বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম

সংকটে জাপানের অর্থনীতি

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০২:৫৩ পিএম

অন্তত ১২ হাজার পণ্যের দাম বেড়েছে বা বাড়তে যাচ্ছে জাপানে। ছবি: সংগৃহীত

অন্তত ১২ হাজার পণ্যের দাম বেড়েছে বা বাড়তে যাচ্ছে জাপানে। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বজুড়ে জাপানের পণ্যের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। তবে দেশটি বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল দেশ। সম্প্রতি দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব আরও তীব্র হয়েছে। অন্তত ১২ হাজার পণ্যের দাম বেড়েছে বা বাড়তে যাচ্ছে।

করোনা ভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন কাঁচামালের ক্রমবর্ধমান ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বেড়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে মার্কিন ডলারের বিপরীতে জাপানি ইয়েনের দাম ওঠা-নামা।

অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে জাপান নিঃসন্দেহে ব্যয়বহুল। তবে কিছু বিষয়ে তারা অনেক দেশ থেকেই ভিন্ন। এখানকার শ্রম মজুরি নির্ধারণ করা হয় জীবনযাত্রার মান ও ব্যয়ের ওপর নির্ভর করে। এগুলো নির্ধারণ করা হয় মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন জরিপের নিরিখে এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে। আবার জাপানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করা হয় পূর্বঘোষণা দিয়ে।

তবে যতই পূর্বঘোষণা দেওয়া হোক, দেশটির অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তা নিশ্চিত করেই বলে দেওয়া যায়। মজুরি ও উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় জাপানি পণ্যের দাম অনেক বেশি। যে কারণে অনেকে বিদেশ থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি করছে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে ও পড়বে অর্থনীতিতে।

অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, জাপানে দাম বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে মোট ১২ হাজার ৫৪টি পণ্য। গড়ে এসব পণ্যের দাম বর্তমানের চেয়ে ১৬ শতাংশ বাড়তে পারে। গত বছরের তুলনায় ৩ শতাংশ বেশি বাড়ছে। গত বছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম চার মাসে মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ দ্বিগুণ। ২০২২ সালের প্রথম চার মাসে ৫ হাজার ৫৭৩ পণ্যের দাম বেড়েছিল।

এর বিপরীতে শুধু জানুয়ারি মাসেই হিমায়িত খাদ্য ও সামুদ্রিক খাদ্যের মোট ৫ হাজার ৪৬৩ পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। গত অক্টোবরে ৭ হাজার ৮০০টি পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছিল। মার্চে ২ হাজার ৭১৬টি খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কথা রয়েছে। এপ্রিলের দিকে বাড়বে ৩ হাজার ১৯২টি পণ্যের।

১০৫টি নিবন্ধিত ও ৯০টি অনিবন্ধিত খাদ্য ও পানীয় প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া ওই অর্থনৈতিক জরিপে আভাস দেওয়া হয়েছে, গ্রীষ্মের আগ পর্যন্ত প্রতি মাসেই দুই-তিন হাজার পণ্যের দাম বাড়তে থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতির দৌরাত্ম্যে বেড়ে যাবে বিদ্যুৎ ও অন্যান্য খরচও। ব্যাপক সংখ্যক পণ্য এর মধ্যেই রয়েছে মূল্যস্ফীতিতে। তেলের দাম বৃদ্ধির জন্য বেড়েছে আনুষঙ্গিক খরচ। গ্যাস ও বিদ্যুতের দামের বৃদ্ধির কারণে আগামী দিনে বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের খরচ। 

টেইকোকু ডেটা ব্যাংক লিমিটেডের জরিপ অনুসারে, গত বছর জাপানে ১০ হাজারের বেশি খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। গড়ে মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে ১০৫টি প্রধান খাদ্য নির্মাতা গত জুনের মধ্যে ৬ হাজার ২৮৫টি পণ্য এবং জুলাই থেকে বাকি ৪ হাজার ৫০৪টি পণ্যের দাম বাড়ায়। এসব পণ্যের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে জুনের শুরুতেই।

গত ৬ জানুয়ারি বিশ্বখ্যাত ফাস্ট ফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ডস জাপানে তাদের ৮০ ভাগ পণ্যের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। এই দাম কার্যকর হয় ১৬ জানুয়ারি থেকে। মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে তারা ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খরচ, ক্রমবর্ধমান শ্রম মূল্য বৃদ্ধি, পণ্য সরবরাহ ও জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং জাপানি মুদ্রা বিনিময়ের দ্রুত অস্থিতিশীলতাকে দায়ী করেছে।

এর আগে ম্যাকডোনাল্ডস জাপান সর্বশেষ ২০২২ সালের মার্চে প্রায় ২০ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে প্রায় ৬০ শতাংশ মূল্য বাড়িয়েছিল। ম্যাকডোনাল্ডসের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা শিক্ষার্থীদের ওপর যে প্রভাব ফেলবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা শিক্ষার্থীরাই ম্যাকডোনাল্ডসের সবচেয়ে বড় বাজার এবং তাদের হাত খরচের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

মূল্যস্ফীতির কারণে জাপানের সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রার খরচ কমিয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে দেশটির অর্থনীতিতে। গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে জাপানের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে মন্দার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আগে থেকেই মুদ্রাস্ফীতির চাপে রয়েছে জাপান।

বৈশ্বিক অর্থনীতির শ্লথগতি, মূল্যস্ফীতির উচ্চহারের সঙ্গে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা ইয়েনের মান ৩২ বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে জাপানকে। সার্বিকভাবেই দেশটিতে জ্বালানি, খাবারের মতো নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে বেড়েছে জীবনযাপনের ব্যয়। আর এ অতিরিক্ত ব্যয়ের চাপ পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। 

চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ মন্দার কবলে পড়বে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা বলেন, গত বছরের চেয়ে চলতি বছরটি আরও কঠিন হবে। এমনকি যেসব দেশ মন্দার মুখোমুখি হয়নি, তারাও কয়েক লাখ মানুষের জন্য মন্দার সম্মুখীন হওয়ার মতো অনুভব করবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীনের অর্থনীতিতে মন্থর গতির কারণে এমনটা দেখা যাবে বলে ধারণা আইএমএফের।

জাপানের অর্থনীতি সংকুচিত হওয়া প্রসঙ্গে ইতোচু ইকোনমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ আতসুশি তাকেদা জানান, অর্থনীতির এ সংকোচন অপ্রত্যাশিত। এ পরিস্থিতির জন্য প্রত্যাশার অতিরিক্ত পণ্য আমদানিকে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বলে মনে করেন তিনি। এ ছাড়া মন্দার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বিশ্ব অর্থনীতি। এ অবস্থায় জাপানের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ আরও বেড়েছে।

এদিকে চলতি বছর জাপানের জন্য কঠিন হবে বলে আশঙ্কা করছেন ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ ড্যারেন তায়ে। তার মতে, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্থর গতি জাপানকে টেনে নেবে মৃদু মন্দার দিকে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশটির রপ্তানি ও ব্যবসা বিনিয়োগের ওপর।

অর্থনৈতিক সংকট জাপানের ডেমোগ্রাফি বা জনসংখ্যাতত্ত্বেও প্রভাব ফেলবে। আর এর দীর্ঘমেয়াদি বিপরীত প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। জাপানে আশঙ্কাজনকভাবে জন্মহার কমছে। বিষয়টি দুশ্চিন্তায় ফেলেছে দেশটির সরকারকে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ক্রমহ্রাসমান জন্মহার মোকাবিলায় বিভিন্ন জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে।

কয়েক বছর ধরেই জন্মহার বাড়াতে জনগণকে নানা উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে জাপান সরকার। জাপানের ইউওয়া পপুলেশন রিসার্চ অনুসারে, শিশু লালন-পালনের ক্ষেত্রে জাপান বিশ্বের তৃতীয় ব্যয়বহুল দেশ। এর শীর্ষে আছে চীন। এরপর দক্ষিণ কোরিয়া। এ দুটি দেশেও জনসংখ্যা কমছে। শিশু লালন-পালনে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকেই সন্তান নিতে চান না।

জাপানের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত বছর দেশটিতে জন্মহার কমে যাওয়ার নতুন রেকর্ড হয়। গত বছর সরকারের প্রত্যাশার চেয়েও আট লাখ কম শিশুর জন্ম হয়েছে দেশটিতে। এর আগে ২০১৫ সালে দেশটিতে জন্মহার কমে যাওয়ার রেকর্ড হয়েছিল। দেশটিতে ভবিষ্যতে আরও জন্মহার কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন সেখানকার মানুষের গড় বয়স দাঁড়িয়েছে ৪৯। 

ফুমিও কিশিদা চলতি বছরের শুরুতে পার্লামেন্টে জানান, আগামী জুনের মধ্যে শিশু পালনবিষয়ক বাজেট দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা জমা দেবেন তিনি। এপ্রিলে সমস্যাটির তদারক করার জন্য নতুন শিশু ও পরিবার সরকারি সংস্থা স্থাপন করা হবে। তবে অর্থনৈতিক সংকটে তা কতটা কার্যকর করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh