আইএমএফের ঋণ ও শর্ত

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৩, ১১:৫৭ এএম

জিয়াউদ্দীন আহমেদ। ফাইল ছবি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ। ফাইল ছবি

বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। গত বছরের ২৪ জুলাই ঋণ চেয়ে আইএমএফের কাছে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। বর্ধিত ঋণসুবিধা এবং বর্ধিত তহবিল সুবিধার আওতায় ৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির আওতায় আরও ১.৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন হয়েছে। 

আইএমএফ বলেছে, করোনার মহামারি মোকাবিলা করে বাংলাদেশে দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিল, কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে বাংলাদেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যায়, টাকার দরপতন হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়; রিজার্ভ ধরে রাখার প্রয়াসে আমদানিতে লাগাম টানাতে দেশের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে, জ্বালানি সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন। তাই প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে বাংলাদেশের ঋণ পাওয়া জরুরি। 

আইএমএফের এই ঋণ বাংলাদেশে বিরাজমান বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় কতটুকু অবদান রাখবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ এই ঋণ দেওয়া হবে সাত কিস্তিতে ৪২ মাসব্যাপী। এই অল্প ডলার দিয়ে চলতি হিসাবের বিরাট ঘাটতি পূরণ সহজ হবে না। আমাদের আমদানির পরিমাণ বেশি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ অসংখ্য দ্রব্য আমদানি করতে হয়। চাল, ডাল, গম, পেঁয়াজ, রসুন সবই বিদেশ থেকে ডলার দিয়ে কিনতে হয়। আমরা যে পোশাক রপ্তানি করি তার কাঁচামালও আসে বিদেশ থেকে। তাই রপ্তানির জন্যই আমাদের আমদানি করতে হয়। পোশাক তৈরির শিল্পকারখানা সচল রাখার জন্যও কোটি কোটি ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। আমদানি করতে হয় বাস, ট্রাক, কার, রেলগাড়ি, বিমান, জ্বালানি তেল-গ্যাস। এই জ্বালানি তেল-গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমাদের চলতি হিসাবে বিরাট ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক বছর আগের তুলনায় এখন তেল-গ্যাস কিনতে হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ দরে। তেল-গ্যাস দিয়ে উৎপাদন হয় বিদ্যুৎ, ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেছে, বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট সকল পণ্যের উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে, ফলে বাজারে জিনিসপত্রের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অবস্থায় একই জিনিস এখন আমদানি করতে অনেক বেশি ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। 

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার আরও অনেক কারণ রয়েছে; এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, ব্যবসায়ীদের আন্ডার ইনভয়েস আর ওভার ইনভয়েসের অবৈধ কারসাজির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার এবং হুন্ডির মাধ্যমে দুর্নীতির টাকা বিদেশে গচ্ছিত রাখা। বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সজাগ থাকলে আন্ডার ইনভয়েস আর ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে দেদার ডলার বিদেশে পাচার হতো না। বাজার দরের সঙ্গে এলসিতে উল্লেখিত পণ্যের ইনভয়েস মূল্যের বিরাট পার্থক্যের হিসাব কখনো নেওয়া হয়নি। আমদানিকৃত পণ্যের কাস্টম ডিউটি নিরূপণের সময়ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লোকজন দৃশ্য-অদৃশ্য কারণে উদাসীন ছিল। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ঘুম ভেঙেছে, আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে মনিটরিং বৃদ্ধি করা হয়েছে। হুন্ডি ব্যবসায়ীদেরও ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো যদি আগে থেকে তৎপর থাকত, স্ব স্ব দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পাদন করত তাহলে কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে উঠত না। 

আমাদের দুর্নীতির অবস্থান তেরো থেকে বারো নম্বরে নেমে এসেছে। যত বেশি দুর্নীতি হবে তত বেশি অর্থ পাচার হবে। দুর্নীতির টাকা অল্প হলে জমি কিনে বা ভবন তৈরি করে তা বৈধ টাকার সঙ্গে মিশিয়ে হালাল করা সম্ভব; কিন্তু দুর্নীতির টাকা বেশি হলে তা হালাল করা সহজ হয় না। ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে রাখা যায় না, ব্যাংকারের সন্দেহ জাগলে জবাবদিহি করতে হয়। সম্পদ কিনলেও তা গোপন রাখতে হয়, সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করা যায় না। এই অবস্থায় টাকা দিয়ে ডলার কিনে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পারলেই নিরাপদ। বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে নাকি ভিআইপি ও তাদের স্বজনেরা ডলার নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেন- কথাটি মিথ্যে নয়। ভিআইপি ব্যক্তিদের শরীর বা বাক্সপেটরা কিছুই চেক করা হয় না। কানাডার বেগমপাড়ার বেগমদের বেশিরভাগ নাকি আমলাদের বউ। তাই দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও কমাতে হবে। আইএমএফও ঋণ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি কমানোর শর্ত দিয়েছে। 

আইএমএফ আরও অনেকগুলো শর্ত দিয়েছে। সরকারের ভর্তুকি কমাতে হবে। জনগণকে তুষ্ট রাখতে সরকার বেশি দরে কিনে কম দামে পণ্য বিক্রি করে থাকে। সার, বিদ্যুৎ, গ্যাস প্রভৃতির উৎপাদন বা আমদানি খরচ যত, তত টাকা ভোক্তার কাছ থেকে নেওয়া হয় না। সারের প্রকৃত দর নেওয়া হলে কৃষি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে, অথবা ধান, চাল, গম, সবজির দর এত বেশি বৃদ্ধি পাবে যে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। অবশ্য সারের দর বৃদ্ধি করার শর্ত সরকার মানেনি, আইএমএফও মানার জন্য বেশি চাপ সৃষ্টি করেনি। কিন্তু আইএমএফ বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে, তাদের শর্ত হচ্ছে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করা যাবে না। সরকার তা মানতে বাধ্য হয়েছে, আইএমএফের শর্ত মেনে ইতোমধ্যে দুবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে; অর্থাৎ এখন থেকে বিরোধী দলের শত বিরোধিতা সত্ত্বেও নিয়মিত বিদ্যুতের দর সমন্বয় করা হবে। উন্নত দেশে সরকার সচরাচর ভর্তুকি দেয় না, তাই তাদের দেশে উৎপাদন বা আমদানি খরচ হিসাব করে পণ্যের বাজার মূল্য নিরূপিত হয়। বাংলাদেশ সরকার আরও অনেক ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়, বেশি দামে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল কিনে কম দামে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের কাছে বিক্রি করে থাকে। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিনা পয়সায় লক্ষ লক্ষ নিঃস্ব ব্যক্তিকে নিয়মিত খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। অবশ্য এই সকল ক্ষেত্রে আইএমএফের কোনো শর্ত নেই। 

আইএমএফের আরও শর্ত আছে। টাকার বিনিময় ব্যবস্থা বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার শর্ত এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন করা একটু কঠিন। টাকার বিনিময় ব্যবস্থা বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হলে পণ্যের আমদানি খরচ আরও বেড়ে যাবে এবং বাজারে জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যেতে পারে। তাই বিশ্ব মন্দা কেটে গেলে আইএমএফের এই শর্তের বাস্তবায়ন করা শ্রেয় হবে। তবে অন্য শর্তগুলোর বাস্তবায়ন আমাদের স্বার্থেই করা উচিত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দুর্নীতি সামান্য কমলেও দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। শুধু দুর্নীতির ব্যাপকতার জন্য কাক্সিক্ষত রাজস্ব ও কর আদায় সম্ভব হচ্ছে না। কাস্টম বিভাগের দুর্নীতির কারণে আমদানিকৃত পণ্যের উপর যথাযথ ডিউটি আরোপিত হয় না, ঘুষের ছড়াছড়ির কারণে ভ্যাট আদায় কম হয়, ঘুষের জন্য হয়রানি করা হয় বলেই কর প্রদানে নাগরিকেরা উৎসাহ বোধ করেন না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরে দুদক বহুদিন আগে সম্ভবত একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান ক্ষোভে দুদকের দুর্নীতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। রাজস্ব আদায় বাড়াতে হলে আইএমএফের শর্ত মোতাবেক রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার ও কর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। 

আইএমএফ ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের শর্তও দিয়েছে। আর্থিক খাতের দুর্বলতা দূর করে নজরদারি বাড়ানো জরুরি। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ও বেনামি ঋণ ব্যাংক খাতকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। আর্থিক খাত নিয়ে অনেক কেলেঙ্কারি হয়েছে যার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও জড়িত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি না থাকায় বেসিক ব্যাংকটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেল, নিজস্ব জ্ঞান-বুদ্ধি না থাকায় বেসিক ব্যাংকের ক্রমাবনতির দৃশ্যটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখেও না দেখার ভান করেছে। পরিচালকগণ তাদের মালিকানাধীন ব্যাংক থেকে দেদার ঋণ নিয়েছেন, মালিকানাধীন ব্যাংকসমূহকে তাদের নিজস্ব অর্থায়নের উৎস হিসেবে ব্যবহার করছেন। পি কে হালদারকে নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হুঁশ হয়। জনগণের মধ্যে এমন একটি প্রতীতি বিরাজ করছে যে, কোন কর্মকর্তা কোন বিভাগের দায়িত্বে থাকবেন তাও নিয়ন্ত্রণ করে বাইরের লোক। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক স্বাধীনতা, কিন্তু তার প্রয়োগে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দ্বিধাগ্রস্ত। দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার প্রধান কারণ, দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার সাহসের অভাব, রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়ে বালাই মুসিবত থেকে বেঁচে যাওয়ার সুযোগ খোঁজে সবাই। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে, এই ঋণ কমানোর শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। সঠিক মুদ্রানীতির বাস্তবায়নপূর্বক মূল্যস্ফীতি হ্রাস করার শর্তও রয়েছে। 

আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও পলিসি সংস্কারের শর্তারোপ করেছে। তাদের শর্তানুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ইতোমধ্যে সংশোধন হয়েছে, বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের ঋণ গ্রহণ কমানোর শর্ত ইতোমধ্যে পূরণ হয়েছে, ব্যাংকের আমানত এবং ঋণের সুদের হারে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আরও সংস্কার করতে হবে। প্রতিটি কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে সংস্কার কতটা হলো তা আইএমএফ মূল্যায়ন করবে; না হলে অর্থ ছাড়করণ বন্ধ করে দিতে পারে। আর্থিক খাত সংস্কারে ব্যর্থ হওয়ায় আইএমএফ পাকিস্তানকে অনুমোদিত ঋণ দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল। আইএমএফের এই ঋণ পর্যাপ্ত নয়, স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য আরও ঋণ আবশ্যক। বাংলাদেশ ২০১২ সালের পর থেকে আইএমএফের ঋণ নেয়নি, এখন না নিয়ে উপায় নেই। উপায় নেই বলেই প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনের সংস্কারে আমাদের অবশ্যই যত্নবান হতে হবে। আইএমএফের শর্ত পরিপালন করা হলে বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি থেকেও কম সুদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। উপরন্তু দুর্নীতি হ্রাস ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাঠামোগত সংস্কারগুলো দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।


জিয়াউদ্দীন আহমেদ
সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh