অনির্বাচিত সরকার কারা, কেন চায়

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০২:১১ পিএম

আমীন আল রশীদ। ছবি: সংগৃহীত

আমীন আল রশীদ। ছবি: সংগৃহীত

একটি গোষ্ঠী আবারও দেশে অনির্বাচিত সরকার চাচ্ছে, এমন অভিযোগ তুলে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশে অনির্বাচিত সরকার কখনোই ফিরবে না।

যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে এমন সরকার আনতে চাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে জনগণকে সতর্ক ও সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অনির্বাচিত সরকারের স্বপ্ন যারা দেখছেন, সেই দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসবেন দয়া করে। এটা আর জীবনে হবে না।’ (৭১ টিভি, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।

এর আগেও তিনি একাধিকবার বলেছেন, দেশে আর কখনোই অনির্বাচিত সরকার আসবে না। প্রশ্ন হলো, অনির্বাচিত সরকার বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন এবং অতীতে কেন, কীভাবে, কাদের স্বার্থে বা প্রয়োজনে এ ধরনের সরকার এসেছিল? আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি কোন ধরনের সরকারের অধীনে হবে? নির্বাচিত বা দলীয় সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন হয়, সেটি কি বিগত দুটি নির্বাচনের মতোই হবে এবং সমালোচনার জন্ম দেবে? 

গত ৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একবার নয়, অনির্বাচিত সরকার আমরা দেখেছি বারবার। আমরা আন্দোলন করে কেয়ারটেকার সরকার এনেছিলাম। তার ফলাফল কী ছিল, সেটাও আমরা দেখেছিলাম।’ (বাংলা ট্রিবিউন, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। তার মানে প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন যে তাদের আন্দোলনের ফলেই ২০০৭ সালের অনির্বাচিত কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল। 

বাস্তবতা হলো, একটি অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল বলেই ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল। কেননা ওই নির্বাচনটি বিএনপি সরকারের অধীনে হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারত কিনা, সেটি বিরাট প্রশ্ন।

কারণ এর আগে যতবারই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে, সেখানে ক্ষমতাসীনরাই জয়ী হয়েছে এবং যতবার নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, সেখানে তত্ত্বাবধায়ক বা অনির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগে যে দল ক্ষমতায় ছিল তারা হেরে গেছে। যার বড় উদাহরণ ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন। কিন্তু এর পরের দুটি নির্বাচন হয়েছে নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে এবং দুটি নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, বিতর্কিত হয়েছে। তার মানে নির্দলীয় সরকারের অধীনেই তুলনামূলক কম বিতর্কিত এবং তুলনামূলকভাবে ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়, এটি প্রমাণিত- যা রাজনীতিবিদদের জন্য মোটেই সম্মানজনক নয়। 

নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে যে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে, অন্তত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেটি প্রমাণ করা যায়নি। স্থানীয় সরকারের অনেক নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনেও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। কারণ ওই সব নির্বাচনে জয়-পরাজয় রাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদল ঘটায় না বা সরকারের পরিবর্তন হয় না। যে কারণে দেখা যায়, যখন যে দল ক্ষমতার বাইরে থাকে তারা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে অনড় থাকে এবং যখন তারা ক্ষমতায় থাকে, তখন নির্দলীয় সরকারকে ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে এর বিপক্ষে দাঁড়ায়।

এই ইস্যুতে সবচেয়ে বড় কাজটি হয়েছে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়ে। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটিই বাতিল করা হয়েছে। অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবেই এখন আর নির্বাচনের আগে কোনো অনির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং তাদের অধীনে নির্বাচন হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের মূল লড়াইটা এখানেই। 

যে বিএনপি ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করেছে এবং পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয় বলে দাবি করেছে, তারাই এখন নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে অনড়। আবার ১৯৯৬ সালে যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্যান্য বিরোধী দলের লাগাতার আন্দোলনের ফসল হিসেবে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান চালু করা হয়েছিল, সেই দলটিই ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে ওই বিধানটি বাতিল করেছে।

যদিও এর আগে এই বিধানসংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দিয়েছেন উচ্চ আদালত। তখন সরকার বলেছিল, তারা হাইকোর্টের আদেশ মেনে এই বিধানটি বাতিল করেছে। ফলে যে কারণে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল হিসেবে ২০০৭ সালে ১/১১’র সরকার এসেছিল এবং যে সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, সেই ধরনের অনির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধেই এখন আওয়ামী লীগের সুস্পষ্ট অবস্থান।

তার মানে একই ইস্যুতে ক্ষমতায় থাকাকালীন এবং ক্ষমতায় না থাকার সময় রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান পরস্পরবিরোধী। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে বা নির্বাচকালীন নিরপেক্ষ সরকার ইস্যুতে সাধারণ মানুষ কী চায়, তাদের ভাবনা কী- সেটি কি আমাদের রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখেন বা মানুষের ভাবনাটি কি তারা জানতে চান? 

এ মুহূর্তে বিএনপিকে এই প্রশ্ন করা হলে তারা বলবে দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে নির্দলীয় সরকার ছাড়া দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না। আর আওয়ামী লীগকে এই প্রশ্ন করা হলে তারা বলবে, দেশের মানুষ আর অনির্বাচিত সরকার চায় না। আসলেই কত শতাংশ মানুষ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার চায় আর কত শতাংশ মানুষ চায় না, সেটি রাষ্ট্রীয়ভাবে কখনো জানতেও চাওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে কখনো গণভোটও নেওয়া হয়নি। আবার এই ইস্যুতে দলীয় সরকারের অধীনে গণভোট হলেও তার ফল কী হবে- সেটিও আন্দাজ করা যায়। কারণ অতীতে বিভিন্ন সময়ে গণভোটের ফল কী হয়েছে, সেটি দেশবাসী জানে। তার মানে পুরো বিষয়টা নিয়ে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো আসলে নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার স্বার্থে নিজেদের মতো কথা বলে। কিন্তু আখেরে সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান হয় না। 

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারকে বলা হয় ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে অগণতান্ত্রিক বিধান’। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ক্ষমতার পালাবদলের প্রধান উপায় যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনটি যেহেতু দলীয় সরকারের অধীনে সম্ভব নয় বলে মনে করা হয়, সে কারণে নির্বাচনকালীন একটি অন্তর্বর্তী নিরপেক্ষ সরকার থাকলে তখন তাদের অধীনে মাঠ প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকতে পারে; তারা বিশেষ কোনো দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এরকম একটি অগণতান্ত্রিক বিধান একটি রাষ্ট্রে কত বছর ধরে চলবে? 

সহজ উত্তর হলো, যত দিন না প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হবে। কিন্তু সেই আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হতে কত দিন লাগবে? যদি আগামী নির্বাচন সামনে রেখেও সেই আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি না হয় এবং যদি বিগত দুটি নির্বাচনের মতো এবারও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, তাহলে সেই নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে কিনা? যদি নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে এর পরিণতি কী হবে? সেই পরিণতি নিয়ে কি রাজনৈতিক দলগুলো ভাবছে?

নাকি ক্ষমতায় যাওয়া এবং যেভাবেই হোক ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই মূল কথা? মাঝখান দিয়ে সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতাবলে যে জনগণই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক- সেই মালিকদের কথা বলা বা সেই মালিকদের মালিকানা নিশ্চিতের বিষয়টি যে ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে- তারই কী হবে? রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা কি আদৌ মনে করেন বা বিশ্বাস করেন যে, জনগণই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক?

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh