নিজের তথ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ বিবিএস

হামিদ সরকার

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:৩৯ এএম

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর লোগো। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর লোগো। ছবি: সংগৃহীত

জীবন চালাতে দীর্ঘসময় ধরে মানুষের নাভিশ্বাস। হিমশিম খাচ্ছে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ। একদিকে বাড়ে পণ্যমূল্য, অন্যদিকে সরকার দফায় দফায় বাড়ায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম।

টালমাটাল এই পরিস্থিতিতে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানাচ্ছে, গত পাঁচ মাস যাবৎ পণ্যমূল্য কমছে বলেই মূল্যস্ফীতির ক্ষিপ্রতাও ক্রমশ কমে আসছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতি মাসেই মূল্যস্ফীতির তেজ নাকি কমছে।

কিন্তু বিবিএসের দেওয়া বাজারের মূল্যের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির চিত্র সাংঘর্ষিক। সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাজারে জিনিসপত্রের দামে তার কোনো স্বস্তি নেই। প্রতি সপ্তাহেই নতুন করে কোনো না কোনো পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। ক্যাবের জরিপ বলছে, রাজধানী ঢাকায় ২০২২ সালে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ ছিল খাদ্য-বহির্ভূত খাতে। খাবারে এটি ছিল ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ।

বিবিএস তথ্য বলছে, সার্বিকভাবে খাদ্য খাতে জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশে, যা গত ডিসেম্বর মাসে ছিল ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ।খাদ্য-বহির্ভূত খাতেও মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা ডিসেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। বিবিএস তার পরিসংখ্যানে বলছে, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাকজাতীয় পণ্যের দাম কমায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার কমেছে। পাশাপাশি কমেছে বাড়ি ভাড়া, আসবাবপত্র, গৃহস্থালি, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন ও শিক্ষা উপকরণের দামও।

জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি হয়েছে। এই মাসে গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে শহরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দমমিক ৩৯ শতাংশ। গ্রামে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি, ১০ দশমিক ১২ শতাংশ। আর গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। শহর এলাকায় জানুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত খাতে তা ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনা থেকে জানা গেছে, প্রতি কেজি নাজিরশাইল বা মিনিকেট চাল সেপ্টেম্বরে ৮২.০২ টাকা, অক্টোবরে ৮২.৩৪ টাকা, নভেম্বরে ৮২.৫১ টাকা, ডিসেম্বরে ৮২.৬৫ এবং জানুয়ারিতে ৮২.৮৭ টাকা। আর প্রতি কেজি পাজাম সেপ্টেম্বরে ৬৪.১৭ টাকা, অক্টোবরে ৬৪.৪১ টাকা, নভেম্বরে ৬৪.৬৭ টাকা, ডিসেম্বরে ৬৪.৮১ টাকা এবং জানুয়ারিতে ৬৪.৯৫ টাকায় বিক্রি হয়। ইরি বা বোরো চাল কেজি সেপ্টেম্বরে ৫৬.৯৫ টাকা, অক্টোবরে ৫৭.২৩ টাকা, নভেম্বরে ৫৮.৯৪ টাকা, ডিসেম্বরে ৫৮.৯৮ টাকা এবং জানুয়ারিতে ৫৯.৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

অন্যদিকে প্রতি কেজি গম (আটা) সেপ্টেম্বরের ৫৫.৪২ টাকা থেকে প্রতি মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ডিসেম্বরে ৬০.৩৩ টাকায় এবং জানুয়ারিতে ৬৮.৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডালের মধ্যে প্রতি কেজি মুগ ডাল সেপ্টেম্বরে ১৩২.৯২ টাকা বেড়ে বছর শেষে ডিসেম্বরে ১৩৫.৬৭ টাকায় এবং নতুন বছরে জানুয়ারিতে ১৩৫.৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি মসুর ডাল যেখানে সেপ্টেম্বরে ১৩৫.০৮ টাকা ছিল, সেটা প্রতি মাসেই বেড়ে ডিসেম্বরে ১৪০.৫৪ টাকায় এবং জানুয়ারিতে ১৪৪.৯৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে বিবিএসের বাজার তথ্য বলছে। 

চিনি (সাদা) প্রতি কেজি সেপ্টেম্বরের ৯৩.২৫ টাকা থেকে ডিসেম্বরে ১১৪.১০ টাকায় এবং জানুয়ারিতে ১২১.৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছের অবস্থাও একই ধারাতে রয়েছে। আর গরুর মাংস প্রতি কেজি সেপ্টেম্বরে ৭১২.৭১ টাকা থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৭২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খাসির মাংস প্রতি কেজি  ৯৪৮.৯৬ টাকা থেকে বেড়ে জানুয়ারিতে ৯৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডিম (মুরগি), খামার ৪ পিস ৪৯.৫৫ টাকা থেকে এখন একটু কমে ৪৩.২৫ টাকা; ডিম (হাঁস) ৪ পিস সেপ্টেম্বরে ৬৮.১৫ টাকা থেকে এখন জানুয়ারিতে ৬৫.৭৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা রয়েছেই। সরিষার তেল প্রতি লিটার সেপ্টেম্বরে ২৫০.৩৮ টাকা থেকে জানুয়ারিতে ২৫৮.৮৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সয়াবিন তেল প্রতি লিটার সেপ্টেম্বরে ১৮৭.৯৮ টাকা থেকে জানুয়ারিতে ১৯০ টাকা। লবণ (সূক্ষ্ন) প্রতি কেজি সেপ্টেম্বরে ৩৫.০৮ টাকা থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দুধ (মিল্ক ভিটা প্যাকেট) লিটার সেপ্টেম্বরে ৭৬.৪৬ টাকা থেকে জানুয়ারিতে ৮৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য গুঁড়ো দুধের দামেরও একই হাল। 

যেখানে প্রতি মাসেই মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বিবিএসের দেওয়া দরেই বৃদ্ধির দিকে সেখানে মূল্যস্ফীতির হার কীভাবে কমছে, এটাই প্রশ্ন। বিবিএস তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.১০ শতাংশ। যা অক্টোবরে কমে ৮.৯১ শতাংশ, নভেম্বরে ৮.৮৫ শতাংশ, ডিসেম্বরে কমে ৮.৭১ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে আরও কমে ৮.৫৭ শতাংশ বলে দাবি করছে। কিন্তু তাদের দেওয়া উল্লেখিত মাসের পণ্য দরের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হারের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। 

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বলেছে, জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির প্রভাবে পরিবহন ব্যয় ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায় প্রভাব পড়তে পারে। এর পাশাপাশি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও খাদ্যের দামে মূল্যস্ফীতির প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী করবে বলে প্রমাণ হয়েছে। শিগগির এই মূল্যের চাপ কমার সম্ভাবনা কম।

প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমের দাবি গত সেপ্টেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। তবে এটা প্রান্তিকভাবে কমছে, তবু কমছে। তিনি বলেন, পরিসংখ্যানের আস্থা হারানোর কোনো কারণ ও সুযোগ নেই। কারণ আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানের কোনো সূচকে আমরা পিছিয়ে নেই। বরং দেখাচ্ছে মাথাপিছু আয়ে ভারতকে আমরা পেছনে ফেলেছি। তবে তিনি স্বীকার করেন, একবার দ্রব্যমূল্য বাড়তে যে সময় লাগে, তা কমতে সময় দ্বিগুণ লাগে। 

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেশে মাথাপিছু আয় বাড়লেও নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়েনি। আয় বেড়েছে উচ্চবিত্তদের। করোনা মহামারিপরবর্তী অনেক মানুষের আয় কমেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে প্রভাব পড়েছে। দ্রব্যমূল্য একবার বাড়লে আর কমার আশা করা যায় না। মানুষের আয় যেন বাড়ে, কর্মসংস্থান যেন বাড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। 

তার মতে, আয় বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের আয় যাতে বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তা না হলে সংকট আরও বাড়বে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের ভোক্তাদের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে রক্ষা করতে সরকারকে শহরাঞ্চলে সামাজিক সুরক্ষা স্কিম বাড়ানো উচিত। বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাজার মনিটরিং বাড়ানো উচিত। সিন্ডিকেশন ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ক্যাব, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি গত ৪ মাস ধরে কমলেও এটি মধ্য ও নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীর ওপর প্রভাব ফেলছে। বাজারে সুশাসনের অভাবের কারণেই মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। তারা বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির ক্ষিপ্রতা আরও বাড়াবে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ আরও ভোগান্তিতে পড়বে। বিপিডিবি যদি দুর্ভোগ বাড়াতে না চায়, তবে তাদের কার্যদক্ষতা বাড়াতে হবে। দাম বাড়িয়ে লাভ হয় না, বরং কার্যদক্ষতা বাড়িয়ে হয়। 

বিবিএস মহাপরিচালক মো. মতিউর রহমানের দাবি বেশিরভাগ পণ্যের দর কমছে। তবে আইএমএফের সুপারিশ অনুযায়ী শিগগিরই আমরা মূল্যস্ফীতির বাস্কেটে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছি। ফলে এখানে অনেক কিছুই পরিবর্তন হবে। পাশাপাশি আমরা আগামীতে প্রতি তিন মাসে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশ করব। টিসিবির দেওয়া দরের সঙ্গে আমাদের তুলনা করলে হবে না। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh