মাহমুদ সালেহীন খান
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৩, ০৩:৩৯ পিএম
বিপাশা হায়াত ও তৌকীর আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
বিপাশা-তৌকীর দেশের জনপ্রিয় তারকা জুটি। বিপাশা হায়াত একাধারে অভিনেত্রী, চিত্রশিল্পী, লেখক, আবৃত্তি শিল্পী, নাট্যকার। তৌকীর আহমেদ অভিনেতা ও নির্মাতা। নব্বইয়ের দশকে তৌকীর বিপাশার জুটি যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তা আজও রয়ে গেছে।
একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বন্ধুত্ব, ভালোলাগা সবকিছু ছাপিয়ে ১৯৯৯ সালের ২৩ জুলাই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। ২৩ বছরের দাম্পত্যজীবনে এক কন্যা ও এক পুত্রের বাবা-মা তারা। এবারের শিল্পী দম্পতি বিভাগে দেশকাল পত্রিকায় পাঠকদের জন্য তাদের কর্ম, ভাবনা ও দাম্পত্যজীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে লিখেছেন মাহমুদ সালেহীন খান
তুমি সেই তুলনাহীনা
অপলক আমার এ নয়ন
চেয়ে থাকে শুধু সারাক্ষণ
নব্বই দশকে শৈশব-কৈশোর পার করা প্রজন্ম ‘জনি প্রিন্ট শাড়ি’র এই বিজ্ঞাপনী জিঙ্গেলটি ভুলবে কি করে? বিজ্ঞাপনে যে মোহিনী মেয়েটি আয়নায় নিজেকে দেখেছিল, একটি সেতু পার হয়েছিল, শরবতের গ্লাস হাতে কপোলে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়েছিল সে-ই বিপাশা হায়াত।
রূপে-গুণে অনন্য তারকা। বিপাশা হায়াত একাধারে অভিনেত্রী, স্ক্রিপ্ট রাইটার, চিত্রশিল্পী, উপস্থাপক, সমাজকর্মী। জন্ম ২৩ মার্চ ১৯৭১, ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় পড়াশোনা। বাবা আবুল হায়াত, বোন নাতাশা হায়াত, স্বামী তৌকীর আহমেদ, ছেলেমেয়ে আরিব ও আরিশা, বোনজামাই শাহেদ শরীফ খান। সাংস্কৃতিক পরিবারেই তার বিচরণ।
প্রতিভার সঠিক পরিচর্যা খুব কম মানুষই করতে পারে। সফলতা পাবার জন্য শুধু প্রতিভা থাকলেই হয় না, সেটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে জানতে হয়। বিপাশা হায়াত এমন একজন প্রতিভার অধিকারী, যিনি তার ক্যারিয়ারের নানা সময়ে শিল্পের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিয়েছেন এবং মোটামুটি যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে।
সময়টা ১৯৮৩ সাল। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বিটিভিতে ‘খোলা দুয়ার’ শীর্ষক একটি নাটক প্রচারিত হবে। নাটকের রচয়িতা মামুনুর রশীদ, প্রযোজক ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। সেই নাটকে আবুল হায়াতের মেয়ের চরিত্রে ১২-১৩ বছরের একজনকে প্রয়োজন। হাতের কাছে পাওয়া গেল যে মেয়েকে তিনি সত্যিই আবুল হায়াতের মেয়ে। বিপাশা হায়াত।
টিভিতে বিপাশার প্রথম অভিনয় এই ‘খোলা দুয়ার’ নাটকেই ১৯৮৪ সালে। প্রথমবার জনপ্রিয়তা পান হুমায়ূন আহমেদের ‘অয়োময়’ নাটকের ‘লবঙ্গ’ চরিত্রের মাধ্যমে। এ চরিত্রের জনপ্রিয়তার পরে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
আবুল হায়াত ভাবতেন, তার মেয়ে হয়তো তার মতো ইঞ্জিনিয়ার হবেন। হয়তো সেটাই হতেন; কিন্তু ভাগ্য তার অন্যভাবে লেখা ছিল। সেজন্য বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার ওয়েটিং লিস্টে থাকার পর লিস্টে তার ঠিক আগেরজন সুযোগ পেলেও তিনি আর সুযোগ পাননি। পরবর্তীতে ইডেন কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানে তিন মাস পড়াশোনা করার পর এক পর্যায়ে আর্ট কলেজে পরীক্ষা দেন। সেখানে প্রথম হন বিপাশা। শুরু হয় তার শিল্পী হয়ে ওঠার জীবন।
ছোটবেলা থেকেই বিপাশার আগ্রহ ছিল সংস্কৃতি জগতের প্রতি। মঞ্চে তার যাত্রা শুরু ১৯৮৫ সালে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় দলে অভিনয় শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এক পর্যায়ে অভিনয়ের পাশাপাশি সেট ডিজাইনার হিসেবেও ছোটখাটো কাজ করতে থাকেন বিপাশা। এরই মধ্যে ১৯৮৯ সালে বিটিভিতে অভিনয় শিল্পী হিসেবে নিবন্ধিত হন তিনি। তবে বিপাশা দর্শকদের নজরে পড়েন হুমায়ূন আহমেদের ‘অয়োময়’ নাটকের ‘লবঙ্গ’ চরিত্রে অভিনয় করে।
বিপাশা অয়োময় প্রসঙ্গে বলেন, অয়োময় ছিল টিভি নাটকের একটি মাইলফলক। এই নাটকে লবঙ্গ মুখ্য আরও দশটি চরিত্রের মধ্যে একটি। নাটকের সব কয়টি চরিত্রই জাগতিক ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত; কিন্তু লবঙ্গ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। স্বপ্নের মধ্যে বাস করে। খুব রোমান্টিক। এই ব্যাপারগুলো অন্য সব চরিত্র থেকে লবঙ্গকে আলাদা করেছিল।
তার মধ্যে যে রোমান্টিকতা ছিল, তা ছুঁয়ে গিয়েছিল ওই সময়ের দর্শকের হৃদয়। আমার অভিনয় জীবনের একেবারে শুরুর দিকে এই একটি মাত্র চরিত্র আমাকে দর্শকের সামনে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে। দর্শকের হৃদয়ে আমার অবস্থান দৃঢ় হয়। লবঙ্গ বদলে দিয়েছিল আমাকে।
এরপরেই ধীরে ধীরে শুরু হয় তার সফলতার পথে এগিয়ে চলা। টিভি অভিনেত্রী হিসেবে বিপাশা তার প্রজন্মের প্রথম সারিতেই ছিলেন। ‘৯০ এর দশকটা বিপাশা-শমী-মিমিতে বুঁদ ছিল বাংলাদেশের টিভি দর্শক। বিখ্যাত নাটকগুলোর মাঝে ‘রূপনগর’, ‘হারজিত’, ‘একজন অপরাধিনী’, ‘নাইওরি’, ‘ছোট ছোট ঢেউ’, ‘প্রত্যাশা’, ‘দোলা’, ‘হাসুলি’ ইত্যদি উল্লেখযোগ্য।
সেই সময়টাতে ‘তৌকীর-বিপাশা’ খুবই জনপ্রিয় ছিল দর্শকদের কাছে। বাংলাদেশের প্রথম প্যাকেজ নাটকের নায়িকা ছিলেন বিপাশা হায়াত। কাজী আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত চরিত্র ‘মাসুদ রানা’ অবলম্বনে সেই নাটকের নাম ছিল ‘প্রাচীর পেরিয়ে’।
ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসজীবন বেছে নিয়েছেন জনপ্রিয় শিল্পী জুটি বিপাশা-তৌকীর। অভিনয় কমিয়ে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসেন বিপাশা। তখন বিশেষ দিবস উপলক্ষে নাটকে অভিনয় করতে দেখা যায়। গত দু’বছরে করোনার সময়টিতে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে পুরো সময় যুক্তরাষ্ট্রেই ছিলেন। অভিনয়কে মিস করেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভিনয়টা সত্যি খুব ভালোবাসি; কিন্তু সব মিলিয়ে হয়ে উঠছে না।
তার মানে এই নয় যে অভিনয় করাটা মিস করি না। সব গুছিয়ে যদি করা সম্ভব হয় আবারও অভিনয় করব। তবে নিয়মিত করতে পারব কিনা জানি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু অভিনয় নয়, লিখতেও খুব ভালোবাসি; কিন্তু এখন ছবি নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য এতদিকে মন দিতে পারছি না।’
প্রবাসে বিপাশা হায়াত ছবি আঁকায় মন দিয়েছেন। কোভিডের সময় তিনি বেশ কিছু ছবি এঁকেছেন। একক চিত্র প্রদর্শনী করার ইচ্ছা তার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে এখন কাজে লাগাচ্ছেন তিনি। তবে চারুকলায় পড়াশুনাটাও একেবারেই ভালো লাগার জায়গা থেকে। তিনি হয়তো আগেই জানতেন, একদিন ছবি নিয়েই তার দিব্যি দিন কেটে যাবে।
তাই তো এত দর্শকের ভালোবাসা, তারকাখ্যাতি, অর্থ, সম্মানের হাতছানিকে পাশ কাটিয়ে বিপাশা প্রবাসে নিভৃতে ছবি এঁকে চলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অভিনয়ের মতো ছবি আঁকাটাও আমার ভালোবাসার জায়গা। কোনোটাকেই পেছনে ফেলতে পারি না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তা ও ভাবনার জগতে পরিবর্তন হয়। এই সময়ে এসে আমার কাছে সবচেয়ে উপভোগ্য মনে হচ্ছে আঁকার জগৎ।’
বিপাশা বিমূর্ত ছবি আঁকতেই বেশি পছন্দ করেন। অনেকে ভেবে থাকেন, যারা নিখুঁত করে কোনো পোট্রেট বা দৃশ্যকল্প আঁকতে পারেন না তারাই অ্যাবসট্রাক্ট ছবি আঁকেন। বিপাশাও বিষয়টি জানেন। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আসল বিষয় তা নয়। মূর্ত ছবি আঁকতে না পারলে বিমূর্ত ছবি আঁকা যায় না। আমি যেহেতু চারুকলায় পুরো পড়াশুনাটাই করেছি, সুতরাং আমাদের ছবি আঁকার পুরো প্রক্রিয়াটির থিওরি ও প্রাকটিক্যাল বিষয়গুলো শেখানো হয়েছে।
এরপর আমি বিমূর্ত ছবি আঁকাকে বেছে নিয়েছি।’ ছবিতে কী ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করেন, জানতে চাইলে বিপাশা বলেন, ‘আমি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে কাজ করি। এক্ষেত্রে জীবনকে দেখার অভিজ্ঞতা খুব কাজে লাগে। মানুষকে যত ভালোভাবে বোঝা যায় এ ধরনের ছবি তত নিবিড়ভাবে আঁকা যায়। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে আমি খুব উপভোগ করি।
তাই ঘর সংসার সামলে যখন নিজের স্টুডিওতে ঢুকি তখন আমাকে কেউ বিরক্ত করে না। এ জন্য তৌকীর ও সন্তানদের প্রতি আমার অনেক কৃতজ্ঞতা। আমি যখন ছবি আঁকার মধ্যে থাকি, তখন আমি যে একজন অভিনেত্রী, মা, মেয়ে বা স্ত্রী সেসব কথা ভুলে যাই।’
বিপাশা একক চিত্র প্রদর্শনী নিয়ে কাজ করছেন। এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘লকডাউনে তো বিদেশে আটকে পড়েছিলাম। আমেরিকায় ছিলাম একা অনেক দিন। সেই সময়ে ছবি আঁকার কাজটা বেশ এগিয়েছে। আমি এখন ইন্টারন্যাশনাল স্পেসে নিজের ছবি পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে কাজ করছি। আশা করছি, সব স্বাভাবিক হয়ে গেলে ছবি দিয়ে দারুণ কিছু কাজ সবাইকে উপহার দিতে পারব।
বিপাশা সিনেমা করার প্রস্তাব পেয়েছেন অনেক আগেই। এই কথা হয়তো অনেকেই জানেন যে, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার নায়ক চরিত্রের জন্য প্রথম পছন্দ ছিলেন তৌকীর আহমেদ; কিন্তু এটি হয়তো অনেকেই জানেন না যে, সেই সিনেমার নায়িকার চরিত্রের জন্য প্রথম প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বিপাশা হায়াতকে; কিন্তু প্রথাগত চলচ্চিত্রে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। এমনকি মুম্বাই থেকেও তাকে সিনেমাতে নেবার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে জানা যায়; কিন্তু বিপাশা হায়াতের চরিত্র পছন্দ না হওয়ায় কিংবা অনাগ্রহের জন্য বিষয়টি আর এগোয়নি।
পরবর্তীতে বিপাশা হায়াত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রথম চলচ্চিত্র হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’। এই চলচ্চিত্রে তিনি ‘রাত্রি’ নামক এক তরুণীর চরিত্রে অভিনয় করেন, যার পরিবার যুদ্ধের সময় ঢাকা শহরের একটি বাসায় আটকে যায়। যুদ্ধের সময় গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা বদি চরিত্রের আসাদুজ্জামান নূর তাদের বাসায় আসে, সেখান থেকে এগোয় পরিবারটির কাহিনী। এই সিনেমার জন্য ১৯৯৪ সালে বিপাশা হায়াত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে।
পরবর্তীতে বিপাশা তৌকীর আহমেদ পরিচালিত জয়যাত্রা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই সিনেমাটিও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছিল। এখানে তিনি এক মধ্যবয়স্ক নারীর ভূমিকায় অভিনয় করেন, যেখানে পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণে পালিয়ে যাওয়ার সময় সন্তানকে হারিয়ে ফেলেন। দুটি সিনেমাতেই বিপাশা দর্শক আর সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন দারুণভাবে, যা খুব কম অভিনয়শিল্পীর পক্ষেই অর্জন সম্ভব।
বিপাশা হায়াত ১৯৯৮ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে এমএফএ পাস করেন। অভিনয় নিয়ে ব্যস্ততা থাকলেও আঁকাআঁকিটা তিনি কখনো একেবারে ছেড়ে দেননি। ১৯৯৬ সালে গ্যালারি টোনে মিনিয়েচার পেইন্টিং এক্সিবিশন করেন। ১৯৯৮ সালে গ্রুপ এক্সিবিশন করেন হোটেল সোনারগাঁওয়ের ডিভাইন আর্ট গ্যালারিতে। ২০০১ সালে জয়নুল গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনী করেন ৯ জন তরুণ শিল্পীর সঙ্গে।
এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও ইতালিয়ান রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতেও অংশ নেন তিনি। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও অরনীর আয়োজনে ২০১০ ও ২০১১ সালের দুটি আর্ট ক্যাম্পেও অংশ নেন বিপাশা।
বিপাশা হায়াতের নিজের ভাষায়, তিনি আঁকার কাজটি করেন রাতের বেলায় যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন। আঁকাআঁকিই নিজের আবেগের জায়গা বলে ভাবেন তিনি। ২০০৯ সালের মে মাসে তিনি এসিড আক্রান্ত নারীদের সাহায্যার্থে আয়োজিত প্রদর্শনীতে নিজের আঁকা ছবি দান করেন। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত প্রদর্শনীতে সম্মাননা লাভ করেন। সেখানে ৫৪টি দেশের ২৯৮ জন চিত্রশিল্পী তাদের ৪৩৪টি ছবি প্রদর্শন করেছিলেন। বইমেলায় প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবেও সরব উপস্থিতি রয়েছে বিপাশার।
কেবল অভিনয় কিংবা ছবি আঁকা নয়। বিপাশা হায়াত লেখালেখির সঙ্গেও জড়িত। তার মনে টিভি নাটক লেখার ভাবনাটা আসে অনেক আগেই। ১৯৯৭ সালে তিনি ‘শুধু তোমাকে জানি’ নামের একটি সিরিয়াল লেখা শুরু করেন। তবে ইচ্ছে করেই তিনি তার নাম প্রকাশ করেননি তখন। ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন, যাতে কেবল তার নামের কারণে নাটকটি জনপ্রিয়তা না পায়; কিন্তু টেলিভিশনে প্রচারিত হবার পর যখন সিরিয়ালটি তুমুল জনপ্রিয় হয়, তখন বিপাশা হায়াত তার লেখক সত্তা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। ‘ভালোবাসা জেগে থাকে প্রাণে’, ‘ডাইনোসর’, ‘মরা জোছনা’, ‘মধ্যরাত ও ঝরা পাতার গল্প’, ‘ছায়া’, ‘এ কী খেলা’- এরকম প্রায় অর্ধশত জনপ্রিয় নাটকের রচয়িতা বিপাশা হায়াত।
গায়িকা হিসেবে বিপাশা অবশ্য খুব একটা পরিচিত নন। বিপাশা হায়াতের সংস্কৃতি চর্চার শুরুটা হয়েছিল মূলত গান দিয়েই। ওস্তাদ খালিদ হোসেন, আখতার সাদমানী কিংবা মিতা হকের মতো বরেণ্য সংগীতজ্ঞদের কাছে তার গানের হাতেখড়ি; কিন্তু একটি সময় এসে গানের ভুবনে তাকে আর সেভাবে পাওয়া যায়নি। শেষপর্যন্ত নিয়মিত হয়েছিলেন অভিনয়েই। গান প্রসঙ্গে বিপাশা জানান, গানের জন্য আমি না, আমার জন্য গান। গানকে কখনো আমলে নিয়ে আমি সাধনা করিনি, যতটা না অভিনয় আর আঁকাআঁকি নিয়ে করেছি। তবে এটা সত্য আমি প্রচুর গান শুনি।
তবে বিটিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময় তাকে গাইতে দেখা গিয়েছে। হানিফ সংকেতের ইত্যাদিতে গেয়েছিলেন ‘আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা’, আব্দুন নূর তুষারের শুভেচ্ছাতে গেয়েছিলেন ‘নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক’ এবং বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’। তিন বছর আগে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিশেষ বৈশাখী সংগীতানুষ্ঠানে গেয়েছেন ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া ‘আজি বাহাল করিয়া বাজান গো দোতরা সুন্দরী কমলা নাচে’ গানটি।
বিপাশা হায়াত এর আরও একটি গুণ রয়েছে যেটি হচ্ছে ভালো আবৃত্তি করেন তিনি। অনেক নাটকের আবহ সংগীতের কাজ নিজেই করেছেন। এগুলো ছাড়াও বাংলাভিশন চ্যানেলের হয়ে ‘বিপাশার অতিথি’ নামে একটি টক-শো উপস্থাপনা করেছেন তিনি, যেটি তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল।
বিপাশা হায়াতকে প্রশ্ন করেছিলাম, এতগুলো সত্তার মাঝে কোন পরিচয়টি দিতে আপনি আনন্দ বোধ করেন। উত্তরে তিনি জানালেন, অনেকেই আমাকে অভিনয় শিল্পী বলেন, অনেকে চিত্রশিল্পী, অনেকে স্ক্রিপ্ট রাইটার। তবে আমি নিজেকে আরিশা আর আরিবের মা পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। মাঝে মাঝেই ওদের স্কুলে আমাকে ফোন করতে হয়। ফোনে কখনো আমি বলি না যে আমি বিপাশা হায়াত বলছি, বলি আরিশা আর আরিব এর মা বলছি। ওদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য প্রবাসে স্থায়ী হলাম। সবার আগে আরিশা আর আরিব। তারপর অন্য কিছু।”
তৌকীর আহমেদের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে মঞ্চে কাজ করতে গিয়ে। তারা একে অপরের কাজের খবর রাখতেন এবং প্রশংসা করতেন। কাজ করতে করতেই একে অন্যের কাছাকাছি আসেন। একসময় টের পান, দু’জনেই কখন যেন ভালোবাসার ফাঁদে আটকা পড়ে গেছেন। বিষয়টি শুরুর দিকে কেউ কারও কাছে প্রকাশ করেননি। বেশ কিছুদিন পর দু’জন একসঙ্গেই জানান ভালোবাসার কথা। তারপর দুই পরিবারের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত হয় তাদের বহুল আলোচিত বিয়ে।
তৌকীর সম্পর্কে বিপাশা জানান, আমরা দু’জনেই নাট্যকেন্দ্রে কাজ করতাম। মঞ্চ ও টিভিতে আমাদের জুটি বেশ জনিপ্রয় হয়ে গিয়েছিল তখন। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হলো। তারপর হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার প্রতি সে অতিরিক্ত যত্ন নেওয়া শুরু করছে। কাজের ফাঁকে এক সঙ্গে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতাম। মজার বিষয় হলো, আমি বুঝেছি তৌকীর আমাকে ভালোবাসে।
সেও জানে আমি তাকে ভালোবাসি; কিন্তু এভাবে দু’বছর কেটে গেছে আমরা কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা জানাইনি। আমি অপেক্ষা করছিলাম তৌকীর আগে বলুক। বিপাশা আরও বললেন, আসলে পর্দার প্রেম আর বাস্তবের প্রেমের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আমাদের সময়কার প্রেমের মধ্যে আবেগ অনুভূতি ছিল। শ্রদ্ধা ছিল। এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমি এটা দেখি না। তারা হুট করে প্রেম করে, তাড়াহুড়া করে বিয়ে করে, আবার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। এখনকার প্রজন্ম খুবই অস্থির।
১৯৯৯-২০২২ এই দীর্ঘ সময়ে দাম্পত্যজীবন ধরে রাখার মূলমন্ত্র কী? বিপাশা বলেন, আমার সংসার জীবন ২২ বছরের। আমার বাবা মায়ের ৩৫ বছর। এই প্রশ্নের উত্তরটা তাদের দাম্পত্য জীবন থেকে নিতে হবে। একটু ব্যাখ্যা করে বলি। আমার বাবা পেশায় ইঞ্জিয়ার। পাশাপাশি অভিনেতা। বাবার বর্ণাঢ্য জীবনের পেছনে কিন্তু আমার মায়ের অবদান বেশি। আমার মা সাধারণ গৃহিণী; কিন্তু অসাধারণ মহিলা।
আমাদের দুই বোনকে যেভাবে যত্ন নিয়েছেন, অন্য আরও দশ মায়ের চেয়ে আলাদা। তবে আমাদের যে কোনো আবদারে বাবার কখনো না নেই। চাকরি থেকে অবসরের পরে বাবা দিনের পর দিন শুটিং নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। এখনো ব্যস্ত আছেন; কিন্তু যখন যেখানে শুটিং থেকেছে, বাবাকে দেখেছি এর মধ্যেই আমাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। কোনো দিন বিরক্ত প্রকাশ করতে দেখিনি। আশা করি আমার উত্তর পেয়ে গেছেন।
এটি তো আপনার বাবা-মায়ের উদাহরণ দিলেন, আপনার কাছে আরও একটু পরিষ্কারভাবে জানতে চাই।
হেসে বিপাশা বললেন, পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা, সম্মান, কাজের প্রতি শ্রদ্ধা, শেয়ারিং। আরও একটি বিষয় হচ্ছে সঙ্গীকে নিজের মধ্যে নতুনত্ব খোঁজার বাসনাটা জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা থাকতে হবে।
প্রেমের বিষয়টি কে উপস্থাপন করল? এ প্রশ্নের উত্তরে বিপাশা বলেন, আমি প্রতিদিনই চাইতাম তৌকীর আমাকে কথাটি বলুক। এনটিভিতে একটি প্রজেক্টে হলো ক্লোজআপ ওয়ান কাছে আসার গল্প। এই প্রজেক্টে কাজ করার সময় একদিন দুপুরে তৌকীর প্রথম বলল, তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমি উত্তরে বললাম প্রেম না করে সরাসরি বিয়ের কথা বললে? সে স্বাভাবিক হেসে বলল, প্রেমে লস বিয়েতে লস নাই। আমি বাসায় জানালাম। ওর বাবা মা প্রস্তাব দিল। তৌকীরকে বাসার সবাই পছন্দ করত। ভালো অভিনেতা। বন্ধু হিসেবে বাসায় আসা যাওয়া ছিল তার। ব্যস বিয়ে করলাম এবং এখনো আছি একসঙ্গে।
বিপাশা হায়াতের কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা হলো একে অন্যের প্রতি নির্ভরতা, পারস্পরিক বিশ্বাস আর সহমর্মিতা। পৃথিবীতে ভালোবাসা হলো সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের সাধ্য আমার নেই।
স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনা করলেও অভিনয় ও নির্মাণের স্বপ্ন ছিল তৌকীরের হৃদয়ের গহীনে। তাই নিজেকে তিনি ছাত্রাবস্থাতেই তৈরি করেছিলেন মঞ্চে। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে পড়াকালীন তিনি মঞ্চ নাটকে অভিনয় শুরু করেন। এরপর ১৯৯৫ সালে লন্ডনের রয়্যাল কোর্ট থিয়েটার থেকে মঞ্চ নাটক পরিচালনার প্রশিক্ষণ নেন এবং ২০০২ সালে নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমি থেকে চলচ্চিত্রে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন।
তিন দশক ধরে অভিনয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছেন নন্দিত অভিনেতা তৌকীর আহমেদ। মঞ্চে অভিনয়ের পাশাপাশি টেলিভিশনে হয়েছেন প্রশংসিত। শুধু তাই নয়, অভিনয়ের বাইরে গত এক দশক ধরে নির্মাতা হিসেবেও দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানা। সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া ‘ফাগুন হাওয়ায়’ সিনেমা দিয়ে দর্শকদের রাঙিয়েছেন তিনি।
তৌকীর আহমেদ আশির দশকের মাঝামাঝিতে বিটিভিতে প্রচারিত নাটকসমূহের রোমান্টিক চরিত্রের শীর্ষ অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক ‘নদীর নাম মধুমতী’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। একই বছর তিনি তার শ্বশুর আবুল হায়াত পরিচালিত প্রথম নাটক ‘হারজিত’-এ অভিনয় করেন। এতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন স্ত্রী বিপাশা হায়াত।
২০০০ সালের পরপর অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি নাট্য ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে ২০০৪ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘জয়যাত্রা’ পরিচালনার মাধ্যমে। চলচ্চিত্রটি আমজাদ হোসেন রচিত ‘একই’ নামের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। এই চলচ্চিত্র পরিচালনার মাধ্যমে তিনি ২০০৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ প্রযোজক, শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে পুরস্কার অর্জন করেন।
২০০৬ সালে মুক্তি পায় তার চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় চলচ্চিত্র ‘রূপকথার গল্প’। চলচ্চিত্রটি ২০০৮ সালে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং দর্শকদের বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। ২০০৭ সালে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘দারুচিনি দ্বীপ’। রিয়াজ অভিনীত চলচ্চিত্রটি ২০০৮ সালে প্রদত্ত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সাতটি বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে। চলচ্চিত্রটি বালি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-এ প্রদর্শিত হয় এবং দর্শকদের বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।
বুয়েট থেকে স্থাপত্য বিষয়ে পড়াশোনা করে ট্র্যাক চেঞ্জ করে থিয়েটারে যুক্ত হলেন। এই প্রসঙ্গে তৌকীর জানান, আর্কিটেকচার তো ভীষণভাবে একটি শৈল্পিক বিষয়। ট্র্যাক চেঞ্জ করার কিছু ঘটে নাই। বরং ওই শিক্ষাটাই আমার অভিনয়ে, ফিল্মে বিভিন্নভাবে কাজে লাগে। কারণ স্থাপত্য এমন একটি বিষয় যেখানে আমাদের অনেক বিষয়ই শেখানো হয়। পৃথিবীতে বহু ফিল্মমেকার আছেন যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে আর্কিটেকচার। যেমন-সের্গেই আইজেনস্টাইন- সোভিয়েত চলচ্চিত্র পরিচালক এবং চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক, সার্বিয়ান কোস্তারিকা। বাংলাদেশেও এনামুল করিম নির্ঝর ও মসিহউদ্দিন শাকের রয়েছেন।
অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং লেখক-এই তিন সত্তার অধিকারী তৌকীর আহমেদ। কাজের প্রতি আন্তরিকতা আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ার তৃষ্ণা রয়েছে। তৌকীর এই প্রসঙ্গে বলেন, আমি ভালো ছবি নির্মাণ করতে চাই। আমি লেখার কিছু কাজ করছি। একই সঙ্গে আমি ভালো এবং বিশ্বমানের ছবি নির্মাণ করতে চাই। যে ছবি অন্য দেশে নিয়ে গেলে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল হয়। সে কাজটি যদি আমার হাত দিয়ে হতো তাহলে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করতাম। আমি বিশ্বাস করি, একজন নির্মাতার চিন্তা, চেতনা, দর্শন কিংবা ভাবনাবোধের জায়গাটা তার সৃষ্টিশীল কাজের কিংবা সিনেমার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন।
সিনেমা তো আপনার জীবিকা নির্বাহের একটি মাধ্যমও। আপনার সাথের যারা তারা তো অনেকেই বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণের দিকে ঝুঁকেছেন। আপনি সেদিকে না গিয়ে বলা চলে ঠিক তার বিপরীত পথে হেঁটেছেন। আমার কথার রেশ ধরেই তৌকীর জানালেন, আমার কাছে মনে হলো যে চলচ্চিত্র একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম, যে মাধ্যমটি সমাজে আসলে ভূমিকা রাখতে পারে, একটি দেশের ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারে। অর্থ তো নানানভাবেই উপার্জন করা যায়।
আমি এক সময় রিয়েল এস্টেট ব্যবসা করতাম, সেখানে অনেক অর্থ উপার্জন করা সম্ভব ছিল। আমি আর্কিটেকচার নিয়ে কাজ করতাম, কনসালটেন্সি করতাম। পরবর্তীতে ব্যবসা করেছি, সেখানে অর্থের অনেক হাতছানি ছিল। সেটা আসলে আমাকে খুব টানেনি। আমি জানি আমার প্রয়োজন সীমিত। সুতরাং আমার মন এবং মানসিকতা যেখানে টানে সে কাজটিই করতে চাই।
সে জায়গাটি অবশ্যই শিল্প। সে জন্যই আমি শিল্পের পথে হাঁটার চেষ্টা করেছি। শিল্পী হবার চেষ্টা করছি। তাই ওটা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই এবং আমার মনে হয় ঠিক সময়েই আমি সঠিক সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলাম। আর আমি যে সিদ্বান্ত নিতে পেরেছিলাম এজন্য নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়।
টেলিভিশন ও সিনেমার পার্থক্য প্রসঙ্গে তৌকীর জানান, টেলিভিশন এমন একটি মাধ্যম যেটিকে সবাই আসলে খুব সিরিয়াসলি দেখে না এবং দেখলেও ভুলে যায়। আমি টেলিভিশনে প্রচুর ভালো কাজ করেছি। নক্ষত্র চলচ্চিত্র নামে ইউটিউবে একটি চ্যানেল রয়েছে, সেখানে গেলে আমার অনেক কাজই দেখতে পাওয়া যাবে। সে কাজগুলো নতুন উপাদান ও ভাবনার বিষয়ও ছিল; কিন্তু যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করলাম, এটা তো বেশ সিরিয়াস বিষয়, দর্শকও বেশ সিরিয়াসলি নেয়। কারণ তারা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমাটি দেখেন মনোযোগ সহকারে। এর জন্য আলাদা একটি প্রস্তুতিও নিয়ে রাখেন। যে কারণে সেটি অনেকেরই চোখে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমার কাছে তখন সেটি নেট প্র্যাকটিসের মতোই বিষয় ছিল। তুমি যদি লক্ষ্য করো আমার ‘নাইওরি’, ‘উত্তর পুরুষ’, ‘গ্রহণকাল’, ‘সোনালি রোদের রং’, ‘বিহঙ্গকথা’ এগুলো পূর্নাঙ্গ চলচ্চিত্রের ভাষায় বানানো। অনেক বড় আয়োজন নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। সেটি অনেক টেলিভিশন দর্শক হয়তো বুঝতেই পারেননি। আবার অনেকেই হয়তো নোটিশ করেছেন। সেগুলো চলচ্চিত্রই বানিয়েছিলাম টেলিভিশন ক্যামেরা দিয়ে। আমাদের দেশে কিন্তু এই চর্চাটা আছে। কারণ অনেকে টিভি নির্মাতার স্বপ্ন থাকে ভবিষ্যতে ফিল্ম বানানো। তাই অনুশীলনের অংশ হিসেবে আমি টেলিভিশনটাকে কাজে লাগিয়েছি।
অনেকেই বলে থাকেন, বাংলাদেশে ফিল্ম নিয়ে তাত্ত্বিকভাবে পড়াশোনা করার জায়গাটা ছোট, এর কারণটা আসলে কী, কিন্তু আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসও তো দীর্ঘদিনের। তৌকীর সাবলিলভাবে বললেন, এটা তো নির্ভর করে একটি দেশের রাষ্ট্রীয় পলিসি কী, পরিকল্পনা কী সেটার ওপরে। আমাদের এখানে যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়েছে পাশাপাশি তখনই যদি প্রাতিষ্ঠানিক চলচ্চিত্র শিক্ষার ব্যবস্থাটাও করা যেত, তাহলে হয়তো আমরা এগিয়ে যেতাম। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ফিল্ম অব ড্রামা অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আর আমাদের এখানে একটি ইন্ডাস্ট্রি হলো কিন্তু সেখানে ষাটের দশকেই যদি একটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারতাম, তাহলে অনেক সুবিধাই হতো। না হওয়াতে যেটা হয়েছে, ইন্ডাস্ট্রিকে ফিট করার জন্য একটি ভ্যাকিউম হয়ে গিয়েছে। অনেক অযোগ্যও তৈরি না হয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করেছেন। যারা পরবর্তীতে বাংলা ছবির এ দুরাবস্থার জন্য দায়ী বলে আমি মনে করি।
বাংলা সিনেমার একটি বিষয়ের কথা বলেন, যার প্রয়োজনীয়তা আপনি এখন দারুণভাবে অনুভব করছেন? তৌকীরের ভাষ্যে নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে বলা যাবে না। একটির সঙ্গে অন্যটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দেশের বেশিরভাগ সিনেমা হলগুলোর অবকাঠামো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এটা ঠিক করা দরকার। একই সঙ্গে সিনেমার বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দরকার আছে। এটার বাণিজ্য কিংবা লগ্নিকৃত অর্থ জোগান দেওয়ার বিষয় রয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে চলচ্চিত্র নিয়ে আমাদের সার্বিকভাবে ভাবতে হবে। দর্শককেও মূল্যায়ন করতে হবে। ‘জয়যাত্রা’, ‘রূপকথার গল্প’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘হালদা’-আপনি এখন পর্যন্ত এ সিনেমাগুলো নির্মাণ করেছেন।
এর বিষয়বস্তুগুলোও গতানুগতিক ধারার বাইরে। অন্যদিকে দর্শকদের কথা যদি বলি, সেখানেও নির্দিষ্ট সংখ্যক বলে, অনেকেই বলে থাকেন। ভিন্নমতও রয়েছে। তবে এ ধরনের সিনেমা নির্মাণে আপনার ফিলোসফিক্যাল জায়গাটা ঠিক কেমন জানতে চাওয়া হলে তৌকীর বলেন, প্রতিটি কাজের বড় একটি বিষয় হচ্ছে, সেটির অবজেকটিভ কী? মানে লক্ষ্য কিংবা উদ্দেশ্যটা কী? আমরা যদি লক্ষ্য করি, একদল নির্মাতা চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন বাণিজ্যের লক্ষ্যে। আরেক দল এর বাইরে গিয়ে। ঠিক এ ধারাটার আমি কাজ করতে চাই না। তবে আমি চাই, আমার ছবিটা যেন মৌলিক ছবি হয়। একই সঙ্গে চলচ্চিত্র একটি মাধ্যম হিসেবে সৃজনশীল কিছু যেন করে।
আর যেটিকে আমরা বাণিজ্যিক কিংবা মূল ধারা বলছি সেটাকে আমি মূল ধারা মনে করি না। আমি মনে করি মূল ধারা হচ্ছে যেখানে, চলচ্চিত্রের সৃজনশীলতা প্রকাশ পায়। মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের শক্তি যেখানে প্রকাশ পায় সেটিই হচ্ছে মূল ধারা; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি হয়তো আমাদের দেশে ততটা সফলতা পায়নি। এ ছাড়া এ দুটোর মধ্যে মাঝামাঝি জায়গায় বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা হয়েছে। আমার পূর্বসূরি অনেক মেধাবি মানুষজন সেটা করেছেন।
দর্শক আমার ছবি পছন্দ করে, এটা আমি জোর গলায় বলতেই পারি। সেটি ‘জয়যাত্রা’, ‘রূপ কথার গল্প’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, আর ‘অজ্ঞাতনামা’ যেটির কথাই বলেন; কিন্তু সব দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবিগুলো দেখতে পান নাই। কিংবা প্রেক্ষাগৃহের মালিকরা এটা নিতে চাননি। আবার যখন নিয়েছেন দর্শক ছবিগুলো দেখতে যাননি। যার কারণে নেওয়ার দু-তিন দিন পর আবার হল থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এখানে আমার কিছু করার নেই। শিল্পের দায় কিন্তু দু’জনেরই-নির্মাতা এবং দর্শকের। নির্মাতা যদি একটি ধারায় কাজ করতে চান, দর্শকদেরও সেখানে একটি ধারায় অংশগ্রহণ থাকা উচিত। তাদেরও দায়িত্ব থাকে। সেই জায়গাটা থেকেই বলব, আমাদের কাজেই মাধ্যমেই যদি দর্শকদের এগিয়ে নিয়ে আসতে পারি, আমরাও যদি আমাদের কাজকে আরও সুন্দর, মৌলিক কিংবা সৃজনশীল উপায়ে উপস্থাপন করতে পারি, তাহলে একটি পয়েন্টে এসে দুটি মেরু মিলবে। যদিও আমি জানি সেটা পৃথিবীতে এখনও হয়নি।
আমার সিনেমাগুলো বাণিজ্যিক দিকটার প্রসঙ্গ তুলে সিনেমাবোদ্ধারা অভিযোগ করে থাকেন। একটি সময় ছিল, যেটা হচ্ছে ইনডিপেন্ডেট ছবিগুলো মানে এফডিসির বাইরের ছবিগুলোকে পরিবেশকরা ততটা সমাদর করতেন না। এর দুটি কারণ হতে পারে- প্রথমত, এগুলোর মধ্যে যথেষ্ট বাণিজ্যিক ছবির মতো উপাদান নেই।
অথবা তারা চাইতেন না, এ ধরনের ছবি জনপ্রিয়তা লাভ করুক। সেখানে অনেকেরই স্বার্থ থাকতে পারে। আর আমরা দেখি যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি স্বার্থ কাজ করেই; কিন্তু আমরা মনে করি চলচ্চিত্রকে যদি টিকিয়ে রাখতে হয়, এরজন্য অগ্রগতি দরকার। এবং সেখান থেকে নতুন নির্মাতারা নতুন ভাবনা নিয়ে, সৃজনশীলতা নিয়ে হাজির হবেন, সেটাই আশা করি। আমরা নতুন কিছু শিখব।
আরেকটা দিক লক্ষ্য করার মতো, আমাদের দর্শকদের মধ্যেও কিন্তু অনেকগুলো ভাগ রয়েছে। কেননা, সমাজের যারা প্রান্তিক মানুষ তাদের শিল্পরুচি কিংবা দর্শন এক রকম। আবার যারা শিক্ষিত শ্রেণি তাদের এক ধরনের ভাবনা আছে। আবার যারা তরুণ বা উচ্চবিত্ত তাদের ভাবনাটা আলাদা। আবার একই ছবি সবার ভালো লাগবে এমনও কিন্তু কোনো কথা নেই; কিন্তু এটাও সত্যি কথা যা ভালো তা ভালোই; কিন্তু সমস্যাটা হয় যেখানে তারা বিশ্বাসের জায়গাটা রাখেন না। আবার অনেকেই আছেন যারা ফেসবুকে লিখেন, কিন্তু সিনেমা হলে যান না। সেটার আবার নানান কারণ রয়েছে।
সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে একটি বিষয়। সপরিবারে আমেরিকায় থিতু তৌকীর বিপাশা। করোনাভাইরাস শুরুর প্রথম থেকেই আমেরিকায় ছিলেন বিপাশা হায়াত। ছিলেন বলতে মূলত ফ্লাইট বন্ধ থাকায় দেশটিতে আটকেই ছিলেন তিনি। গুঞ্জন শুরু হয় করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর যখন তৌকীর আহমেদও আমেরিকায় পাড়ি দেন।
তখন থেকেই আলোচনায় আসে দুই সন্তানসহ মার্কিন মুলুকে স্থায়ী নিবাস করতে চলেছেন তৌকীর-বিপাশা দম্পতি। এ বিষয়টি নিয়ে খানিকটা বিরক্তিই প্রকাশ করলেন তৌকীর আহমেদ। জানালেন, বর্তমানে তিনি দেশেই রয়েছেন।
যেভাবে বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে মোটেও তা নয়। আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। তারা দু’জনই আমেরিকায় থেকে পড়াশোনা শুরু করছে। তাদের জন্যই বিপাশা ও আমি আমেরিকায় গিয়েছিলাম। ভালো স্কুল খুঁজে তাদের ভর্তির ব্যাপারে ঝামেলা শেষ করেছি। ছেলে ও মেয়ে সেখানে থাকবে, পড়াশোনা করবে। মা হিসেবে বিপাশাই বেশিরভাগ সময় তাদের সঙ্গে থাকবে। আমি যাব সময়-সুযোগ করে। ব্যাপারটি দেশ ছেড়ে দিয়ে চিরতরে আমেরিকায় চলে যাওয়ার মতো কিছু নয়।’
‘আমি ও বিপাশা এখনো শোবিজে নিয়মিত কাজ করি। বিপাশা অভিনয়টা করছে না হয়তো নিয়মিত; কিন্তু ও লিখছে। প্রায়ই নাটক লেখে। ছবি আঁকাতেও সে মনোযোগী। আর আমি তো নিয়মিতই নির্মাণ ও অভিনয় করছি। এই মুহূর্তে চ্যানেল আইতে আমার পরিচালিত একটি ধারাবাহিক প্রচার হচ্ছে। দেশ ছেড়ে গেলে সেটির কী হবে? তাছাড়া নতুন সিনেমা নির্মাণের কাজেও হাত দিয়েছি’- যোগ করেন তৌকীর আহমেদ।
বিপাশার কোন গুণটি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে। উত্তরে হেসে বললেন, ও খুব ভালো এবং গুণবতী মেয়ে। ওর জন্যই আজকে আমি তৌকীর হয়ে উঠতে পেরেছি। প্রথম দিন থেকে আজকে পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও তার প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ আমার কমেনি।
তৌকীরের কাছে ভালোবাসা হলো নির্ভেজাল সম্পর্কের বন্ধন। তিনি মনে করেন, ভালোবাসা আছে বলেই মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার প্রেরণা আছে। স্বপ্ন আছে। বিপাশা সবচেয়ে ভালো গুণ সম্পর্কে তিনি জানান, বিপাশা একজন ভালো মা। একজন ভালো স্ত্রী। তারমধ্যে কোনো অহংকার নেই। ঈর্ষা নেই। এমন সহধর্মিণী পাওয়া কিন্তু অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।