পাভেল পার্থ
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৪৬ পিএম
পাভেল পার্থ। ছবি: সংগৃহীত
বাংলায় এক বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘না খাইয়া কেউ মরে না, খাইয়া মরে।’ দেখা গেছে খাবার থেকেই সব বিপদ ও ঝুঁকি তৈরি হয়। বিশেষ করে খাবারের ধরন, খাদ্যগ্রহণের পদ্ধতি, খাদ্য সংরক্ষণ কিংবা প্রক্রিয়াজাতকরণ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
হোমো ইরেকটাস থেকে শুরু করে ডেনিসোভান, ফ্লোরিয়েনসিস কিংবা আজকের হোমো স্যাপিয়েন্স সকল মানবপ্রজাতির খাদ্যগ্রহণ এবং খাদ্যগ্রহণের ফলে তৈরি হওয়া ঝুঁকি সামাল দিতে হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। মানুষসহ সকল প্রাণপ্রজাতির খাদ্য আজ এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, ‘নিরাপদ খাদ্য’ নামে একটি প্রত্যয় আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। বিশেষ করে ‘বিষমুক্ত’, ‘পুষ্টিকর’, ‘রাসায়নিকমুক্ত’, ‘অর্গানিক’ এই রকমের নানাকিছু নিরাপদ খাদ্য বোঝাতে সামনে আসছে।
মানুষের খাদ্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার সঙ্গে শিল্পবিপ্লবের এক দারুণ যোগসূত্র আছে। শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে কারখানাভিত্তিক উৎপাদনের প্রসার ঘটেছে, গ্রাম থেকে নগরে রূপান্তর হয়েছে সমাজ। খাদ্য থেকে শুরু করে মানুষের সামাজিক অভ্যাস পরিবর্তিত হয়েছে। যত বেশি শিল্পায়ন আর নগরায়ণ ঘটেছে মানুষ তত বেশি তার খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে উদ্বাস্তু হয়েছে, বিযুক্ত হয়েছে।
প্রতিদিন ব্যস্ত মানুষের জন্য চোখের নিমিষে খাদ্যের রূপ ও ব্যবহার পাল্টে গেছে। খাদ্য আর প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর হিসেবে নেই, বহুজাতিক কোম্পানির ‘পণ্য’ হয়ে উঠেছে। আর তাই খাবারে কী মেশানো হচ্ছে কিংবা কোন ধরনের মোড়কে বন্দি হচ্ছে খাবার কিংবা এর উৎপাদন প্রক্রিয়া কোনোকিছু নিয়েই জানাবোঝার চেষ্টা মানুষ বহুদিন করেনি।
খাদ্যব্যবস্থার যাবতীয় দরবার হাতে গোনা কিছু কোম্পানির ওপর ছেড়ে দিয়ে মানুষ দিব্যি তার উন্নয়নকে লম্বা করেছে। আর এর ফল হয়েছে ভয়াবহ। প্রতিদিন প্রমাণ হচ্ছে কেবল কোম্পানির তৈরি নানাবিধ খাদ্যগ্রহণের ফলেই মানুষ আজ দুরারোগ্য ব্যাধি ও সংকটের মুখোমুখি।
দুই
আজ দেশে দেশে মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে, অভ্যস্ত হয়ে ওঠা নানা প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার ছেড়ে দিচ্ছে। কোম্পানিকে প্রশ্ন করছে, আইন ও নীতি তৈরি হচ্ছে। খাদ্য নামের বহু প্যাকেটজাত পণ্য বাতিল হয়েছে, নিষিদ্ধ হচ্ছে। কোক-পেপসিতে বিষ কিংবা নেসলের ম্যাগি নুডলসে সিসা পাওয়ার ঘটনা নাগরিক মনে আতঙ্ক তৈরি করেছিল।
মাছে ফরমালিন, ফলে কার্বাইড, মুড়িতে ইউরিয়া, গুড়ে কারখানার রং কিংবা পোল্ট্রি মুরগির মাংসে ব্যাপকমাত্রায় সিসা ও ক্যাডমিয়ামের মতো ভারী ধাতুর উপস্থিতি প্রমাণ হয়েছে। এসব বিষয় নানা সময়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নজরে এসেছে, কিছু বাতিল ও নিষিদ্ধ হয়েছে কিংবা এ নিয়ে একটা পাবলিক সাড়া লক্ষ করাও গেছে। কিন্তু খাবারে ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি নিয়ে এর ক্রেতা-ভোক্তা-ব্যবহারকারীদের খুব বেশি প্রতিক্রিয়া বা তৎপরতা তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা ২০২১’ প্রণয়ন করেছে। কিন্তু এখনো এই প্রবিধানমালার কোনো বাস্তবায়ন নেই। দেশজুড়ে দেদার খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাট ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে মানুষ অসুস্থ হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। নীরব ঘাতক হিসেবে মূলত আমাদের শহুরে জীবনের খাদ্যসংস্কৃতিতে মিশে আছে ট্রান্সফ্যাট।
কারণ কেক-পেস্ট্রি-বিস্কুটসহ বেকারি পণ্য কিংবা প্যাকেটজাত খাবার কিংবা রেস্টুরেন্ট ও হোটেলের খাবার সবখানেই ট্রান্সফ্যাটের বহুল ব্যবহার আছে। আর এসব খাবার বাদ দিয়ে আজ কোনো শহর চলতে পারছে কি? আজকের প্রজন্ম যারা তথাকথিত ফাস্টফুডে অভ্যস্ত হয়েছে তারা পিৎজা-বার্গার-ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এসব খাবার ছাড়া চলতে পারে কি?
২০১৮ সাল থেকে দেশে ২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস পালিত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের খাবার ভয়াবহ ট্রান্সফ্যাট মুক্ত হতে পারেনি। হয়তো কাজটি সহজ নয়; কারণ এর সঙ্গে উৎপাদন অর্থনীতি, বহু মানুষের কর্মসংস্থান, করপোরেট বাণিজ্য এবং খাদ্যরুচির পরিবর্তনসহ নানা কিছু জড়িত। কিন্তু ট্রান্সফ্যাটের বিপদ বুঝতে হবে উৎপাদনকারী, পরিবেশকারী, বিক্রেতা, ক্রেতা, ভোক্তা সবাইকেই।
শিশু থেকে নীতিনির্ধারক, প্রস্তুতকারী থেকে রাজনীতিক সবাইকেই। কারণ আমরা সকলেই নানাভাবে খাবারের ভেতর দিয়ে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ করছি। আশা করব খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের বিপদ ও ঝুঁকি বিষয়ে আমাদের সচেতনতা ও তৎপরতা বাড়বে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য বিভাগ, খাদ্য বিভাগ, সাংস্কৃতিক-সামাজিক ও পরিবেশ আন্দোলন সকলের সামষ্টিক ভূমিকা আছে।
তিন
ট্রান্সফ্যাট এক ধরনের চর্বি বা স্নেহ জাতীয় খাদ্য উপাদান যার অতিরিক্ত গ্রহণ রক্তে এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরল বাড়ায় এবং এইচডিএল বা ভালো কোলেস্টেরল কমায়। অতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ করলে বেশি খারাপ কোলেস্টেরল রক্তবাহী ধমনিতে জমা হয়ে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। প্রমাণ হয়েছে খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত অকাল মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।
বিশ্বে প্রতিবছর ট্রান্সফ্যাটঘটিত হৃদরোগে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মারা যায়। বিশ্বের যে পনেরোটি দেশে এই মৃত্যু বেশি ঘটে তার ভেতর বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালের ভেতর খাদ্য সরবরাহ থেকে ট্রান্সফ্যাট নির্মূলের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তারা বলছে, প্রতি ১০০ গ্রাম ফ্যাটে সর্বোচ্চ ২ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট সীমিত রাখা দরকার। সাধারণত প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার ও বেকারি পণ্যে ট্রান্সফ্যাট বেশি থাকে।
শিল্পে উৎপাদিত এই ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেট অয়েল (পিএচও) যা বাংলাদেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামে বেশি পরিচিত। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও ব্র্যান্ডসমূহের ২৪টি নমুনা বিশ্লেষণ করে ৯২ শতাংশ নমুনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত মানমাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট দেখতে পায়।
প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে, যেখানে মানমাত্রা ২ গ্রাম। উদ্ভিজ্জ তেল (সয়াবিন, পাম) যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আংশিক হাইড্রোজেনেশন করা হলে তরল অবস্থা থেকে মাখনের মতো অর্ধ-কঠিন মার্জারিন বা কঠিন ডালডা বা বনস্পতি উৎপন্ন হয়। গরু বা খাসির মাংস, দুধ, ঘি ও মাখনের মতো প্রাণিজ উৎসেও কিছু পরিমাণ ট্রান্সফ্যাট থাকে। গণমাধ্যমে ঢাকার একটি বেকারির হিসাব থেকে জানা যায়, ২০০ কেজি বিস্কুট তৈরিতে ১৩০ কেজি ময়দার সঙ্গে ৪০ কেজি ডালডা মেশানো হয়, বাকি ৩০ কেজি ডিম ও অন্যান্য উপকরণ।
চার
জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেম নরম্যান প্রথম তেলকে হাইড্রোজেনেটেড করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং ১৯০২ সালে এই পদ্ধতি পেটেন্ট করেন। পরবর্তী সময়ে এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হয়। ১৯০৯ সালে বহুজাতিক কোম্পানি প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল নরম্যানের পেটেন্ট কিনে নেয় এবং ১৯১১ সালে তারা প্রথম তুলা বীজ থেকে হাইড্রোজেনেটেড ‘ক্রিসকো’ বিক্রি শুরু করে। আর এভাবেই ট্রান্সফ্যাটের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী পারিবারিক রান্নাঘরেও পৌঁছে যায়।
ডালডা দিয়ে ভাজা মচমচে পরোটা কিংবা চিকেনফ্রাইয়ের কথা আমরা শৈশব স্মৃতি হিসেবেও মনে করতে পারি। শুনেছি এসব ডালডা নাকি একসময় রেশন হিসেবেও দেওয়া হতো। আজ অবশ্য আমাদের পারিবারিক ব্যক্তিগত রান্নাঘরে ডালডা বা বনস্পতি ঘির ব্যবহার খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু বেকারি ও রেস্টুরেন্টে এর বহুল ব্যবহার আছে। কিংবা আমরা বাইরে থেকে যেসব প্যাকেটজাত ও মোড়কজাত খাবার কিনে খাই সেসবেও আছে ট্রান্সফ্যাট।
পাঁচ
ট্রান্সফ্যাট নিষিদ্ধকরণে প্রণীত প্রবিধানের পাশাপাশি ভোক্তা সংরক্ষণ আইনও আমাদের জন্য জরুরি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের (২০০৯) ২৯ নম্বর ধারাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য সামগ্রী উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদির উপর বাধা-নিষেধ বিষয়ে।
ধারাটিতে উল্লেখ আছে, ...কোনো পণ্য মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর প্রমাণ হলে মহাপরিচালকের পরামর্শক্রমে সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা সমগ্র দেশে বা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় এরূপ পণ্যের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার বা প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত ওই সকল কার্যক্রম পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশ জারি করতে পারবে।
ট্রান্সফ্যাটের বিপদ ও ঝুঁকি বিষয়ে গণমাধ্যম বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষামূলক কর্মসূচি হতে পারে। তরুণ প্রজন্ম ট্রান্সফ্যাটবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে পারে। আমাদের চিকিৎসাকেন্দ্র, স্থানীয় সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা তৈরি করতে পারে।
পাশাপাশি ট্রান্সফ্যাট তদারকি, নিষিদ্ধকরণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাইয়ের জন্য নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও ভ্রাম্যমাণ আদালতকে সক্রিয় হতে হবে। ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা ২০২১’ ৪ নম্বর প্রবিধিতে খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রা প্রতি ১০০ গ্রামে সর্বোচ্চ ২ গ্রাম নির্ধারণ করেছে। পাশাপাশি উল্লেখ করেছে, এর চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট থাকলে সেসব খাদ্য বিক্রয়, বিতরণ, সংরক্ষণ, উপৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন এবং আমদানিসহ কোনোরূপ খাদ্য ব্যবসা করা যাবে না।
খাদ্যে ২ শতাংশের বেশি প্রাণিজ উৎসজাত ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড ব্যবহার করলে সংশ্লিষ্ট খাদ্য ব্যবসায়ীকে প্রমাণ হাজির করতে হবে। মোড়কজাত খাদ্যের লেবেলে বাধ্যতামূলকভাবে ‘খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালা ২০১৭’-এর ১৬ (১) নম্বর প্রবিধি অনুযায়ী ট্রান্সফ্যাটের তথ্য লিখতে হবে। আমরা আশা করব দ্রুত এই প্রবিধানমালা দোকান থেকে রেস্টুরেন্ট, বেকারি থেকে বাণিজ্যকারবার সর্বত্র কার্যকর ও বাস্তবায়ন হবে। ট্রান্সফ্যাট মুক্ত খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব শক্তিশালী জনআন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই।
গবেষক ও লেখক