রবিউল কমল
প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৫১ এএম | আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৫৪ এএম
প্রতীকী ছবি।
পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য মিমি কিছুই খেতে চায় না, পড়তেও চায় না। এটা নিয়ে মা-বাবা খুবই চিন্তিত। হঠাৎ কী হলো মিমির! এর সমাধান তো দরকার। তাই তারা মিমির জন্য নতুন একটি কৌশলের আশ্রয় নেন। আর তা হলো মা-বাবার কথা না শুনলে তারা মিমিকে নানাভাবে ভয় দেখাচ্ছেন। এই যেমন- পড়তে না বসলে ভূতে ধরবে, না খেলে সাপে কামড় দেবে। প্রথমদিকে এসব কৌশলে কাজ হয়েছিল। কিন্তু এখন ঘটছে উল্টো ঘটনা।
সব সময় মিমি ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে। সে আর
ছোটাছুটি করে না। স্কুলে গিয়েও সে আগের মতো খেলে না। সার্বক্ষণিক যেন ভয় তাড়া করে
তাকে। এ নিয়ে মা-বাবা পড়েছেন নতুন সমস্যায়।
প্রচুর কার্টুন
দেখে রিফাত। স্কুল থেকে ফিরেই টিভির রিমোট নিয়ে বসে পড়ে। টম অ্যান্ড জেরি, মিকি মাউস, ডিজনিসহ তার পছন্দের তালিকা অনেক দীর্ঘ।
কৌতূহলবশত একদিন ভয়ের সিনেমা দেখে খুব ভয় পেয়েছে রিফাত। সারারাত আর ঘুমাতেই পারল
না। চোখের সামনে সবসময় ভয়ঙ্কর আকৃতির অ্যানাকোন্ডার ছবি ভেসে উঠছে রিফাতের।
চিকিৎসা
বিজ্ঞানের মতে, শিশুরা অনেক সময়
গল্প শুনে বা ছবি দেখে ভয় পায়, আর এই ভয় শিশুর
মনের গভীরে ছাপ ফেলে। ফলে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ হয় বাধাগ্রস্ত। বিশেষজ্ঞরা
বলছেন, শিশুদের কোনো কাজ করানোর
জন্য ভয় দেখালে তা তার মনে গেঁথে যায়। এর ফলে ওই শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়
এবং আত্মবিশ্বাস কমে যায়। এর ফলে শিশুর সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে না। তাই শিশুদের
কোনোভাবেই ভয় দেখানো উচিত নয়।
আবার পারিবারিক
কলহের চাপেও অনেক শিশুর জীবন অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ঘটনায় শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে
নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেসব শিশু মা-বাবার মনোমালিন্য দেখতে দেখতে বড় হয় তারা হতাশ,
অসামাজিক ও সহিংস হয়ে
ওঠে। নানা অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকে তারা। তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়।
ফলে মনোসংযোগের ঘাটতিও দেখা দেয়। মানসিক রোগ ও ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা ঘটতে
পারে।
‘জাতীয় মানসিক
স্বাস্থ্য জরিপ-২০০৯’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ১৮ দশমিক ৩৫
শতাংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত। এমন ঘটনা আবার মেয়েশিশুর তুলনায় ছেলেশিশুর মধ্যে
বেশি। গবেষকরা বলেন, ‘শিশুদের ওপর
মানসিক আঘাতের প্রভাব অনেক দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষতিকর। যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত
ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মানসিক আঘাত শিশুর পরবর্তী জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে, আবেগজাত সমস্যায় আক্রান্ত করে।’
প্রতিদিন
মা-বাবার ঝগড়ার প্রত্যক্ষদর্শী অনেক শিশুর মধ্যে পরবর্তীকালে ব্যক্তিত্বের
অস্বাভাবিকতাও দেখা যায়। সমাজে মানিয়ে চলতে অসুবিধা হয়। গর্ভকালে যেসব মা
নির্যাতনের শিকার অথবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন, তাদের সন্তান জন্মের পর নানা জটিলতায় ভোগে।
নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই মেডিক্যাল সেন্টারের ট্রমাটিক স্ট্রেস স্টাডিজ বিভাগের এক
গবেষণায় দেখা যায়, মাতৃগর্ভে থাকার
সময় যাদের মা মানসিক আঘাতের শিকার হয়েছিল, সেই শিশুরা সহজেই মানসিক চাপে ভেঙে পড়ে এবং তাদের মধ্যে অ্যাংজাইটি বা পোস্ট
ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
ইউনিসেফের এক
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘পারিবারিক কলহের
মধ্যে বেড়ে ওঠা অথবা মাকে নির্যাতিত হতে দেখা শিশুদের জীবনের প্রথম দিকের
বছরগুলোতে তারা হয় বিশেষভাবে অরক্ষিত, অসহায়। এসব শিশু পরবর্তীকালে হিংস্র, ঝুঁকিপূর্ণ বা অপরাধমূলক আচরণ করতে পারে। বিষণœতা বা তীব্র দুশ্চিন্তায় ভোগার ঝুঁকিতেও পড়তে
পারে এসব শিশু।’
তাই শিশুর মানসিক
বিকাশে মা-বাবার ভালোবাসা, সান্নিধ্যের কোনো
বিকল্প নেই। মা-বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ ও মধুর সম্পর্ক শিশুর মধ্যে পরম সুখ ও
নিরাপত্তাবোধ জাগায়। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল বলেন, শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক বৃদ্ধি
হলো শারীরিক বিকাশ। আর মানসিক বিকাশ হলো আচার-ব্যবহার, চিন্তাচেতনা, কথা বলা, অনুভূতি ও ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষমতা অর্জন।
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ছাড়া শিশু তথা মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। গর্ভকালীন
মায়ের অপুষ্টি, মা-বাবার মধ্যে
কলহ, পারিবারিক নির্যাতন,
মাদকাসক্তি, থাইরয়েড ও অন্যান্য হরমোনের আধিক্য ও অভাব,
জন্মগত ত্রুটি, প্রসবকালীন জটিলতা, শব্দদূষণ, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ ইত্যাদি কারণে শিশুর মানসিক
বিকাশ ব্যাহত হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বাসা ও বিদ্যালয়ের পরিবেশ মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য অনুকূল হওয়া প্রয়োজন। বিদ্যালয়ের পরিবেশ সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও বিকাশে সচেষ্ট হলেন, অথচ বাসায় মা-বাবা এ ব্যাপারে সচেতন না, তাহলে শিশুর সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ ঘটবে না। শিক্ষক ও অভিভাবকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কোনোভাবেই শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষা সম্ভব নয়।