আয়-ব্যয়ে ফারাক: বিপাকে শ্রমজীবীরা

এমএইচ রশিদ

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:২৩ এএম

মূল্যস্ফীতির তুলনায় বাড়েনি মজুরি। ছবি: সংগৃহীতি

মূল্যস্ফীতির তুলনায় বাড়েনি মজুরি। ছবি: সংগৃহীতি

করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ব্যবহার্য অনেক পণ্যের দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম। কিন্তু সেই তুলনায় আয় বাড়েনি। আয়-ব্যয়ের এই বিস্তর ফারাকে নাজেহাল তাদের দৈনন্দিন জীবন। নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাতে তারা ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনকি মধ্যবিত্ত পর্যায়ের মানুষেরা ব্যয় সামলাতে তাদের সামান্য সঞ্চয়ও ভাঙছেন এবং ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। 

সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত তিন মাসে বাজারে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্য বলছে, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে জানুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। মাসটিতে মজুরি সূচক বেড়েছে ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের জানুয়ারি মাসে কোনো পণ্য কিনতে যেখানে খরচ হতো ১০০ টাকা, সেখানে এ বছরের জানুয়ারিতে লেগেছে ১০৮ টাকা ৫৭ পয়সা।

অথচ মাসটিতে মজুরি বেড়েছে ৭ টাকার সামান্য বেশি। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকার কেনাকাটায় দেড় টাকা ব্যয়ের জোগানের ব্যবস্থা নেই একজন শ্রমিকের। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। জীবনযাত্রা সহনীয় রাখতে মূল্যস্ফীতি কমানো ও মজুরি বাড়াতে হবে এবং আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য থাকা আবশ্যক। তবে যতটুকু সামঞ্জস্য হয়েছে, তাতে স্বস্তি পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ।

কারণ যে হারে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, সে হারে বাড়েনি মজুরি। এ দুইয়ের মাঝে ব্যবধান এখনো অনেক বড়। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। ফলে আয়-ব্যয়ের এই ব্যবধান ঘোচাতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ।

মজুরি সূচক নির্ধারণে কম মজুরির দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের কর্মঘণ্টা কিংবা হাজিরাভিত্তিক দৈনিক আয়কে বিবেচনা করে থাকে বিবিএস। মাসিক কিংবা চুক্তিভিত্তিক আয় বিবিএসের মজুরির হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। মজুরির হার নির্ধারণে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের ৪৪টি পেশাকে বিবেচনা করা হয়।

বিবিএসের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, জানুয়ারির আগের দুই মাসে মজুরি বাড়ার চেয়ে বেশি হারে হয়েছে মূল্যস্ফীতি। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৯৮ এবং ৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। অন্যদিকে ওই দুই মাসের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ডিসেম্বরে ৮ দশমিক ৭১ এবং নভেম্বরে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, গত কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম। এ অবস্থায় মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। নিম্ন আয়ের মানুষ এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ খাদ্যপণ্যের পেছনেই তাদের আয়ের একটা বড় অংশ ব্যয় হয়। তাদের জন্য সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিও পর্যাপ্ত নয়। খাদ্যসহ পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় উন্নতি আনতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা বাড়িয়ে দরিদ্র মানুষকে স্বস্তি দেওয়া যায়। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্ককেও সমন্বয় আনা যেতে পারে।

বিবিএসের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, মৎস্যজীবী ও নির্মাণ শ্রমিকের অবস্থা বেশি খারাপ। জানুয়ারিতে এ দুই পেশার শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি যথাক্রমে ৪ দশমিক ৪৭ এবং ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ, যা সার্বিক মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। কৃষি শ্রমিকের মজুরিও সার্বিকের নিচে। তাদের মজুরি বেড়েছে ৭ শতাংশ। তুলনামূলক ভালো আছেন শিল্প ও সেবা খাতের শ্রমিকরা। এ দুই খাতের মজুরি বৃদ্ধি যথাক্রমে ৯ দশমিক ৩১ এবং ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ।

গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা ও অক্সফাম ইন বাংলাদেশের সহযোগিতায় পরিচালিত ‘সুনীতি’ (সিকিউরিং অব উইমেন ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স ইন বাংলাদেশ) প্রকল্পের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের গড় মাসিক আয় ৫ হাজার ৩১১ টাকা, যেখানে তাদের মাসিক গড় ব্যয় ১০ হাজার ৮০১ টাকা। ৯৬ শতাংশ গৃহকর্মী বলেছেন, তাদের বর্তমান মজুরি মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী সদস্য শাকিল আক্তার চৌধুরী বলেন, যাতায়াত, বাড়ি ভাড়া, খাদ্য কেনাসহ সব খাতেই নতুন করে খরচ বেড়েছে। সিলিন্ডারের গ্যাসের বাড়তি দামও শ্রমিকদের জন্য বড় বোঝা। অথচ মজুরি সে হারে বাড়েনি। কম আয় দিয়ে বাড়তি খরচ মেটানোর সামর্থ্য তাদের নেই। তাই সব ধরনের শ্রমজীবী মানুষের মজুরি বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ব্যাংকের গ্রাহকেরা সঞ্চয় কমিয়ে দিয়ে আগের সঞ্চয় তুলে নিচ্ছেন। এ জন্য ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বাড়ছে হু হু করে। ইতিহাসের দীর্ঘ সময় ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে মানুষ। গত এক বছরে ব্যাংক খাতের বাইরে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে ২৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুললেও ব্যাংকে নতুন করে তেমন একটা জমা করছেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে ব্যাংক খাতের বাইরে বা মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ১৮১ কোটি টাকায়, যা ২০২১ সাল শেষে ছিল ২ লাখ ১০ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৫৭ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। ২০২২ সালের নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে বেড়েছে ৬ দশমিক ০১ শতাংশ।

এদিকে ব্যাংক খাতে ২০২২ সালে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। গত বছর আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ১ শতাংশ। ফলে যে আমানত জমা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ঋণ যাচ্ছে। ২০২১ সাল শেষে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ২১ শতাংশ। আর ২০২০ সালে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। 

এ প্রসঙ্গে এবিবির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বৃদ্ধির কারণে মানুষের খরচ বেড়েছে। ফলে ব্যাংক থেকে মানুষ সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করছে। স্বল্প সময়ে ও সহজে এই সংকট কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ঠিক থাকলে ও নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক হলে ব্যাংকের আমানত আগের অবস্থানে ফিরবে। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh