শেকড় ও শকুনের গল্প

আরিফুল হাসান

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:০২ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

সময়টা পৌষ মাস। শীতের শিশির গমের পেকে আসা মাঠে বিস্তৃতির হাসি ছড়িয়ে আবার নিভুনিভু করছে। এমনি এক সকালে শিশির হাত ধুতে গিয়ে পুকুরের জলে পড়ে যায়। প্রথমে তার বাবা হয়তো টের পায়। ঝপাস শব্দটাকে আঁৎকে তিনি শিশির বলে চিৎকার করে ওঠেন। তারপর মা দৌড়ে পুকুরে যায় এবং ঘাটে সন্তানকে দেখতে না পেয়ে বিলাপ করে জলে ঝাঁপ দেন। পাড়াপড়শি, ক্রমে গ্রামবাসী, জমায়েত হয় পুকুর পাড়ে এবং গ্রামের মানুষ জাল ফেলে, ডুব দিয়ে খোঁজে শিশিরকে।

শিশির তেমন ছোট নয়। এ বয়সে বাচ্চাদের সাঁতার শিখে যাওয়ার কথা কিন্তু বাবা-মা নিশ্চিত নয় যে তাদের সন্তান এখনই সাঁতার শিখে গেছে এবং এ বিষয়টা তাদের মুখ থেকে বিলাপ করতে করতে বলতে শোনা যায়। কেউ কেউ আশপাশেও খোঁজে, পায় না। গ্রামময় ডাকাডাকি পড়ে, পায় না। শীতকালের জলে, বড় পুকুরের জলে, তা বলে অতটুকুও জল নেই সেখানে যে ডুবুরিরাও খুঁজে পাবে না। ডুবুরিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাড়ে আসে। দুপুরের দীর্ণতর শীতরোদ জনতার জটলাকে পাতলা করতে থাকে আর যার যার ঘরে ফিরে যাবার আগে শিশিরের বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে। তাদের অশ্রুও গাল-চিবুক ছাড়িয়ে কথা ভিজিয়ে দেয়। শীতের দুপুর বড় নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠার আগে শিশিরের চিৎকার শোনা যায়।

কালো মেঘ যেন কেটে কেটে ঢুকে যাচ্ছে শীতের ফাঁকে। এক পশলা রোদ উঠল কোথাও? বরফ নামবে, নাকি বসন্ত নামবে এই কালো পুকুরের পাড়ে। মাঠের শেষ দিকটা থেকে শিশির দৌড়ে আসছে প্রাণপণে আর কালো এক দল শেয়াল তাকে তাড়া করছে পেছন থেকে নির্ভীকভাবে। তারা ছায়া ছায়া দেখে, শিশিরের আবছায়া দেখে। তাকে দেখে দৌড়ে ছোটে সবাই। মনে হয় উড়ে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে মেঘ ও বসন্তের আগে।

তবে তারা পৌঁছায় ঠিকই, শিশিরকেও পায়, কিন্তু শিশিরের বয়স যেন বেড়ে গেছে। শেয়ালগুলো দৌড়ে পালাল ঠিকই, রেখে গেল শিশিরের আয়ু ক্ষয়ের ছাপ, তার ক্লান্তির চিহ্ন, তার কাতর চিহ্ন যেন জুড়ে আছে সমস্ত মুখমণ্ডলে।

বিশ ত্রিশ কানি জমি আগ থাকতেই শেয়ালগুলা উল্টা ছোটে এবং শিশির পড়ি কি মরি করে দৌড়ে এসে ভেঙে পড়ে স্বজনদের বুকে। বুক পাতলা হয় স্বজনদের ঠিকই। কিন্তু এই সন্তান, ছেলেকে চোখে চোখে রাখতে হবে।

ছেলেটা পানিতে পড়ার পর সাঁতার দিয়ে উঠতে পারে। এবং বাবা-মার ভয়ে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে পুকুরের পশ্চিম পাড় গলে মাঠের মধ্যে নেমে পড়ে। মাঠের বিস্তৃত স্যালা সরিষার উঁচু গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে দৌড়াতে থাকে পশ্চিম দিকে। যতটুকু গেলে তাকে আর না পাওয়া যায়, যতটুকু গেলে বাবা-মায়ের কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়া যায় ততটুকু দৌড়ে পালায় শেষে। সেখান থেকে চোখ রাখে পাড়ের উপর। মায়ের ঝাঁপিয়ে পানিতে পড়া, আর গরুর গোয়ালে কাজ করা বাবার চিৎকার করতে করতে আসা- এতটুকু মোটামুটি স্বাভাবিক ভয়েই দেখছিল এবং ভেবেছিল একটু পরেই সে ফিরে যাবে ঘরে, যেমন তার বাবা-মাও কিছুটা খুঁজে ফিরবে। কিন্তু তারা তো ফেরে না। তাদের বিলাপে আরও লোকের ভিড় হয়। তখন সে লুকিয়ে শেয়ালের মতো আরও কিছুটা দৌড়ায়। সে ভয় পায়। ভাবে, এতগুলো মানুষের সামনে এখন সে কী করে যাবে? হয়তো মারবে তারা, হয়তো কটু কথা বলবে- এ ভাবনা তাকে আরও ভীত করে তোলে। তখন বাবা-মা তাকে ফিরে পাবার যে আনন্দ তার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে প্রতিবেশী সবার বিরক্তির ধিক্কার। এ ভাবনা তাকে এতটাই ভীত করে যে সে আর তারপর পেছনে ফিরে তাকায়নি। মাঠের প্রারম্ভিক মাঠ, সরিষায় ছেয়ে থাকা মাঠ সে হাঁটু মুড়ে দৌড়ায়, নিজেকে আড়াল করতে সরিষার শেষ সীমানায় পর্যন্ত দৌড়ায়। কিন্তু তারপর কোথা যাবে? এরপর তো বিস্তৃত মসুরি আর তিসির ক্ষেত, সেখানে গ্রামবাসী তাকে দেখে ফেলবে। তাই সে উত্তর দিকে হাঁটে, উত্তরে বিরাণপুর আর মজমাকান্দির মাজার, তারও উত্তরে পশ্চিমে হেলে আসা হায়দ্রাবাদ, আর সব শেষে সোজা পশ্চিমমুখী মজমা গ্রাম পশ্চিমকে ছুঁয়েই রেখেছে। সে দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রত্যেকটা গ্রামের প্রারম্ভিক অংশেই সরিষা ক্ষেত, তিরিশ চল্লিশ কানির সরিষার ক্ষেত, বিস্তৃত হলুদের উল্লাস হয়ে কদিন আগে পাতা ঝরিয়েছে শরীরের থেকে। তাই সে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে হাঁটে। নিজেকে আড়াল করার জন্য হাঁটে। নিজের গ্রামটা অতিক্রমের পরও সে দাঁড়াতে পারে না। আরও একটা গ্রাম পেরিয়ে সে ভুট্টার চাষ দেখে সরিষার পাশাপাশি। সে সেখানে লুকায়। একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ছোট্ট শরীর। ধকল তো আর কম গেছে না! এবার সে জিরোতে যায়। শরীরটাকে এলিয়ে দেয় ভুট্টা ক্ষেতের আড়ালে। কখন যে ঘুমিয়ে গেছে জানা নেই, ঘুম ভাঙলে সে আবার দৌড়াতে থাকে ভুট্টা ক্ষেতের আল দিয়ে এবং মজমা গ্রামের কাছাকাছি সে ফাঁড়ি পথ দিয়ে পশ্চিমের বলগ্রামে প্রবেশ করে।

বলগ্রামের প্রবেশ মুখে বাঘ, শিশিরকে জিজ্ঞেস করে, এ গাঁয়ে কেন? শিশির প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না। না বাঘ নয়, তার ছায়াটা দীর্ঘ হয়ে হাঁপাচ্ছে শণ পাতা, বুনো চ্যাপ্টা তরজা পাতার শক্ত সবুজে। শিশিরের চমক ভাঙে, তবে সে ভয় পায়। এখন সে ফিরবে কী করে? দুপুর হয়ে আসছে। বল গ্রামের কেউ কোথাও নেই এখন এদিকে। চাষিরা হয়তো ফিরে গেছে এতক্ষণে। নিজেকে লুকিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠময় কৃষককে সে কাজ করতে দেখেছে। কিন্তু কী কৌতূহলে না ভয়ের বিভ্রমে সে নিজেকে প্রকাশ্যে আনতে ভয় পায় এবং সে লুকিয়ে লুকিয়েই ছোটে। এমনিতে হিফজাপুর থেকে বলগ্রাম আসতে ঘণ্টা দেড়েক লেগে যায় বড়দের। ছেলেরা অবশ্য আরও আগে আগে আসে। বন্ধুদের সাথে আম কুড়াতে অদ্ভুত লোভ হলে দল বেঁধে বড়দের আগেই দৌড়ে আসতে পারে ওরা। আসতে আসতে মটর মসুরির ফুল  ছেঁড়ে তারা। এ ওর পিঠের পর ছুড়ে দেয় মাটির ঢেলা। হয়তো তারা আসেই না কোনো কোনো দিন, হয়তো মাঝ মাঠ থেকেই ফিরে গেছে দলবেঁধে ভয় পেয়ে। কিন্তু আজ শিশির আসে, শুধু আসেই না। সোজাসুজি না এসে তিন-চার গ্রাম ঘুরে এসেছে এ বিরান দুপুরে, শুধু তিন-চার গ্রাম ঘুরেছেই না, ঘুরেছে নিজেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ফসলের মাঠ ও কৃষকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে। এবং এ পর্যন্ত যে সে এসেছে, আসতে পেরেছে এ এক বিরাট গর্বের পুলক হয়ে তার ছোট্ট ছাতিকে ফুলিয়ে দেয়। তার ভয়টা ধপ করে কেটে যায়। সে বলগ্রামের শুরুতে জঙ্গলের ভেতর প্রবেশ করে। একটা লম্বা মরা ডাল কুড়িয়ে পেয়ে দুহাতে তার উপডালগুলো ছেটে তাকে দিয়ে তরজা গাছে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে। একটা অচেনা সাহস তার বুককে দুঃসাহস করে তোলে। সে দুহাতে পাগলের মতো আঘাত করতে থাকে তর্জার গাছে। তর্জার শক্ত সবুজ পাতাগুলো ভেঙে ছড়াতে থাকে। আর হঠাৎ করেই সেখান থেকে তিনখান শেয়াল, পর্যায়ক্রমে সাতখান শেয়াল এসে তাকে ঘিরে ধরে। তখন বিজয়ীর মতো বীরদর্পে সে শেয়ালদের বৃত্ত ভেঙে গ্রামের দিকে দৌড়াতে থাকে এবং দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় মনে হয় এবার সত্যি বুঝি সে ধরা পড়ে যাবে, এবার আর বুঝি সে পারে না।

তখনই গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করে আনে আর সোনার মানিককে বুকে নিয়ে শিশিরের বাবা-মা দক্ষিণের হাহাকার ভরা মাঠের শেষপ্রান্তে চোখ রাখে, যেখানে ম্লানসূর্যের আভামেখে দিগন্তে ছেয়ে আছে গমক্ষেতের শিস।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh