালে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন মজুদ থেকে আর্টিলারি শেল ব্যবহার করেছিল। 

ইসরায়েলিরা দুশ্চিন্তায় রয়েছে, তারা ইউক্রেনকে সহায়তা দিলে সিরিয়াতে রাশিয়া তাদের সামরিক শক্তিকে ইসরায়েলের বিপক্ষে ব্যবহার করতে পারে। বর্তমানে সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে রাশিয়া কিছু করা থেকে বিরত রয়েছে।

অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ইউক্রেনে গোলাবারুদ সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশটি ইসরায়েলের মতো বাধা দেয়নি। তারা একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গোলাবারুদের স্বল্পতা পুষিয়ে নিতে এক লাখ আর্টিলারি শেল বিক্রি করতে চুক্তি করেছে।  

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা যে শুধু আর্টিলারি শেল নিয়ে, তা কিন্তু নয়। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে ৭ হাজার ‘জ্যাভেলিন’ ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্টকের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শেষ করে ফেলেছে। একই সঙ্গে কাঁধের উপর থেকে ছোঁড়া ‘স্টিংগার’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের মজুদের প্রায় এক-চতুর্থাংশও ইউক্রেনকে সরবরাহ করা হয়েছে। স্টিংগারের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রেথিয়ন বলছে, কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে এই ক্ষেপণাস্ত্রের উৎপাদন পুনরায় শুরু করতে। 

২০২০ সালে পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পে সরবরাহকারীর সংখ্যা অত্যধিকভাবে কমে যাওয়ায় এবং দক্ষ শ্রমিকের স্বল্পতা দেখা দেওয়ায় মার্কিন সামরিক উৎপাদন দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু যন্ত্রাংশ এখন হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করে; যা কিনা পুরো ব্যবস্থাকেই হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনের এই সমস্যা শুধু ইউক্রেনকে সরবরাহ নয়, ভবিষ্যতে তাইওয়ানকে জরুরি সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বিশেষ করে কম্পিউটার চিপ সরবরাহের জটিলতা কাটিয়ে উঠতে অনেক বেশি সমস্যায় পড়তে হবে। 

গত ১১ জানুয়ারি মার্কিন নৌবাহিনীর সচিব কার্লোস ডেল টরো সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ছয় মাস বা এক বছরের মাঝে মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্প যদি তাদের উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি করতে সক্ষম না হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী করার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এর কিছুদিন আগেই মার্কিন নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল ড্যারিল কাউডল এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন, অতি শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করবে, নাকি নিজেকে শক্তিশালী করবে? 

তিনি আরও বলেন, তিন বছর ধরেই প্রতিরক্ষা শিল্পের সরবরাহকারীরা করোনা ভাইরাস মহামারির দোহাই দিয়ে সরবরাহ পিছাচ্ছে; যা মেনে নেওয়া কষ্টকর। সরবরাহের সমস্যা এমন সময়ে আসছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে একটা শত্রুকে মোকাবিলা করছে; আর অপরদিকে আরেকটা সম্ভাব্য শত্রু প্রস্তুত হচ্ছে, যে রকম শত্রু মার্কিনিরা আগে কখনো দেখেনি। এরকম পরিস্থিতিতে অস্ত্র সরবরাহ পিছিয়ে যাওয়া জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি। 

অ্যাডমিরাল কাউডল মূলত রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন সহায়তা দিতে গিয়ে চীনকে মোকাবিলায় দুর্বলতা নিয়ে কথা বলেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমরশক্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই যথেষ্ট অস্ত্র নেই।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh