ফেলোশিপের অর্থের ‘ভাগ’ না দিলে রেজাল্ট আটকে দেওয়ার হুমকি

জাবি প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৩২ পিএম | আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৩৪ পিএম

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ। ছবি: জাবি প্রতিনিধি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ। ছবি: জাবি প্রতিনিধি

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ফেলোশিপের অর্থের ১০ শতাংশ বিভাগে জমা না দিলে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা ফলাফল আটকে দিবে এমন অভিযোগ উঠেছে পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এছাড়া ছাত্র সংসদের জন্য অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগ করেছেন একাধিক শিক্ষার্থী। এমনকি ফি না দিলে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ করেছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফেলোশিপ পাওয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, এনএসটি ফেলোশিপ আমাদের মেধার জন্য দেয়া হয়। আমরা নিজেরা কষ্ট করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে স্যাম্পল কালেক্ট করে, বাইরের ল্যাবে গবেষণা করে রিসার্চ করেছি। এক্ষেত্রে কোন কারণ ছাড়াই বিভাগ আমাদের থেকে ফেলোশিপের ১০ শতাংশ ভাগ চাচ্ছে। এই অর্থ পরিশোধ না করলে পরীক্ষা কমিটির সভাপতি আমাদের রেজাল্ট পাবলিশ না করার হুমকি দিয়েছেন। ফেলোশিপের টাকার ভাগ না দিলে তারা আমাদের রেজাল্ট দিবে না।

তিনি আরো বলেন, এর আগে আমাদের বিভাগ থেকে ফেলোশিপ প্রাপ্তদের ৭ শতাংশ টাকা কেটে নেয়া হতো। আমাদের ব্যাচ থেকে ১০ শতাংশ করে নেয়ার নোটিশ দিয়েছে। এর মধ্যে শুনলাম পরবর্তী ব্যাচগুলো থেকে ১৫ শতাংশ টাকা কেটে নেয়া হবে। পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ফেলোশিপের ১০ শতাংশ টাকা বিভাগে দেয়ার জন্য শ্রেণি প্রতিনিধির (সিআর) মাধ্যমে আমাদের জানিয়েছে। এই টাকা না দিলে রেজাল্ট পাবলিশ করবে না।

কিন্তু এই অর্থ কোন কাজে ব্যয় করা হয় জানতে চাইলে বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, এই টাকা কি কাজে ব্যয় করে আমরা জানি না। এর আগে অনেকবার শিক্ষকদের এই ‘অযৌক্তিক দাবির’ বিরুদ্ধে আমরা কথা বলেছিলাম, পার্সেন্টেজ কমানোর কথা বলা হয়েছিলো, কিন্তু তারা কর্ণপাত করেননি।

এনএসটি ফেলোশিপের ১০ শতাংশ টাকার বিষয়ে বিভাগের সাবেক সভাপতি সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তাজউদ্দিন সিকদার বলেন, ফেলোশিপ হতে রিসার্চ পারপাসে শিক্ষার্থীরা যে টাকা পেয়েছে তা ডিপার্টমেন্ট থেকে কেটে নেওয়া হচ্ছে না, বরং ডিপার্টমেন্টের ল্যাবরেটরিতে রিসার্চের জন্য যে ক্যামিকেলস ব্যাবহার করেছে, সার্ভে রিলেটেড কাজ করেছে, এক হাজার কোয়েশ্চেনিয়ার প্রিন্ট করেছে, কাগজ ব্যবহার করেছে, ফটোকপি ব্যাবহার করেছে এগুলোর তো একটা খরচ রয়েছে, তাই না? তো এইটা হিসেব করে দেখা গেছে খরচের পরিমাণ অনেক বেশি। এই খরচ যদি আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে নিতে চাই, তাহলে তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আমরা জেনারেলাইজ করেছি যেন, খরচ যা ই হোক তার সামান্য টোকেন মানি ল্যাবের জন্য দিয়ে যাবে। যাতে আমরা ল্যাবের আনুষঙ্গিক খরচ পুষিয়ে দিতে পারি। এক্ষেত্রে টাকা দেওয়া লাগবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই।

১০ শতাংশ টাকা না দিলে রেজাল্ট দেওয়া হবে না এই বিষয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা কমিটির এই সভাপতি বলেন, রেজাল্ট পাবলিশের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। এই টাকা না দিলে রেজাল্ট পাবলিশ হবে না, এরকম কিছু বলা হয়নি, এটা সম্পূর্ণ গুজব। এই টাকা যদি কেউ না ও দিতে চায় তাহলে আমাদের কিছু করার নেই।

আরেকটি বিষয় এই যে, যেহেতু এই নিয়ে কথা উঠেছে আমরা পরবর্তীতে ফেলোশিপ থেকে প্রাপ্ত টাকা যে রিসার্চ পারপাসে খরচ হচ্ছে কি না, এইটা মনিটরিং করব।

তবে ফেলোশিপ পাওয়া একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ৫-৬ জন ছাড়া ২১ জন ফেলোশিপ প্রাপ্তদের বাকি কেউই ডিপার্টমেন্ট থেকে কোয়েশ্চেনিয়ার প্রিন্ট, কাগজ ব্যবহার, ফটোকপি ব্যাবহার ও ল্যাব ব্যবহার করেনি। এক্ষেত্রে গণহারে ফেলোশিপ পাওয়া ২১ জনের থেকে ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৫ হাজার ছয়শত টাকা দাবি করাটা তাদের প্রতি অন্যায় বলে মনে করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায় অন্য কোন বিভাগ ফেলোশিপের টাকা থেকে আলাদা ফি চার্জ করে না।

ফেলোশিপের টাকা থেকে বিভাগের ফি কর্তন বিষয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ছালেহ আহমেদ খান বলেন, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপের বা যেকোনো ফেলোশিপের অর্থ থেকে আমাদের বিভাগ চার্জ করে না। ফেলোশিপের সম্পূর্ণ অর্থই শিক্ষার্থী তার গবেষণা কাজের জন্য ব্যয় করেন। আমাদের বিভাগে এর আগে কখনো ফেলোশিপের অর্থ নেয়া হয়নি, এরকম কোন নিয়ম আমাদের নেই। 

ল্যাবরেটরি কার্যক্রমের ব্যয় এবং এর অর্থের যোগান বিষয়ে তিনি বলেন, ল্যাবের কাজের অর্থের যোগান দুইভাবে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর ল্যাবের জন্য আলাদা করে অর্থ বরাদ্দ দেন। তাছাড়া আমাদের প্রতিটি ল্যাবে গবেষণা কার্যক্রম চলে। বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাইরের কোন প্রতিষ্ঠান আমাদের ল্যাব ব্যাবহার করলে তাদের থেকে ফি রাখা হয় যা পরবর্তীতে ল্যাব উন্নয়নকাজে ব্যয় করা হয়। ল্যাব ব্যবহারের জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের থেকে কোন চার্জ বা ফি নেয়া হয় না।

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক তাহমিনা ফেরদৌস বলেন, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপের টাকা যেসব শিক্ষার্থীরা নিয়ে আসে, তারা তাদের রিসার্চের জন্য খরচ করে। গবেষণা কাজে যে খরচ হয় সেই টাকাটাই মূলত শিক্ষার্থীদেরকে দেয়া হয়, এ টাকা কোন টিচারকে বা সুপারভাইজারকে দেয়া হয় না। এ টাকা শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য। এখানে কোন শিক্ষক কিংবা ডিপার্টমেন্ট শিক্ষার্থীদেরকে বাধ্য করতে পারে না যে এই টাকা ডিপার্টমেন্টের কাজে দেওয়া লাগবে। সর্বোচ্চ অনুরোধ করতে পারে ডিপার্টমেন্টে তোমরা কিছু বই দিতে পারো। কিন্তু ডিপার্টমেন্ট ওই শিক্ষার্থীকে বাধ্য করতে পারে না। 

তিনি আরো বলেন, স্কলারশিপ পাওয়া ওই নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীর পার্সোনাল প্রোপার্টি! এটা তো আর সবাই পায় না, এর জন্য কোয়ালিটি থাকা লাগে। সারা বাংলাদেশে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্দিষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি এই স্কলারশিপ পেয়ে থাকেন। যারা এই ফেলোশিপ পায় তারা ডিপার্টমেন্টে আবেদন করলে চেয়ারম্যানের একটা সিগনেচার লাগে। এছাড়া অন্য কোন কিছু আমাদের না। টাকা শিক্ষার্থীর একাউন্টে চলে আসে।

ছাত্র সংসদের জন্য আলাদা ফি নেয়ার বিষয়ে পাবলিক হেলথ ফোরামের সাবেক এক সহ-সভাপতি (ভিপি) বলেন, ছাত্র সংসদ বা আমাদের ফোরামের জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থী থেকে ৫০০ টাকা ফি নেওয়া হয়। বিভাগের নবীন বরণ, বিদায় কিংবা অন্যান্য সেমিনার প্রোগ্রামে এই ফান্ড থেকে অর্থ ব্যয় করা হয়।

তিনি আরো বলেন, এতদিন এই ফি স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের থেকে নেয়া হতো। কিন্তু গতবছর থেকে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীদের থেকে এই টাকা নেওয়া শুরু হয় বলে জানা যায়।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৪৫ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী জানান, আগে মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের এই ফি দেওয়া লাগতো না। কিন্তু আমাদের বেলায় তা চালু করা হয়। তৎকালীন বিভাগীয় সভাপতির সাথে কথা বলার পরও তিনি ফি মওকুফ করেননি৷ কয়েকজনের ফি দেওয়া বাকি ছিল তার জন্য পরীক্ষার হলে এসে তৎকালীন সভাপতি তাজউদ্দিন সিকদার বলেন, ‘এই ছেলেরা! স্টপ রাইটিং। তোমরা এখনো ফোরামের ফি জমা দাওনি কেন? এই ফি জমা না দিলে তোমাদের ভাইভা নেওয়া হবে না।’ পরে আমরা এই ফি দিতে বাধ্য হই। 

এ বিষয়ে বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ছাত্র সংসদের ফি পরিশোধ ব্যতীত পরীক্ষায় বসতে দেয়া হয় না। পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করার জন্য বিভাগের একাউন্টে সংসদের জন্য ফি জমা দিতে হয় তারপর বিভাগীয় সভাপতি রেজিস্ট্রেশন ফরমে স্বাক্ষর করেন।

ছাত্র সংসদের জন্য আলাদা ফির বিষয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র সংসদের সাবেক  সহ-সভাপতি (ভিপি) মুস্তাফিজুর রহমান সনেট বলেন, আমাদের বিভাগ থেকে ছাত্র সংসদের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে কোন ফি নেয়া হয় না। বিভাগের সকল অনুষ্ঠান বিভাগের অর্থে পরিচালিত হয়,  ছাত্র সংসদ শুধু অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্বে থাকে।

বাংলা বিভাগ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি মোস্তফা সারওয়ার বলেন, আমাদের বিভাগ থেকে এরকম কোন ফি নেয়া হয় না। বিভাগের সকল অনুষ্ঠান বিভাগের ফান্ড থেকে করা হয়। আমরা শুধু আয়োজনের দায়িত্বে থাকি, খরচের টাকা বিভাগ দেয়। 

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সভাপতি ড. মাহফুজা মোবারকের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

উল্লেখ্য, গত বছর পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের ২১ জন শিক্ষার্থী জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ পেয়েছে। এই ফেলোশিপের অধীনে গবেষণার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যেকে ৫৬ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh