শিমুল-পলাশের দিন

টুম্পা ধর

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৩২ এএম

শিমুল-পলাশ। ছবি: সংগৃহীত

শিমুল-পলাশ। ছবি: সংগৃহীত

‘এ নগরীর সমস্ত হৃৎপিণ্ড নিয়ে বছরে একবার পলাশ ফোটে’ ছোটবেলায় বারান্দায় দাঁড়ালেই প্রতি বিকেলে একটা তীব্র অথচ কোমল গন্ধ নাকে এসে মাতাল করে দিত। মনে হতো কেউ বোধহয় ভরপুর এলাচ দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে দুধ-চা ফোটাচ্ছে চুলায়। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়েও যেন কুলোনো যেত না। আজ মনে হয় মায়ের আঁচলে গিঠ দিয়ে তুলে আনি সেসব ঘ্রাণ।

ফেলে আসা শৈশবের সেই ঘ্রাণ যে চায়ের নয় ছাতিম ফুলের, তা জানতে সময় পার হয়ে গেছে বহু বছর। এখন এই ইটপাথরে ঠাসাঠাসি করা রাজধানীতেও শীত এলে ছাতিমের অস্তিত্ব টের পেতে আমার আর বেগ পেতে হয় না। তবে একটা সময় ছাতিমের দাপুটে আঘ্রাণ থেমে যায় ঋতুর আবর্তনে। তীব্র গন্ধ বাতাসে মিশে গিয়ে অন্য কোনো মুকুল আর কুড়ির মৃদু গন্ধের দিন আসে তারপর। এরই নাম ফাল্গুন। বসন্তের উদ্বোধন।

দুই

‘এতদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে

             দেখা পেলেম ফাল্গুনে/

আমাদের দু’জনার ছিল দুই শহরে বসবাস। মাঝে দূরত্ব ৯৮ কিলোমিটার। হতে পারতো না-এর গল্প, শেষ পর্যন্ত কোনো এক বসন্তের পূর্ণিমাতেই হ্যাঁ হয়ে গেছে। সেই দূরত্ব পেরিয়ে বসন্তের পূর্ণ চাঁদের নিচে বসে একদিন এই শহরেই মন্ত্রপাঠ হলো আমাদের যৌথ জীবনের। ফাল্গুন এভাবে জীবনের অংশ হয়ে গেল। 

আজকাল বসন্তে কোকিলের আনাগোনা অফিসের কাচ ঘেরা ঘরকে টপকাতে পারে না। কাজের হাঁসফাঁস অবস্থায় মাঝে মাঝে দৌড়ে যাই বাহিরদৃষ্টির দিকে। কাচের ওপারে মেহগনির কচকচে সবুজ কুঁড়ি আমাকে তাড়া করে। অথচ আমার একটা নিজস্ব গগন শিরিষ না থাকার যন্ত্রণা কতটা পীড়াদায়ক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এই সব বসন্ত দিনকালে হঠাৎ একদিন রমনার বকুলবীথিতে সদ্য পতিত তাজা বকুল কুড়িয়ে নিলে, এ জীবন কতটা সার্থকতা পায় তা মহাকাল জানে না। এই রমনায় বাদুড়ের সান্ধ্য টানেলের খোঁজ পাওয়া, সাথে স্যাকেইডা পোকার গাল-গল্পে কতটা সমৃদ্ধ হয়েছি তা আগত বসন্তই জানে। রাস্তার ধার ঘেঁষে বেড়ে ওঠা কাঠবাদামের হঠাৎ তীব্র রঙিন পাতা যেন নগরীর সমস্ত জ্যামকে স্বাগত চিৎকারে জানিয়ে দিচ্ছে নিজেকে রঙিন করে তোল, বসন্তে তুমিও অংশ নাও, বাসন্তী হয়ে ওঠো।  

বাংলা বটের ক্ষুদ্র পোকা ইউপ্রিস্টিনা নিশ্চয়ই জানে বসন্ত এসে গেছে। তাকে নতুন কাজে নামতে হবে। কত বাতাস, কত ফুল জানিয়েছিল এটাই সময়ের উপযুক্ত বিন্যাস। অথচ আমরা তো চেয়েছিলাম হাত ধরাধরি করে হারিয়ে যেতে। আর সেবার হারাতে গিয়েই আটকে গেলাম চারুকলায় বিছিয়ে থাকা পলাশের সমারোহে। এমন মোহনীয় রঙে একসাথে এত পলাশ আমি সেবারই প্রথম দেখলাম। আমি থমকে গেলাম যেন।

মনে হচ্ছিল যেন এক নদী পলাশে ডুবে আমি মরে গেলেও ক্ষতি নেই। তারপর পলাশ মাড়িয়ে শিমুলের লাল গালিচায় পা পড়ল। আমরা বসন্ত প্রলাপে চাওয়া না চাওয়া, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব টুকছি। এই বসন্ত, নগর, মানুষ, অনুভূতি, বিভেদ, কান্না, হাসির উপাখ্যান সব তোলা থাকুক। পলাশের সৌন্দর্য ব্যাখ্যার দায় স্বয়ং ঈশ্বরও না নিক।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh