একুশে বইমেলা

সংস্কৃতি চর্চার অন্য এক প্রেরণা

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:২৭ এএম

একুশের বইমেলা। ছবি: সংগৃহীত

একুশের বইমেলা। ছবি: সংগৃহীত

গ্রন্থের ইতিহাস প্রাচীন। মানুষ যখন থেকে ভাবতে শিখেছে, চিন্তা করতে শিখেছে এবং তার সেই নতুন ভাবনা ও চিন্তাকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রেরণা বোধ করেছে, তখন থেকেই তার একটি লিখিত রূপ খোদাই করে রাখার চেষ্টা তৈরি হয়েছিল মানুষের মধ্যে। সেই ধারাবাহিকতায়, হাজার বছর ধরে, মানুষ তার সৃষ্ট ভাবনার জগৎকে গ্রন্থের মধ্যে মুদ্রিত করে রাখছে।

গ্রন্থ তাই হয়ে উঠেছে কাগজের পৃষ্ঠায় মুদ্রিত অনন্ত এক মহাসমুদ্র। কিন্তু এই গ্রন্থকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন অতি সাম্প্রতিককালে। বহুকাল থেকে নানা রকম মেলার সঙ্গে আমরা পরিচিত। ধর্মীয় ও জাতিগত সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে নানা রকম মেলা প্রত্যেক ধর্মে, জাতিতে, সংস্কৃতিতে নিয়তই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু বইমেলার ধারণাটি একেবারেই অনন্য ও অধুনাতম।

বাংলাদেশের কথা বিবেচনা করলে স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে ষাটের দশক থেকে গ্রন্থমেলার একটি ধারণা ক্রমে ক্রমে দানা বাঁধতে থাকে। বলা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক গ্রন্থমেলা শুরু হয় ১৯৮৪ সাল থেকে, বাংলা একাডেমিকে কেন্দ্র করে এবং একুশের চেতনাকে আশ্রয় করে। এই মেলা এখন আমাদের জাতীয় জীবনের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই মেলাকে কেন্দ্র করে শুধু যে পাঠকের মধ্যে, লেখকের মধ্যে, সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে এবং প্রকাশকদের মধ্যে উৎসব তৈরি হয় তাই নয়, বরং ভেতরে ভেতরে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে একুশের বইমেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ।

একুশের বইমেলা মানেই হলো একটি অসাম্প্রদায়িক পরিমÐল। নানা ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশার ও নানা আদর্শের মানুষ বইমেলায় সমবেত হন। বিশাল মেলাপ্রাঙ্গণ ঘুরে বেড়ান। তারা বইয়ের স্টলে স্টলে ভিড় জমান, বইয়ের মলাট দেখেন, পাতা উলটিয়ে দু-এক পৃষ্ঠা পড়েন। তারা বই কেনেন অথবা না-কেনেন, কিন্তু চিন্তায় ও মননে একটি গ্রন্থগত ঐশ্বর্যের আভাস তারা নিশ্চয়ই উপভোগ করেন। আর তা হলো মুক্তি।

এক ধরনের বোধ তাদের মধ্যে জাগ্রত হয়। সেই বোধ জাতিগত চেতনার, জাতিগত সংস্কৃতির। গ্রন্থ পাঠের ভেতর দিয়েই যে মানুষের মুক্তি ঘটে তা নয়, গ্রন্থের পরিমণ্ডলের মধ্যে বিচরণ করার ভেতর দিয়েও মানুষের মন ও মননের শুদ্ধতম পরিবর্তন ঘটতে পারে। বাংলা একাডেমির বইমেলা এখন আমাদের চিন্তার শুদ্ধতম পরিবর্তনের মেলা হয়ে উঠেছে।

সেই ১৯৮৪ সালে যখন বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে এবং প্রকাশনা সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় আমাদের একুশের বইমেলার যাত্রারম্ভ হয়, তখন এর পরিধি ছিল খুবই সীমিত; স্টল সংখ্যা থেকে শুরু করে বইয়ের সংখ্যা, লেখক ও পাঠকের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। কিন্তু সেই ছোট্ট পরিসরের মধ্যেই আমরা এক ধরনের সমৃদ্ধ হওয়ার আনন্দ উদ্যাপন করতাম এবং সৃষ্টির প্রেরণা লাভ করতাম। তখন আক্ষরিক অর্থেই আমাদের একুশের বইমেলা ছিল আর ১০টি মেলার মতোই বৈচিত্র্যময়।

বাংলা একাডেমির ভেতরের প্রাঙ্গণে ছিল বইয়ের স্টল আর বাংলা একাডেমির বাইরে দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি ও চারুকলা পর্যন্ত লোকজ মেলার আয়োজন ছিল। রাস্তায় রাস্তায় ছিল পুরনো বই বিক্রির বিপুল সংগ্রহ। এমনকি বাংলা একাডেমির ভেতরে স্টলগুলোর মধ্যেও দেশ-বিদেশের বই রাখা হতো। সেই সময়ে পরিস্থিতি ছিল অনেক বেশি নিরাপদ, স্বতঃস্ফূর্ত ও সহজ-সুন্দর।

এখন অবশ্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিপুল প্রাঙ্গণে বইমেলা যে অবয়ব লাভ করেছে; যে বিস্তৃতি, বিপুলতা ও আধুনিকতা লাভ করেছে, তার সঙ্গে আশি ও নব্বই দশকের বইমেলার কোনো তুলনা চলে না।

সর্বগ্রাসী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্ময়কর উত্থানের এই সংকটাপূর্ণ সময়েও বইমেলা ক্রমেই বর্ধিত হচ্ছে, বিস্তৃত হচ্ছে, বিপুলতা লাভ করছে। তার মানে স্পষ্টতই অনুধাবন করা যায় যে, বইয়ের সংখ্যা ও তার মান যা-ই হোক না কেন, মানুষ বই লিখছেন, প্রকাশকরা বই প্রকাশ করছেন, পাঠকরা বই কিনছেন। বিপুল সংখ্যক পাঠক প্রতিনিয়ত বই কেনার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছেন।

অনলাইনে প্রচুর বই বিক্রি হচ্ছে। একুশে গ্রন্থমেলার এই যে বিপুলতা তা ক্রমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এখন দেখা যায়, জেলা শহরগুলোতে ও এমনকি উপজেলা শহরে পর্যন্ত ছোট আকারে বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে। কখনো কখনো স্কুল ও কলেজে বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে। দেশের নানা অঞ্চলে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক নানা রকম সংগঠন তৈরি হয়েছে।

ওইসব সংগঠনের তত্ত্বাবধানে দেশের নানা অঞ্চলে বিভিন্ন সময় বইমেলা হচ্ছে। সেসব বইমেলায় স্থানীয় প্রকাশনা সংস্থা থেকে শুরু করে ঢাকা শহরের কোনো কোনো প্রকাশনা সংস্থাও অংশগ্রহণ করছে এবং সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের এই বইমেলা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সুতরাং স্পষ্টতই অনুধাবন করা যায় যে, একুশের বইমেলা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির ও উৎসবের একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে।

বইমেলার এই সংস্কৃতি শুধু যে মেলাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে, তা কিন্তু নয়, অধিকন্তু রেডিও, টেলিভিশন থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও আমাদের এই বইমেলা ও গ্রন্থউৎসব বিপুল আলোড়ন তৈরি করছে। মেলা প্রাঙ্গণে ঢুকলেই দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চ্যানেলগুলো নানারকম সংবাদ ও তথ্যচিত্র প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে উঠছে। বইমেলাকেন্দ্রিক এই প্রচার সারা দেশের মানুষকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করছে।

যেসব ঘটনার সঙ্গে জাতিগত ঐক্য বিরাজমান থাকে এবং যেসব ঘটনা মানুষের জন্য মঙ্গল ও কল্যাণময়, সেসব ঘটনাই একসময় জাতীয় সংস্কৃতি ও উৎসবরূপে চরিত্র লাভ করে। আমাদের একুশের গ্রন্থমেলা এখন সেই রূপ পরিগ্রহ করেছে। শুধু বাংলা একাডেমিতে নয়, সারা দেশেই এখন ছড়িয়ে গেছে একুশের বইমেলা। আমাদের সংস্কৃতি চর্চার এই প্রেরণা থেকে আমরা একুশ শতকের সমৃদ্ধ ও আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh