সরকারের কথাবার্তায় সতর্ক বিএনপি

বাছির মোহাম্মদ

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫২ এএম

বিএনপির পতাকা। ছবি: সংগৃহীত

বিএনপির পতাকা। ছবি: সংগৃহীত

সামনে দ্বাদশ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত পথনকশা অনুযায়ী এ নির্বাচনের আরও আট-নয় মাস বাকি। তবে এরই মধ্যে বিদেশি বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ও সংস্থা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশে যাতে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়, তা নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে।

এর মধ্যেই নির্বাহী আদেশে মুক্তি পাওয়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করেন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা। এমতাবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিএনপির সংলাপ নিয়েও কানাঘুষা শুরু হয়েছে, যদিও কোনো দলই সংলাপের ব্যাপারে এখনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। 

ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংলাপ নিয়ে লুকোচুরি করার কিছু নেই। প্রয়োজন হলে মির্জা ফখরুলকে আমি প্রকাশ্যেই ফোন করব। তবে তিনি বলেন, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। সংবিধানের মধ্যে যদি অন্য কোনো পন্থায় নির্বাচন হয়, তাহলে তা খুঁজে দেখুক বিএনপি। 

এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। আগামী নির্বাচন এই ব্যবস্থার অধীনে হতে হবে। কাটাছেঁড়া সাজানো সংবিধানের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। 

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, বিএনপি সংলাপের কথা বলেনি। আমরা বলেছি- এ সরকারকে চলে যেতে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এ দেশে  নির্বাচন হবে না। 

এদিকে হঠাৎ করে দলীয়প্রধান খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা বিষয়ে সরকারের মন্ত্রীদের কথাবার্তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম গত জানুয়ারি মাসে ‘খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে না পারার বিষয়টি’ সামনে নিয়ে আসেন। ২৬ জানুয়ারি সংসদে তিনি দাবি করেন, ‘সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে মুক্তি পেতে খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন না- এমন মুচলেকা দিয়েছেন।’ 

এরপরই হঠাৎ করে গত সপ্তাহে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক খালেদা জিয়ার আবার রাজনীতিতে যুক্ত হতে কোনো আইনি বাধা নেই বলার পরই বিষয়টি নতুন মোড় নেয়। তবে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন যে, তার স্বাস্থ্য খারাপ থাকায় তিনি আগের মতো রাজনীতি করতে পারবে কিনা। এছাড়াও এ নিয়ে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের, আবদুর রাজ্জাক ও হাছান মাহমুদ। 

এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, তার দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা নিয়ে মন্ত্রীদের পরস্পরবিরোধী মন্তব্যের পেছনে একটি অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন রাজনীতি করার সময় আসবে খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন। তিনি (খালেদা জিয়া) এখনো মামলা থেকে মুক্ত হননি। আমরা তার মুক্তির জন্য আন্দোলনে আছি। মুক্তি পেলে তিনি তার চিকিৎসার জন্য প্রথমে বিদেশে যাবেন।’ 

বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসনের ফলোআপ চিকিৎসা চলছে। কারণ বাংলাদেশে ম্যাডামের আর কোনো চিকিৎসা নেই। এজন্য মেডিক্যাল বোর্ড ইতোমধ্যে তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করার পরামর্শ দিয়েছেন।’ 

খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা রাজনীতির জন্য উপযুক্ত কিনা চিন্তা না করে তার রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার ব্যাপারে সরকারের মন্ত্রীদের দেওয়া বক্তব্যে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে বিএনপির। গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিএনপির নীতিনির্ধারণী সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায়ও এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন যখন ঘনীভূত হচ্ছে, তখন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে পারা না-পারা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের বক্তব্য রাখাটাকে এক ধরনের ষড়যন্ত্র বলে মতপ্রকাশ করেছেন বিএনপির নেতারা। 

তারা মনে করেন, খালেদা জিয়ার বিষয়টি বিএনপির কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এই সময়ে আওয়ামী লীগ এ রকম একটি বিষয় বাজারে ছেড়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘোরানোর কৌশল নিয়ে থাকতে পারে। তাই এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া না-দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত সরকার কী করতে চায় তা দেখতে পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির স্থায়ী কমিটি। এর মধ্যে একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা মনে করেন, সরকার একটি স্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তাদের দলের নেত্রীকে নিয়ে হঠাৎ করেই কথাবার্তা বলছেন। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকার প্রশ্নে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর কূটনীতিকদের ঘন ঘন সফরে সরকার এক ধরনের চাপে রয়েছে। এ চাপ কিছুটা হালকা করতে এমন কৌশল নিয়ে থাকতে পারে ক্ষমতাসীন দল। 

তিনি আরও বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখন সক্রিয়ভাবে একক সিদ্ধান্তে দল চালাচ্ছেন। প্রতি সপ্তাহে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নির্দেশনা দিচ্ছেন। এ অনুযায়ী দল চলছে। এখন খালেদা জিয়াকে যদি রাজনীতিতে নামিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তারেক রহমানের একক কর্তৃত্ব খর্ব হবে। এ অবস্থায় মা-ছেলের মধ্যে একটা মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লাভবান হবে সরকার। যে রকমটি জাতীয় পার্টিতে হচ্ছে। 

তিনি সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান দেবর জি এম কাদের ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ভাবি রওশন এরশাদের দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, এতে কিন্তু লাভবান সরকার। কারণ দলটি সরকারি স্ট্র্যাটেজির বাইরে যেতে পারছে না। এদিকে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে বিএনপির সমর্থনে সারা দেশে বিজয়ী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানদের নিয়ে মতবিনিময় করছে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এরই মধ্যে রংপুর, খুলনা, সিলেট, ঢাকা, কুমিল্লা ও ফরিদপুর অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে। সেখানে তারা বিএনপি হাইকমান্ডকে জিজ্ঞেস করেছে যে, আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হচ্ছে কি-না।

বিএনপি হাইকমান্ড জানিয়েছে, কোনো সমঝোতার নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। সব মিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিএনপি এখনো ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এ রয়েছে। তবে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা চলছে। এর ফল হচ্ছে- বিএনপি নির্বিঘ্নে তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারছে। আর তাদের নেত্রী খালেদা জিয়া রাজনীতি করায় বাধা নেই- সরকারের মন্ত্রীদের এ বক্তব্য দেওয়া। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘বিএনপিকে নিয়ে আওয়ামী লীগের যে পরিকল্পনা বা স্ট্র্যাটেজি-কৌশল আছে, এরই অংশ হিসেবে এটা (খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে বাধা নেই) করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ক্ষমতাসীন দল একটা চাপের মধ্যে পড়ে গেছে। বিশেষ করে আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা অন্যান্য যারা আছে। যার ফলে তাদের ইনক্লুসিভ (সকলের অংশগ্রহণ) নির্বাচনে যেতে হবে। যদি যেতে হয়, তাহলে বিএনপিকে তো নিতে হবে।’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন অর রশিদ মনে করেন, সাজা স্থগিত করে মুক্তি দেওয়ার পরও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি করতে দেওয়া হচ্ছে না- বিএনপির এ রকম প্রচার রয়েছে। দেশে-বিদেশে যারা বাংলাদেশি রাজনীতির পর্যবেক্ষক তারা তো বুঝতে পারছেন, সরকার একটা অবস্থান নিয়েছে, তারা তাকে রাজনীতি করতে বাধা দিচ্ছে না। আবার সরকার বা সবাই এটাও জানে যে, তার পক্ষে সক্রিয় রাজনীতি করা সম্ভব নয়। সরকার একটা বক্তব্য দিয়ে যদি স্কোর করতে পারে তা করবে না কেন। রাজনীতি একটি খেলা। ভালো খেলতে পারলে খেলব না কেন! সরকার এই অবস্থান নিয়ে ভালোই চাল দিয়েছে বলে মনে করেন দেশের এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh