গরমকাল শুরু

বিদ্যুৎ কি এবারও ভোগাবে

শাহরিয়ার হোসাইন

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৩, ০৯:৩৪ এএম | আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৩, ১২:১৫ পিএম

লোডশেডিং। প্রতীকী ছবি

লোডশেডিং। প্রতীকী ছবি

গত বছর গরমে ভয়াবহ সংকটে পড়েছিল বিদ্যুৎ খাত। লোডশেডিংয়ে দুর্বিষহ ভোগান্তি নেমেছিল জনজীবনে। শীত আসার পর বিদ্যুতের চাহিদা কমে প্রাকৃতিকভাবেই সংকটের আপাত সমাধান হয়েছিল। 

শীত বিদায় নিয়ে ফের এসেছে গরমকাল। গত বছরের মতো এবারও কি ভোগাবে বিদ্যুৎ- এ প্রশ্ন উঠেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে বলে সরকারের আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছে না মানুষ। কারণ ইতোমধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে লোডশেডিং শুরুও হয়ে গেছে।

বৈশ্বিক সংকটে গত বছর জ্বালানি তেলের দাম ও ডলারের বিনিময় মূল্য অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভ বাঁচাতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে হয়েছে সরকারকে। গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু ছিল। তখন এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং দিয়ে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করে সরকার। 

লোডশেডিংয়ে যে সূচি দেওয়া হয়েছিল, মূলত তা থেকে অনেক বেশি লোডশেডিংয়ের মুখোমুখি হতে হয় গ্রাহকদের। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে অফিস সময়েও পরিবর্তন আনা হয়। মূলত অনেক বছর পর এমন লোডশেডিংয়ের মুখোমুখি হতে হয় দেশবাসীকে। 

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ করা। শুধু তেল নয়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লাও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আনতে হচ্ছে গ্যাসও। গরমকাল শুরু হয়ে গেলেও গত বছরের চেয়ে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি এখনো। বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল, কয়লা ও গ্যাস কেনার জন্য যে ডলারের প্রয়োজন সেটার সংকট এখনো কাটেনি। কিন্তু পুরো গরম পড়লে ও বোরো সেচের মৌসুম শুরু হলে হু-হু করে বেড়ে যাবে বিদ্যুতের চাহিদা। এছাড়া সামনে আসছে রমজান মাস। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্ধিত এ চাহিদা পূরণ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। 

বাড়তি চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন বিপুল অর্থ 

ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা ৫০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) অনুমান করছে, এ সময়ে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে জ্বালানি খরচের জন্য অন্তত ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। ভারতের আদানি পাওয়ার ও শেভরনকে প্রদেয় অর্থ যোগ করলে এই অঙ্ক ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। 

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বাংলাদেশের এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। সেই সঙ্গে আমদানি হয় এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। গত জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট। পিডিবির অনুমান, ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৫ মাসে প্রতিদিন ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে যে অর্থের প্রয়োজন হবে সরকার সেটার জোগান দিতে পারবে কিনা, সেই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ রিজার্ভের ওপর চাপ এখনো কমেনি। এমন আর্থিক পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে পিডিবি গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে সর্বাধিক সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কারণ এর মাধ্যমেই সবচেয়ে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। 

সম্প্রতি অর্থ বিভাগের কাছে একটি চিঠিতে পেট্রোবাংলা লিখেছে, স্পট মার্কেট ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা মেটাতে তাদের ৫ মাসে প্রায় ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। পিডিবি বলেছে, তাদের অতিরিক্ত গ্যাস লাগবে, কিন্তু কোম্পানির কাছ থেকে বকেয়া অর্থ এখনো তারা পায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকও সহযোগিতা করছে না তাদের। অর্থ বিভাগের কাছে আরেকটি চিঠিতে পিডিবি পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ স্থানীয় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করতে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে।

বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা জানিয়েছে, পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল আমদানি করতে তাদের ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের জ্বালানি আমদানি করতে ২ বিলিয়ন থেকে ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এর মধ্যে ১০ শতাংশ প্রয়োজন বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে দৈনিক ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও মিলতে পারে বড়জোর ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন। বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর বিল পরিশোধ আর ফার্নেস অয়েল আমদানিতেও বড় বাধা ডলার সংকট। সবচেয়ে বেশি উৎপাদন ক্ষমতার পায়রাও সম্প্রতি বন্ধ হওয়া এড়িয়েছে কোনোক্রমে।

শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি আমদানির জন্য ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা সম্ভব হবে না। বুয়েটের পেট্রোলিয়াম ও খনিজ সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘প্রতিদিন ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার জন্য পিডিবির পরিকল্পনা প্রশংসনীয়। কারণ এর মাধ্যমে লোডশেডিং ও জনগণের দুর্ভোগ কিছুটা কমবে। কিন্তু তারা এত ডলারের ব্যবস্থা কীভাবে করবে, সেটা চ্যালেঞ্জিং।’ আন্তর্জাতিক জ্বালানি পরামর্শক প্রকৌশলী সালেক সুফি বলেন, ‘অন্যান্য খাতে খরচ কমিয়ে কয়লা আমদানি এবং এলএনজি আমদানির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ আমরা যদি চাহিদামাফিক সরবরাহ করতে না পারি, তাহলে কোনো পরিকল্পনা করেই অতিরিক্ত লোডশেডিং থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।’

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার চেষ্টা করছি। যার জন্য গ্যাসও আমরা বৃদ্ধি করছি। গ্যাসের দামটা কিছুটা স্থিতিশীল। আমরা শিল্পে গ্যাস নিরবচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করছি, বিদ্যুতেও গ্যাসের পরিমাণ বাড়ানো, যাতে বিদ্যুতের অবস্থা ভালো থাকে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, সেগুলো একটার পর একটা আসা শুরু হবে। আমরা পায়রা তো পাচ্ছি, পুরোটাই পাচ্ছি আমরা। আমরা আশা করছি রামপালও চলে আসবে। আমরা আশা করছি বরিশালের ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে আসবে। আমরা আশা করছি, এসএস পাওয়ার সেটা চলে আসবে।’ পিডিবির মুখপাত্র শামীম হাসান বলেন, ‘আমরা হয়তো এ বছর লোডশেডিং থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাব না। কিন্তু আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গ্রীষ্মের মাসগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো বিঘ্ন ঘটবে না।’

রয়েছে দাম বৃদ্ধির খড়্গ

লোডশেডিংয়ে শঙ্কার মধ্যে রয়েছে মাসে মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর খড়্গ। গত দুই মাসের ব্যবধানে দেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো তিন দফা। সর্বশেষ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সরকারের এক নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়। তখন ভোক্তাপর্যায়ে ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। গত ১ মার্চ থেকেই কার্যকর হয়েছে নতুন এই খুচরা মূল্য। এর আগে জানুয়ারি মাসে দুই দফায় বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। যা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মিলে দুই ভাগে কার্যকর করা হয়। গত ৩০ জানুয়ারি সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে বিদ্যুতের দাম খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ এবং পাইকারি পর্যায়ে ৮ শতাংশ বাড়ানো হয়।

চলতি বছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ সামলাতে প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করছে সরকার। বিগত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১২ বার। অপরদিকে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১৩ বার। সংশোধিত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইনের ক্ষমতা বলে সরকার নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। বিশেষ ক্ষেত্রে বিইআরসি ছাড়াই ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণ, পুনর্নির্ধারণ ও সমন্বয়ে সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০২৩’-এ। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh