মহাবিপর্যয়ে সিরিয়ায় মানবিক সংকট

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:৩৭ এএম | আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:৪১ এএম

প্রচণ্ড শীতের মধ্যে বহু মানুষকে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হচ্ছে। ছবি: বিবিসি

প্রচণ্ড শীতের মধ্যে বহু মানুষকে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হচ্ছে। ছবি: বিবিসি

প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব সময়ই নিয়ে আসে অকল্পনীয় যন্ত্রণা আর দুর্ভোগ, যার ছাপ থেকে যায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ৬ ফেব্রুয়ারি দিনটি হয়তো অনেকের কাছে সাধারণই ছিল। তবে তুরস্ক-সিরিয়ার লাখ লাখ মানুষের কাছে দিনটি হয়ে থাকল বিশেষ, শোকের। সেদিন ভোররাতে মানুষ যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আচমকা এক মহাশক্তিশালী ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয় তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গাজিয়ানটেপের কাছে।

রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে প্রতিবেশী সিরিয়া, লেবানন, ইসরাইল, ফিলিস্তিন ও সাইপ্রাসও। বেশ কিছু আফটারশকের পর এদিন দুপুরের দিকে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার আরও একটি ভূমিকম্প আঘাত করে। এর উৎপত্তিস্থল ছিল দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের কাহরামানমারাস প্রদেশের এলবিস্তান জেলা। 

ভূমিকম্পবিদরা তুরস্কের পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টকে অনেক আগেই খুব বিপজ্জনক বলে শনাক্ত করেছিলেন। দেশটির দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিম বরাবর এই ফল্টের অবস্থান। যদিও গত ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে উল্লেখ করার মতো কোনো সক্রিয়তা চোখে পড়েনি।

তবে তুরস্কের ইতিহাসে ভয়াবহ কয়েকটি ভূমিকম্পের জন্য দায়ী এই পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট। বিশেষ করে ১৮৮২ সালের ১৩ আগস্টের ভূমিকম্পের কথা উল্লেখ করা যায়। রিখটার স্কেলে সেই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৪; যা আজকের ভূকম্পনের চেয়ে সামান্য কম।

ওই সময়েও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান জানিয়েছেন, ১৯৩৯ সালের পর তুরস্কে এত তীব্র ভূমিকম্প আর কখনো হয়নি। ওই এর্জিঞ্জান ভূমিকম্পে প্রায় ৩৩ হাজার মানুষ নিহত এবং ১৯৯৯ সালের ইজমিত ভূমিকম্পে প্রাণ হারান ১৭ হাজারেরও বেশি মানুষ। 

ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় নিহতের সংখ্যা ২৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এখনো ধ্বংসস্ত‚পের নিচে চাপা পড়ে আছেন বহু মানুষ। তবে জীবিত উদ্ধারের আশা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ম্লান হয়ে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে, তীব্র শীত ও তুষারপাতের কারণে ‘পরিস্থিতি ক্রমেই নাজুক ও ভয়ঙ্কর’ হয়ে উঠতে থাকায় জীবিতদের মধ্যে যারা গৃহহীন ও আশ্রয়হীন অবস্থায় আছেন তারা দ্বিতীয় আরেকটি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারেন।

ডব্লিউএইচওর ব্যবস্থাপক রবার্ট হোল্ডেন বলেছেন, বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে ভয়াবহ অবস্থায় বসবাস করছে। আশ্রয়, পানি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় আছেন তারা। এ পরিস্থিতি আরেকটি বিপর্যয় ডেকে আনবে, যা ভূমিকম্পের চেয়ে আরও বেশি মানুষের ক্ষতি করবে। ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা ওই অঞ্চলে ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ।

ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্কের কাহরামানমারাস প্রদেশ পরিদর্শন করে এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ সহায়তা প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস। তিনি বলেছেন, এই দুর্যোগের মাত্রা এবং তা মোকাবিলায় যে তৎপরতা নেওয়া হয়েছে, সেটা নজিরবিহীন। আনুমানিক ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ এ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যথাযথভাবে মোকাবিলা করার জন্য তুরস্কের প্রস্তুতি তুলনামূলকভাবে ভালো। সাম্প্রতিককালে ইজমিরের ভূমিকম্প-পরবর্তী পুনর্বাসন প্রকল্পে তা দেখা গেছে; কিন্তু সীমানার ওপারে সিরিয়ার অবস্থা সত্যি বলতে অবর্ণনীয়। ১১ বছর ধরে অবিরাম যুদ্ধের আঘাত সয়ে আসা সিরীয়রা এই দুর্যোগ মোকাবিলা করার মতো অবস্থানে একেবারেই নেই।

এই মুহূর্তে সিরিয়া একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিকূল আবহাওয়া, বিধ্বস্ত দালান এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে হাসপাতালগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত। সেখানে জরুরি চিকিৎসা পরিস্থিতিও ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এই ভূমিকম্পে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদারতার সঙ্গে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে; কিন্তু তা সিরিয়া অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছাচ্ছে খুব সামান্যই। 

গৃহহারা মানুষের জন্য স্টেডিয়ামে তাঁবু খাটিয়েছে তুরস্কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সংস্থা। তীব্র শীতের মধ্যে এসব তাঁবুতে থাকা নিশ্চিতভাবেই কষ্টকর। তবে সিরিয়ায় ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এলাকায় না থাকছে তাঁবু, না পৌঁছাচ্ছে জরুরি ত্রাণ। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের সিরিয়া প্রতিনিধি শিভাঙ্কা ধনপাল বলেছেন, সিরিয়ায় সংকটের ভেতরেই আরেক বড় সংকট এসেছে। দেশটিতে ভূমিকম্পে আনুমানিক ৫৩ লাখ ৭০ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিনিধি সুহাইব আল-খালাফ সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে জানিয়েছেন, উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনো মরদেহ বের করার চেষ্টা করছেন। সিরিয়াজুড়ে অসংখ্য ভবন ধসে পড়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এসব ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের কথা মাথায় রাখা হয়নি বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

দীর্ঘদিনের যুদ্ধের কারণে স্থানীয় চিকিৎসাসেবা খাত আগে থেকেই বিপর্যস্ত। ভূমিকম্পের কারণে হাজার হাজার মানুষ আহত হওয়ায় এখন সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। লোকজনকে হাসপাতালের বারান্দায়, এমনকি পার্কিং এলাকায়ও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। 

উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কাজ করা বেসামরিক ত্রাণ সংস্থা হোয়াইট হেলমেটের প্রধান রায়েদ আল-সালেহ জাতিসংঘের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, ভূমিকম্পের পর জাতিসংঘের পদক্ষেপ ছিল খুবই বাজে। ভূমিকম্পের ১০০ ঘণ্টা পর ৯ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের প্রথম ত্রাণবাহী গাড়িবহর তুরস্ক থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ওই অঞ্চলে প্রবেশ করে।

তবে হোয়াইট হেলমেট বলছে, ওই রসদপত্র ভূমিকম্পের আগে সেখানে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল এবং উদ্ধার অভিযান চালানোর জন্য জরুরি রসদপত্র তাতে ছিল না। হোয়াইট হেলমেট দাবি করেছে যে ভূমিকম্পের পর সিরিয়া সরকার উত্তর সিরিয়ায় ‘কিছুই’ পাঠায়নি। 

এদিকে সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ভূমিকম্পদুর্গত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মানবিক ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে। ১০ ফেব্রুয়ারি বিবৃতিতে বলা হয়, সিরিয়ার সব অংশে মানবিক ত্রাণ সহায়তা প্রদানের অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ। জাতিসংঘের সহায়তায় আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি) এবং সিরিয়ার রেড ক্রিসেন্ট যেন ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম তদারকি করে।

এর প্রতিক্রিয়ায় আইসিআরসির আঞ্চলিক পরিচালক ফাব্রিজিও কারবোনি বলেন, ‘বেসামরিক লোকজনের দুর্ভোগ লাঘব করবে এমন যে কোনো পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই।’ এদিকে দুর্গতদের মাঝে সহায়তা পৌঁছাতে সিরিয়ায় ‘অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির’ আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান। 

উত্তর সিরিয়ার একটি হাসপাতালের কর্মরত ডাক্তার মোহাম্মদ হাসাউন জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের পর এখন তাদের কাছে যে চিকিৎসা সামগ্রী রয়েছে তা দেশের উত্তরাঞ্চলের ২০ শতাংশ মানুষের চাহিদাও পূরণ হবে না। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায়, যেখানে ৯০ শতাংশ মানুষ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে খাদ্যের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।

সিরিয়া ও তুরস্কের ভূমিকম্পদুর্গতদের জন্য ৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার সহায়তা চেয়েছে ডব্লিউএফপি। দুই দেশের ভূমিকম্পদুর্গত ৮ লাখ ৭৪ হাজার মানুষের জন্য রেশন ও রান্না করা খাবার সরবরাহে এই অর্থসহায়তা চাওয়া হয়েছে। বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানটির রোম সদর দপ্তর থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, জরুরি খাদ্য দরকার এমন ব্যক্তিদের মধ্যে সিরিয়ায় নতুন করে গৃহহারা ২ লাখ ৮৪ হাজার আর তুরস্কের ৫ লাখ ৯০ হাজার মানুষ রয়েছেন। তুরস্কের এই ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৫ হাজার শরণার্থী আর ৫ লাখ ৪৫ হাজার অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh