রাশিয়া-ভারত-ইরানের নতুন বাণিজ্য করিডর

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:৩৬ পিএম

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রাইসি। ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রাইসি। ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন যুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া-ইরান সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ইরান। অচিরেই এসব নিষেধাজ্ঞা শিথিল হওয়ার কোনো বাস্তবতাও দেখা যাচ্ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়াও নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে।

কার্যত রাশিয়াকে গোটা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেই এখন বাণিজ্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে। এদিকে করোনাকালের আগে থেকেই ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত ভারত। তাই দেশটি চাইছে কম মূল্যে জ্বালানি ও পণ্য রপ্তানি করতে। নতুন এ বাস্তবতাই আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্যের নতুন পথ উন্মোচন করেছে। 

ভারতে রুশ পণ্য সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে নতুন শিপিং রুট করেছে তেহরান। ইরানের রাষ্ট্র পরিচালিত ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান শিপিং লাইন (আইআরআইএসএল) এই নেটওয়ার্ক তৈরিতে কাজ করছে। নতুন রুটে রুশ পণ্যবাহী জাহাজগুলো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর (আইএনএসটিসি) হয়ে ভারতে পৌঁছাচ্ছে।

৭ হাজার ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ আইএনএসটিসি হলো ভারত, ইরান, আজারবাইজান, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপকে রেল ও সমুদ্রপথে একসূত্রে বাঁধার প্রকল্প। ২০০০ সাল থেকে প্রকল্পটি নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠা হয় আইএনএসটিসি।

তবে ভূরাজনৈতিক বাধায় সময়ের সঙ্গে নতুন রুটের প্রতি আগ্রহ কমে যায়। ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে প্রতিবেশী রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর পর ফের আলোচনায় আসে আইএনএসটিসি। করিডরটি ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।

ইরান ও রাশিয়ার পণ্যবাহী কয়েকশ জাহাজ কাস্পিয়ান সাগরমুখী নদীগুলোয় চলাচল করেছে। তাছাড়া ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইরান রাশিয়ার জন্য নিরাপদ। শুধু ইরানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের স্বার্থে নয়, নতুন করিডর ইরানীয় অঞ্চল হয়ে এশিয়া ও ভারতে পণ্য সরবরাহ করতেও গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। বিপরীতে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিও থাকবে না।

এ বিষয়ে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপসাগর বিশেষজ্ঞ নিকোলাই কোজানভ ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ক্রেমলিনের ক‚টনীতিক হিসেবে তেহরানে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ইউরোপীয় পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরান ও রাশিয়া বিকল্প বাণিজ্যপথের দিকে মনোযোগী হয়েছে। নতুন সৃষ্ট এ রাস্তার জন্যই রাশিয়ার পক্ষে প্রাচ্যের দিকে ঝুঁকে পড়া সহজ হয়েছে। সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক চলাচলের ওপর অবরোধ আরোপ করা যায়; কিন্তু স্থলপথে নজরদারিতে রাখা কঠিন। সবকিছুকে নজরদারির মধ্যে রাখা তো রীতিমতো অসম্ভব।’

রাশিয়ার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রধান সের্গেই কাতিরিনের দাবি, ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যকে মৌলিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সম্পর্কের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে এটি। নিয়ামক হিসেবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেও বাণিজ্যিক যোগাযোগ বজায় রাখছে।

এ কারণেই গত বছর সেপ্টেম্বরে ইকোনমিক ফোরামের বৈঠকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জাহাজ, রেল ও রাস্তার নির্মাণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কাতিরিন বলেন, ‘রাশিয়ার কোম্পানিগুলোর জন্য এ করিডর দ্রুত ইরান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বাজারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করবে। পাশাপাশি সেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানিও সুবিধাজনক হয়ে উঠবে।’

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ মারিয়া শাগিনা মনে করেন, নতুন এ পথ মূলত এমন একটি সরবরাহ ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস যেখানে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর। তিনি জানান, রাশিয়া ও ইরান আড়াই হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে কেবল বাণিজ্যপথের উন্নয়ন ও বিস্তৃতির জন্য।

আজারবাইজানের মধ্য দিয়ে বাণিজ্য করিডর নির্মাণের ক্ষেত্রে রাশিয়া ও ইরান দুই পক্ষের জন্যই সমস্যা ছিল। তুরস্কের মধ্যস্থতায় তা কেটেছে। উল্লেখ্য, তুরস্কের ড্রোনের জোরেই আর্মেনিয়াকে যুদ্ধে পরাস্ত করেছিল আজারবাইজান। দেশটির প্রেসিডেন্ট এলহাম আলিয়েভও জানিয়েছেন, আইএনএসটিসি প্রকল্পের আজারবাইজান অংশের সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।

এটি চালু হলে দেশটির ভেতর দিয়ে ১৫-৩০ মিলিয়ন টনের কার্গো চলাচল সম্ভব হবে। রাশিয়া-ইরান সম্প্রতি আস্তারা-রাস্ত-কাজভিন রেলপথ নির্মাণ শেষ করার ব্যাপারেও আলোচনা করেছে। এটি শেষ হলে রাশিয়া, আজারবাইজান ও ইরানের এখনকার রেলপথ আইএনএসটিসি করিডরের সঙ্গে যুক্ত হবে। মস্কো ও তেহরান আঞ্চলিক এ নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে।

আইএনএসটিসি বাস্তব রূপ পেলে পূর্ব ইউরোপের বাজারে রাশিয়া ও ইরানের কোম্পানিগুলো ফের জায়গা করে নিতে পারবে। নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছে। রাশিয়া দাগিস্তানের মধ্য দিয়ে সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এ অঞ্চলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ রয়েছে। নৃতাত্ত্বিকভাবে রুশ জনগোষ্ঠী সেখানে মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ইউক্রেনে রাশিয়া হেরে গেলে বা কোণঠাসা হয়ে পড়লে দাগিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা তীব্র হবে।

ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে ইউরোপের দেশগুলো ভারতের সঙ্গে ব্যবসার জন্য রাশিয়া ও ইরানকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে না। তবে ভারত, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলো রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে অধিক সক্রিয় হয়ে উঠলে এ বাণিজ্য করিডরটি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে এ সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিশাল আকারের পরিবহন অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বেকায়দায় পড়া মস্কো বা ইরানের জন্য এটি বড় বিনিয়োগ। তবে এটি তাদের বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টিরও অংশ হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান ও নির্মাণ সামগ্রী উৎপাদনে গতি আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। 

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, আইএনএসটিসির পূর্বাঞ্চলীয় শাখা হয়ে এর মধ্যেই ভারতে কন্টেইনার আসতে শুরু করেছে। বাণিজ্য করিডরটির রয়েছে অমিত সম্ভাবনা; এটি হতে পারে সুয়েজ খাল, ভ‚মধ্যসাগর ও বসফোরাস প্রণালির মতো প্রচলিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথগুলোর উপযুক্ত বিকল্প। চাবাহার বন্দরকে করিডরে অন্তর্ভুক্ত করতে ইরানের প্রতি অনুরোধ করেছে ভারত।

বন্দরটি নির্মাণে ভারত অগ্রণী ভ‚মিকাও রাখে। চাবাহার বন্দর দিয়ে সহজেই পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুবিধা পাবে ভারত। এড়াতে পারবে পাকিস্তানের প্রভাব। আফগানিস্তানকেও বন্দরটি ব্যবহারের সুযোগ নেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারে নয়াদিল্লি। সম্প্রতি তালেবান সরকারের সঙ্গে দিল্লির কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনও সেদিকে ইঙ্গিত করছে। 

ইরানের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক বেশ জটিল হলেও, তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অপরিশোধিত ইরানের তেলের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা দীর্ঘদিনের। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে এই বাণিজ্যে ভাটা পড়লেও, তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। তা ছাড়া ইরানের মাধ্যমেই পাকিস্তানকে এড়িয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে নয়াদিল্লি।

যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোটের নিষেধাজ্ঞা, অন্তর্ঘাত বা অন্য কোনোভাবে এ উদ্যোগে বাধা দিতে পারে। যে কারণে এ উদ্যোগে অনেক দেশকে যুক্ত করতে চাইছে রাশিয়া ও ইরান। আর বহু দেশের স্বার্থ যখন এ করিডরে যুক্ত থাকবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা ভূরাজনীতি-ভূঅর্থনীতিতে এক ভিন্নমাত্রা যোগ করবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh