বিষাদ সিন্ধু: গদ্যে রচিত মহাকাব্য

এস ডি সুব্রত

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০২:৩৫ পিএম

বিষাদ সিন্ধু। প্রতীকী ছবি

বিষাদ সিন্ধু। প্রতীকী ছবি

বাংলা সাহিত্যের এক নন্দিতপ্রতিভা মীর মশাররফ হোসেন। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলা গদ্য সাহিত্যের ধারায় মুসলিম লেখকদের তেমন কোনো পদচারণা পরিলক্ষিত হয় না। মীর মশাররফ হোসেন যখন সাহিত্য সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত করেন তখন বাঙালি মুসলমান সমাজ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকে হারাম মনে করত।

মীর মশাররফ হোসেনই বাংলা সাহিত্যের এই শূন্যতাকে পূর্ণতা দানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেনের অমর সৃষ্টি ‘বিষাদ সিন্ধু’। 

বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থের মূল বিষয় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেনের সঙ্গে দামেস্ক অধিপতি মাবিয়ার একমাত্র পুত্র এজিদের কারবালা প্রান্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং হাসান-হোসেনের করুণ মৃত্যু। এটি বাংলা সাহিত্যের একটি ধ্রুপদী উপন্যাস। শিল্পবোধ ও জীবনানুভূতি অনন্য প্রকাশে গ্রন্থটি মীর মশাররফ হোসেনের এক স্মরণীয় কীর্তি। কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাসের কাহিনি।

বিষাদ সিন্ধু নামটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত। মানুষের নিয়তির এক নিষ্ঠুর বেদনাবহ পরিণতিই এ গ্রন্থের মূল উপজীব্য। ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস বিষাদ সিন্ধু মোট তিন খণ্ডে প্রকাশ হয়। প্রথম খণ্ড মহরম পর্ব (১৮৮৫), দ্বিতীয় খণ্ড উদ্ধার পর্ব (১৮৮৭) এবং তৃতীয় খণ্ড এজিদ বধ পর্ব (১৮৯১); মোট ৬৩টি ভাগ নিয়ে গ্রন্থটি রচিত। মহরম পর্বে ২৬টি ভাগ, উদ্ধার পর্বে ৩০টি ভাগ এবং এজিদ বধ পর্বে ৫টি ভাগ; তাছাড়া উপক্রমণিকা ও উপসংহার রয়েছে।

মহরম পর্বে এজিদের জয়নবকে না পাওয়ার বিরহ, আব্দুল জব্বার কর্তৃক জয়নবের তালাকপ্রাপ্তির সংবাদ এবং শেষ পর্বে হযরত হোসেনের মর্মান্তিক শাহাদাত বরণকে লেখক বিষাদ সিন্ধুর সাথে তুলনা করেছেন। ইমাম হাসানকে হত্যা করা হয় বিষ প্রয়োগে আর ইমাম হোসেনসহ অনেক নিকটাত্মীয়কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় কারবালা প্রান্তরে।

বিষাদ সিন্ধু জাদুকরী রচনাগুণের জন্য ও ধর্মের স্পর্শকাতরতার জন্য সাহিত্যরসিকদের কাছে জনপ্রিয়। জয়নবের রূপে বিমোহিত এজিদ এবং এই রূপতৃষ্ণার পরিণামে বহু মানুষের বিপর্যয় ও ধ্বংসের কথা বর্ণিত হয়েছে, যা বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সেই সাথে তা গ্রন্থটিকে সর্বজনীন করে তুলেছে।

বিষাদসিন্ধুর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘সীতার বনবাস’ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে যেমন এককালে পঠিত হইয়াছিল, ‘বিষাদ সিন্ধু’ তেমনই আজও পর্যন্ত জাতীয় মহাকাব্যরূপে বাঙলা মুসলমানের ঘরে ঘরে পঠিত হয়; বাংলা সাহিত্যের অপূর্ব্ব সম্পদ হিসাবে সকল সমাজেই এই গদ্যকাব্যখানির সমান আদর।”

এজিদ চরিত্রে নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, দানবীয় পৈশাচিকতা ও অমানবিক আচরণ সবকিছুর ব্যাখ্যা ঐ জয়নব প্রেম। প্রণয়ে ব্যর্থতা ও দয়িতার প্রত্যাখ্যানের মর্মপীড়া এজিদের অন্তরে যে প্রতিহিংসার আগুন জ্বেলেছে তাতেই ভস্মীভ‚ত হয়েছে সকল মানবিক গুণাবলি, নীতিবোধ ও সহজাত বিবেচনা শক্তি। এজিদের কণ্ঠে তাই শোনা যায়, ‘আমি যাহার জন্য প্রাণ পর্যন্ত পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত, আমি যাহার জন্য রাজ্যসুখ তুচ্ছ করিয়া এই কিশোর বয়সে জীবন পর্যন্ত বিসর্জন করিতে অগ্রগামী, যাহার জন্য এতদিন কষ্ট সহ্য করিলাম, সেই জয়নবকে হাসান বিবাহ করিবে?

এজিদের চক্ষে তাহা কখনই সহ্য হইবে না।’ পুঁথির জগৎ থেকে মীর মশাররফ বিষাদ সিন্ধুর কাহিনি চয়ন করলেও এই উপাখ্যানে তিনি যে শিল্পবোধের স্বাক্ষর রেখেছেন তা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিষাদ সিন্ধু ঐতিহাসিক উপন্যাস, মহাকাব্য না রোমান্টিক কাহিনি এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।

মুহম্মদ আবদুল হাই বিষাদ সিন্ধুর আঙ্গিক বিষয়ে বলেছেন, ‘বিষাদ সিন্ধু খাঁটি ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, তেমনি আটঘাট বিধিবদ্ধ ড়ৎমধহরপ ঢ়ষড়ঃ-এর উপন্যাসও নয়। এ ইতিহাস, উপন্যাস, সৃষ্টিধর্মীয় রচনা ও নাটক ইত্যাদি সাহিত্যের সর্ববিধ সংমিশ্রণে রোমান্টিক আবেগ মাখানো এক সংকর সৃষ্টি।’

বিষাদ সিন্ধুর কাহিনিতে মূল ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা থাকলেও গ্রন্থটিতে ইতিহাসের অন্ধ অনুসরণ করা হয়নি। সমসাময়িক বঙ্গবাসী পত্রিকা বলেছে, ‘যেরূপ সুন্দর, সুললিত, হৃদয়গ্রাহী ভাষায় গ্রন্থখানি রচিত, তাহাতে হোসেন সাহেবকে বাহাদুর বলিতে হয়।’

মধুসূদন-বঙ্কিম-দীনবন্ধুর সমকালে মীর মশাররফ হোসেন যেরূপ সুললিত গদ্যে ‘বিষাদ সিন্ধু’ রচনা করেছেন তা বিস্ময়করই বটে। তার সুচারু বাক্য- নির্মিতিতে বঙ্কিমের প্রভাব সুস্পষ্ট। সংলাপ বিনির্মাণে দীনবন্ধুর প্রভাবও অস্পষ্ট নয়। ‘বিষাদ সিন্ধু’ সে কারণেই গদ্যে রচিত হয়েও তার ভাষা হয়ে উঠেছে কাব্যময়। যেন এ গদ্যে লেখা এক মহাকাব্য।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh