বাংলার প্রথম নারী রাজবন্দি

অলোক আচার্য

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৩, ১১:৪১ এএম

ননীবালা দেবী। ছবি: সংগৃহীত

ননীবালা দেবী। ছবি: সংগৃহীত

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের আগে ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশ প্রায় দুইশ বছর শাসন করেছে। প্রথম একশ বছর কোম্পানির শাসন ও পরবর্তী প্রায় একশ বছর ব্রিটেনের রানির অধীনের শাসনের সময়কালে বাংলায় অসংখ্য ছোট-বড় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। সেসব বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছে একেকজন দেশপ্রেমিক। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন আন্দোলন।

ক্ষুদিরাম, শহীদ তিতুমির, মাস্টারদা সূর্যসেন থেকে শুরু করে অসংখ্য স্বাধীনতাকামী মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিশোর, যুবা, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এই আন্দোলন করেছেন। ক্ষুদিরাম বসু নিজের হাতে বোমা বানিয়ে ট্রেনে হামলা চালিয়েছিলেন সাহেবদের দর্প চূর্ণ করতে। দুর্ভাগ্যবশত সেই বোমায় নিহত হয় নিরীহ ভারতবাসী। সে অপরাধে তার ফাঁসি হয়। এরকম বহু স্বাধীনতাকামী স্বাধীনতার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষদের স্বাধীনতাকামীদের নামই বেশি শোনা যায়, আলোচিত হয়।

নারী স্বাধীনতাকামীদের কথা খুব একটা আলোচনায় আসে না। হয়তো সে সংখ্যা হাতে গোনা বলেই। এদের মধ্যে যেমন পুরুষ স্বাধীনতাকামী ছিলেন তেমনি ছিলেন নারী স্বাধীনতাকামী। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হলো প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তবে এই স্বাধীনতা আন্দোলনে একজন নারীর নাম একটু কমই শোনা যায়- তিনি একজন সাহসী নারী। তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, বহু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছিলেন এবং জেলে অমানবিক নির্যাতন সহ্য করেছিলেন। তবু পরাধীনতার কাছে নির্যাতনের কাছে মাথা নত করেননি। তিনি হলেন ননীবালা দেবী। ১৮৮৮ সালে হাওড়া জেলার বালিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সূর্যকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতার নাম গিরিবালা দেবী। ননীবালা দেবীর চরিত্র বিশ্লেষণে যে বৈশিষ্ট্যগুলো উঠে আসে সেগুলো হলো তিনি প্রচণ্ড সাহসী নারী, বুদ্ধিদীপ্ত, দেশপ্রেমিক এবং আত্মপ্রত্যয়ী নারী ছিলেন। 

ননীবালা দেবী মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার জীবনের শুরুটা মোটেই সুখকর ছিল না। পথটা তো আরও প্রতিকূল। শত বছর আগের প্রথা মেনে মাত্র এগারো বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তার মাত্র কয়েক বছর পর তিনি বিধবা হন। তখন তার বয়স মাত্র ১৬ বছর। স্বামী মারা যাওয়ার পর তার ঠিকানা হয় নিজ পিতৃগৃহ। এ সময় তিনি আর লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারেননি। কারণ তার সময়কার সমাজ ছিল নারী শিক্ষার পক্ষে প্রতিকূল। সমাজে নারী শিক্ষাকে বিশেষত ননীবালা দেবীর মতো একজন বিধবা নারীর জন্য অতটা সহজ ছিল না। ফলে তাকে লেখাপড়ার ইচ্ছা ছাড়তে হয়েছিল। তার বুদ্ধিদীপ্ত ও সাহসী বিশেষণের পরিচয় মেলে বিপ্লবী দলের সাথে কাজের শুরুতেই ১৯১৫ সালে। ঐ বছর আলিপুর জেলে বন্দি বিপ্লবী রামচন্দ্র মজুমদারের কাছ থেকে গোপনে তথ্য আনার জন্য ননীবালা দেবী ঐ বন্দির স্ত্রী পরিচয়ে দেখা করেন। তথ্য বলতে তার কাছে থাকা একটি পিস্তলের খোঁজ পেতে। সেই সময় পুলিশ কিছুই বুঝতে পারেনি। এটা ননীবালা দেবী তো নয়ই কোনো মেয়েই এ ধরনের কাজ করতে সাহস করবেন এমন আশা করা যেত না। ননীবালা দেবীর ভাইপো ছিলেন বিপ্লবী অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার কাছেই তিনি বিপ্লবী আন্দোলন ও যুগান্তর দলের কার্য সম্পর্কে জানতে পারেন। তার বিপ্লবী জীবনও তখন শুরু হয়। তিনি গোপনে দলের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিনি বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিতেন এবং গোপনে অস্ত্রও সরবরাহ করতেন। তার কাছের মানুষও জানত না তিনি বিপ্লবী দলের সদস্য। তবে তিনি বেশিদিন পুলিশের নজর এড়াতে পারেননি। তারা জানতে পারেন যে তিনি রামচন্দ্র মজুমদারের স্ত্রী নন। তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে সেখান থেকে পালিয়ে যান। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। গ্রেপ্তার করা অবস্থায় তিনি কলেরা আক্রান্ত ছিলেন। শুরু হয় সেখানে তার উপর নির্যাতন এবং তার সাহসী ভূমিকা যা পরবর্তীকালে আরও বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছিল। তাকে নির্মম নির্যাতন করেও তার মুখ থেকে সংগঠনের খবর বের করতে পারেনি। তাকে রাখা হয় কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে। সেখানে তিনি অনশন শুরু করেন। এক দিন দুই দিন নয় তিনি অনশন করেন টানা ২১ দিন। 

অবশেষে কর্তৃপক্ষ তার অনশন ভাঙার শর্ত জানতে চায়। লিখিত শর্তে তিনি জানান যে বাগবাজারে শ্রীরামকৃষ্ণ পত্নীর কাছে তাকে রাখা হলে তিনি তার অনশন ভাঙবেন; কিন্তু অফিসার তার সেই শর্ত মানেন না। উল্টো ছিঁড়ে ফেলেন। তার দরখাস্ত ছিঁড়ে ফেলার জন্য সাহেবকে চড় মারেন। জেলে থাকা অবস্থায় তার উপর কী ধরনের নির্যাতন চালিয়েছিল তার একটা ঘটনায় জানা যায়, দুজন জমাদারনী মিলে তাকে একটা সেলে জোর করে মাটিতে ফেলে দিয়ে তাকে উলঙ্গ করে লঙ্কাবাটা তার শরীরের অভ্যন্তরে দিয়ে দেয়। তবুও ননীবালা দেবী মুখ খোলেননি। কী বিপুল ধৈর্য থাকলে এতটা কষ্ট সহ্য করা যায় তার প্রমাণ ননীবালা দেবী। তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র স্টেট প্রিজনার। তিনিই বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দি। একজন সাধারণ নারী থেকে পুরোদস্তুর বিপ্লবী হয়ে ওঠা এবং সাহেবদের মুখের উপর জবাব দেওয়ার যে সাহসিকতা তিনি দেখিয়েছেন তা এক কথায় অসাধারণ।

দেশপ্রেম কীভাবে একজন সাধারণ বিধবা নারীকেও বিদ্রোহের চেতনা জাগ্রত করে তার উদাহরণ ননীবালা দেবী; কিন্তু ননীবালা দেবীর শেষ জীবন ভালো কাটেনি। দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে তার শেষ দিনগুলো অতিবাহিত হয়েছে। তিনি নিজে সুতো কেটে পৈতে তৈরি করতেন এবং তা বিক্রি করে খরচ চালাতেন। বহু আগেই স্বামী ও পরিবার পরিজন হারিয়ে তিনি ছিলেন নিঃস্ব। একজন সংগ্রামী দেশপ্রেমিক এই নারী অন্যদের জন্য বড় উদাহরণ হলেও সে সময় তিনি একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারেননি। কোথাও সম্মানের সাথে থাকার জায়গা পাননি। তার শেষ জীবন কেটেছে সঙ্গীবিহীন অবস্থায়। ১৯৬৭ সালে এই মহান বিপ্লবী দেশপ্রেমিক মৃত্যুবরণ করেন। আজ যে নারী দিবস পালন করা হয়, সেই পথের সাহস জুগিয়েছেন ননীবালা দেবীর মতো সাহসী নারীরা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh