একজন সুখী ঘুমকাতুরে মানুষ

রাসেল রায়হান

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:৪৯ পিএম

গল্প। প্রতীকী ছবি

গল্প। প্রতীকী ছবি

সে কি তার নিয়তি জানত? একদিন ইট-বালুর স্তূপে চাপা পড়ার প্রস্তুতি ছিল তার? তেমন হলে এই নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাই ছিল না কেন? এমনকি তার ঘুমেরও সামান্য ব্যাঘাত ঘটেনি কোনোদিন। ঘুমাতে অসম্ভব পারদর্শী সে।

অদ্ভুত বিষয় হলো, তার ঘুমের আলাদা কোনো টাইম-টেবিল নেই। এমনও হয়, পশ্চিমের ভাঙা কাঠের দরজা খুলে সূর্যের লাল রঙ দেখতে-দেখতে সে ঘুমিয়ে পড়ল আর ভোর চারটায় উঠে মাথা চুলকাতে-চুলকাতে আকাশ দেখতে লাগল।

এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে আঙুলের দাগ কেটে কেটে আঁকতে লাগল ভেড়া, বৃক্ষ কিংবা সচরাচর দেখা পাঁচ ঝিলিকঅলা অনুজ্জ্বল কোনো নক্ষত্র। কিংবা ভরদুপুরে একপেট ক্ষুধা নিয়েও সে ঘুমিয়ে পড়তে পারত। তার মতো অলস আর অদ্ভুত ব্যক্তি সমগ্র বৃষ্টিপুরে দ্বিতীয়টি ছিল না।

যদিও গাঁয়ের কোনো মানুষ তাকে স্বাভাবিক আখ্যা দেয়নি, তবে তার নামের সাথে রহস্যময় কোনো অভিধাও লাগায়নি। ক্রমশ তারা এই মানুষটিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। আর কে না জানে অভ্যাসের মাহাত্ম্য।

ক্ষুধা লাগলেই সে একটা ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে; ভালো পরিমাণ ভিক্ষা নিয়ে ফিরে আসে। সে কারো সাতেও নেই, পাঁচেও নেই- এটি বোধ হয় একটা কারণ। এবং সে ছিল এই জটিলতাপূর্ণ পৃথিবীর একজন সহজ সুখী মানুষ।

সেবার গরম পড়ল খুব। সময়ের আগেই টসটস করে পাকতে শুরু করল আম-কাঁঠাল। বৃষ্টি হলো না একটানা দুমাস, তাপমাত্রা অতিক্রম করল অতীতের সমস্ত রেকর্ড। গ্রামের যুবক-যুবতীরা বাড়ি-বাড়ি চাল-ডাল তুলল আর গান গাইতে লাগল, ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই...’। 

সেই সময়টিতেও সে ছিল নির্বিকার। চারপাশের দেয়াল ভিজিয়ে জামাকাপড় খুলে উলঙ্গ হয়ে আরামসে ঘুমুতে লাগল সে।

সূর্য প্রখর থেকে প্রখরতর হতে লাগল। ওল্টানো বারোটি মুখের একটি আগে থেকেই খোলা ছিল সূর্যের, স্রষ্টা সম্ভবত আরও একটি খুলে দিলেন। এ অবস্থাতেও সুখী মানুষটির কিছুই গেল-আসলো না। সে ক্রমাগত দেয়াল ভেজাতে লাগল। তার ঘুম আরও দৃঢ় হলো। এখন সে আরও কম মাধুকরীতে বের হয়। ফলে তার ক্ষুধা কমে গেল। সুতরাং বেশি ভিক্ষারও প্রয়োজন পড়ল না।

শুয়ে-শুয়ে কি মৃত্যুর জন্যই অপেক্ষা করছিল সে? মৃত্যু তার কাছে খুব ভয়ঙ্কর কিছু ছিল বলে কারওই মনে হয়নি। কে জানে, সে হয়তো চাইতই একদিন এই কক্ষের ঘর ইট-বালুসমেত ভেঙে পড়ুক। এবং তেমন হলেও তার কিচ্ছু যাবে-আসবে না। 

বরং বেশ আগ্রহ নিয়ে সম্ভবত লোকটি প্রস্তুত হতে থাকল মৃত্যুর ফেরেশতার জন্য, মৃত্যুর জন্য। হয়তো ঘুমই ছিল মৃত্যুর জন্য তার একমাত্র প্রস্তুতি।

দুই.

বিরান প্রান্তরে একলা পথ হারানো মৃত ঘোড়ার মতো পড়ে আছে এই এক কক্ষের হলুদ বাড়ি। এ বাড়ির ইতিহাস গ্রামের দুয়েকজন প্রাচীন বৃদ্ধই শুধু জানে। অন্যরা তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি বলেই বোধ হয় তাদের কাউকে বলা হয়নি। 

সবাই ভাবে, এই বিরান প্রান্তরে একটা হলুদ বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, থাকুক না! বাড়ির মধ্যে অকস্মাৎ আবির্ভূত হওয়া একজন মানুষ শুয়ে থাকে, থাকুক। কার কী ক্ষতি তাতে? পৃথিবীতে একজন মানুষ আছে, এবং সে কারও ক্ষতি করছে না- তার চেয়ে উপকারী কোনো মানুষ থাকা সম্ভবই নয়!

আচমকা কার মাথায় চিন্তাটা এলো- কে জানে। কেউ একজন হুট করে চাইল অলস মানুষটিকে বিয়ে দেওয়া হোক, বেচারা একা-একা শুয়ে থাকে! কে না জানে, শোয়ার জন্যই মানুষ সবচেয়ে বেশি সঙ্গীর প্রয়োজন বোধ করে! দু-চারদিনের মাঝেই সংক্রামক ব্যাধির মতো সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল এই খবর।

একটা মুখ সবাই চালাচ্ছে, আরেকটা মুখও কি চালাতে পারবে না? দুবছর পর দুয়েকটা শিশু এলে তা চালানোও খুব কষ্টের হবে না। তবু একজন ভালো মানুষ এখন না-হয় সুখী মানুষও হোক।

কিভাবে কিভাবে যেন সবাই মোটামুটি উপযোগী একটা মেয়ে জোগাড় করে ফেলল এবং পাঁচশ এক টাকা দেনমোহরে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। দেনমোহর নগদ দিয়ে দেওয়া হলো নববধূর হাতে! গ্রামবাসী নিজেরা নিজেরাই দিল। বড় কোনো উৎসবে সবাই নিখাদ আনন্দ করল অনেকদিন বাদে। প্রত্যেকে অল্প-অল্প করে কিছু ব্যবহার্য জিনিস এবং অর্থকড়ি উপহার দিল অলস এবং ভালো মানুষটির বিয়েতে।

এতেও লোকটির কোনো বিকারই দেখা গেল না। সে পড়ে পড়ে আরও ঘুমাতে লাগল। মজার বিষয় হলো, তার স্ত্রীও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘুমায়। সম্ভবত তারও এসবে কিছুই যায়-আসে না। গ্রামবাসী তৃপ্ত হয় এই ভেবে যে, দুচার গ্রাম ঘুরে তারা তবে সম্পূর্ণ উপযুক্ত মেয়েই জোগাড় করেছে সরল মানুষটির জন্য। সে নিশ্চয়ই আরও বেশি সুখী মানুষে পরিণত হবে এবার!

বড় আনন্দে দিন কাটতে থাকে দুজনের। পালাক্রমে একদিন লোকটি আর একদিন তার স্ত্রী ভিক্ষাবৃত্তিতে বের হয় এখন। 

তারা কী করছে না করছে এ নিয়ে গাঁয়ের লোকের কখনোই খুব মাথাব্যথা ছিল না, এখনো নেই। তারা যথারীতি ভিক্ষা দিয়ে গেল।

সেই যে অসহ্য গরম পড়েছিল, কাঁটায়-কাঁটায় তার ঠিক দুবছর পর তাদের প্রথম সন্তান জন্ম নিল। বাচ্চা হওয়ার দু দিন বাদেই দেখা গেল লোকটি ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছে। কিন্তু কখনোই যা হয়নি এই প্রথম সেটি ঘটল। মানুষটি দ্বিতীয় দিনও ভিক্ষায় নামল। তৃতীয় দিনও ভিক্ষায় নামতে দেখে সবাই বিস্মিত হলো। এত ঘন ঘন তাকে কখনোই দেখা যায়নি।

পরপর সাত দিন সে ঝোলা পরিপূর্ণ করে নিয়ে হলুদ বাড়িটিতে ফিরে গেল। এই সাধারণ শিশুটি স্রেফ দুজন মানুষের মৈথুনের সাক্ষীই হতে পারত- কিন্তু গ্রামবাসীর কাছে বিষয়টি অন্যভাবে ধরা দিল। একটি সাধারণ শিশু কত বড় পরিবর্তন আনতে পারে, এই প্রথম অনুভব করল তারা। সবাই দেখল অষ্টম দিনেও অলস মানুষটি ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরিয়েছে। 

এটি ছিল তাদের প্রথম তুমুল বিস্ময়!

তিন.

মানুষটি এই প্রথম কোনো ধরনের অস্থিরতা অনুভব করছে। কদিন ধরে আবার বৃষ্টি বন্ধ। সেই পুরনো দিনের মতো আবার যদি গরম পড়ে তাহলে কী হবে- এই চিন্তা তাকে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে ফেলে। নিজের ভেতরের পরিবর্তনগুলো সে এমনিতেই টের পাচ্ছিল, কিন্তু নিজেকে কখনোই এতটা অসহায় ও করুণ মনে হয়নি তার। এই প্রথম অসহায়ত্ব অনুভব করে শিউরে উঠতে বাধ্য হলো সে।

খোলা প্রান্তরে সরাসরি সূর্যের আলো আসে। সমস্যা হলো সেই আলো সঙ্গে করে নিয়ে নামে বস্তা বস্তা তাপ। আগে হলে দেয়াল ভিজিয়ে চোখ বুজে পড়ে থাকত ঘরের এক কোণে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াল তার শিশুসন্তান। গরমে প্রচণ্ড কাঁদতে শুরু করে সে, সমস্ত প্রান্তর আর হলুদ বাড়ি কাঁপিয়ে। প্রাগৈতিহাসিক ভাঙা তালপাতা দিয়ে ক্রমাগত বাতাস করতে থাকে তার স্ত্রী। তাতে কতটা হয়, আর কতক্ষণই বা বাতাস চালিয়ে যাওয়া যায়! স্বামী-স্ত্রী পালা করে সন্তানকে বাতাস করতে থাকে। 

কিন্তু তখন নতুন আরেক সমস্যা দেখা দেয়। বাচ্চার সারা গায়ে র‌্যাাশ ওঠে- একপশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর রাতের আকাশে দেখা নক্ষত্রগুলোর মতো। গরমে পিঠ ঘেমে ঘেমে ঠান্ডাজনিত সমস্যা দেখা দেয়। ক্রমশ বাড়তে থাকে জ্বর। শিশুটির মুখ স্তনে নিয়ে তার স্ত্রী কেঁপে ওঠে, স্তন গলে যাচ্ছে- এমন জ্বর! এই প্রথম তাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখা গেল গাঁয়ের রাস্তায়। একজন ভালো ডাক্তার প্রয়োজন এই মুহূর্তে।

ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে ফিরে আসতে আসতে রাত হয়ে আসে। রাতে শোয়ার সময় বিস্ময়করভাবে এই হলুদ বাড়ি নিয়ে আতঙ্ক অনুভব করে লোকটি। যদি কোনো অবস্থায় এই আলগা ঘর ভেঙে পড়ে! যদি তাদের শরীরের ওপরেই ভেঙে পড়ে হলুদ রঙচটা দেয়াল! তারা দুজন মরে গেলে কারুরই কিছু যাবে আসবে না, কিন্তু এই শিশুটি যদি মরে যায়? এখনো এই পৃথিবীর কিছুই দেখা হলো না তাদের সন্তানের। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিল তারা- এই বাড়িতে আর না! কাল সকালেই অন্য কোথাও উঠবে। কাল থেকে আর ভিক্ষা নয়, কাজ খুঁজতে বের হবে সে।

চার.

ভাঙা হলুদ বাড়িটির আশেপাশে অনেকে জড়ো হয়েছে। সবাই বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। রক্তাক্ত দুই পুরুষ-রমণীর মাঝখানে হাত-পা ছুড়ে কাঁদছে একটি দেবশিশু। অদ্ভুত এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য এক জনমে সবার হয় না!

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh