মহিমান্বিত রজনী শবে বরাত

মাওলানা লিয়াকত আলী

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৩, ০৫:৩৪ পিএম | আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৩, ০৮:২৫ পিএম

মাওলানা লিয়াকত আলী।

মাওলানা লিয়াকত আলী।

চান্দ্র মাসের ভিত্তিতে পরিগণিত হিজরি বর্ষপঞ্জির অষ্টম মাস শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত ইসলামের দৃষ্টিতে  বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমান্বিত রজনীগুলোর একটি। সাধারণভাবে এটি শবে বরাত নামে পরিচিত হলেও  হাদিস শরীফে এটিকে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রজনী নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্যের কারণে এটির আরেক নাম ‘লাইলাতুল বারাআত’, বাংলায় যার অর্থ নাজাত ও নিষ্কৃতি। কারণ এ রাতে মুমিন অথচ পাপী অসংখ্য বান্দাকে মহান রব্বুল আলামীন ক্ষমা করেন বলে জানিয়েছেন মহানবী (সা.)।

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.)  বর্ণনা করেন, এক রাতে আল্লাহর রাসূলকে (সা.) বিছানায়  পেলাম না।  (খুঁজতে বের হয়ে) হঠাৎ (দেখলাম)  তিনি বাকী কবরস্তানে।  তিনি (আমাকে) বললেন- তুমি কি  আশঙ্কা কর যে, আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার ওপর অবিচার করবেন? আমি বললাম :  হে  আল্লাহর রাসূল, আমি ধারণা করেছিলাম, আপনি হয়তো আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তখন তিনি  বললেন, “(তা নয়, বরং) নিশ্চয়ই আল্লাহ  শাবানের মধ্যভাগের  রাতে পৃথিবীর আকাশে  নেমে আসেন, তারপর তিনি কালব গোত্রের মেষের পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।” (তিরমিজী ও ইবনে মাজা শরীফ)

হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর  রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যখন অর্ধ শাবানের রাত উপস্থিত হবে তখন তোমরা সেই রাতে সজাগ থেকে ইবাদত-বন্দেগি করবে এবং দিনের বেলায় রোজা রাখবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ  উক্ত রাতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে  নেমে আসেন এবং ঘোষণা করতে থাকেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে  দেব। কোনো রিযিক প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে রিযিক দান করব।  কোনো  বিপন্ন  আছে কি? আমি তার বিপদ দূর করে দেব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত  তিনি ঘোষণা করতে থাকেন।” (ইবনে মাজা শরীফ)

কোরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “শপথ স্পষ্ট গ্রন্থের। নিশ্চয়ই আমরা তা অবতীর্ণ করেছি কল্যাণময় রজনীতে। নিশ্চয়ই আমরা  সতর্ককারী। আমাদেরই নির্দেশক্রমে উক্ত রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাময় বিষয় ফায়সালা হয়। আর নিশ্চয়ই আমরাই প্রেরণকারী।” (সূরা আদ-দূখান, ২-৫)

এখানে উল্লিখিত মুবারক বা কল্যাণময় রজনী বলতে বেশির ভাগ মুফাসসিরের মতে রমজানের কদরের রাত উদ্দেশ্য। তবে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এর বিশিষ্ট শিষ্য হজরত ইকরিমাসহ কারো কারো মতে, এখানে মধ্য শাবানের রাত উদ্দেশ্য। সুতরাং এ রাতের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। তাছাড়া সাধারণভাবে প্রত্যেক চান্দ্র মাসের মধ্যভাগের তিন দিন বা ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে নফল রোজা রাখার বিশেষ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে হাদিস শরীফে। আর প্রতিদিন শেষ রাতের ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য ও অনুগ্রহ লাভের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে কোরআন মজীদ ও হাদিসে। তাই শবে বরাতের ইবাদত ও দোয়ার মাহাত্ম্য সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই।

লাইলাতুল বারাআত রমজান মাসের আগমনী বার্তা ঘোষণার রাত। মাত্র দুই সপ্তাহ পরে এসে যায় রমজান।  এ জন্য মুমিন বান্দারা পবিত্র মাসে আরও বেশি ইবাদতে মশগুল হওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজানের পরে শাবান মাসের চেয়ে বেশি রোজা অন্য কোনো মাসে রাখতেন না। আরেক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল প্রায় পুরো শাবান মাস রোজায় কাটাতেন।

এ রাত আল্লাহতায়ালার মহান দরবারে ক্ষমা প্রার্থনার বিশেষ সময়। এই রাতে বিশেষ বরকত হাসিলের জন্য নফল নামাজ আদায়, কোরআন তেলাওয়াত, ইস্তেগফার, তাসবিহ-তাহলিল ও দোয়ায় মশগুল থাকা উচিত। এ রাতে তওবা-ইস্তেগফার করা, আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আকুতি জানানো এবং জীবিত ও মৃতদের পাপরাশি ক্ষমা লাভের জন্য প্রার্থনার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।

তবে শবে বরাতকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে বেশ কিছু কুসংস্কার ও বিদআত চালু আছে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো হালুয়া-রুটি তৈরি করার এক মহা ধুমধাম, যা নিঃসন্দেহে একটি কুসংস্কার ও বিদআত। তাই এটি বর্জন করা উচিত। সেই সঙ্গে বিভিন্ন কবরস্থানে বা মসজিদে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করাও অপচয়। এই রাত্রিতে মসজিদে সমবেত না হয়ে বাড়িতে একাকী ইবাদত করাই উত্তম। মসজিদে তো দৈনিক পাঁচবার ফরজ নামাজ আদায় করা হয়। নিজেদের বাসা-বাড়িকেও ইবাদতের গৃহ হিসেবে গড়ে তুলতে বলেছেন আল্লাহর রাসূল (সা.)। তাছাড়াও সকল নফল ইবাদত মসজিদের চাইতে বাড়িতে পালন করাই উত্তম। 

শবে বরাত উপলক্ষে এ দেশে ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি হয়। এ রাতে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করাই বান্দার একমাত্র কর্তব্য। তাই পবিত্র রজনীতে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে সর্বপ্রকার গোঁড়ামি ও শিরক থেকে পরিত্রাণ লাভের প্রার্থনা করা উচিত। আল্লাহ পাক যেন মুসলিম জাহানের সুখ-শান্তি ও কল্যাণের জন্য তাঁর রহমতের দরজা সারা বছরই খুলে রাখেন- এটাই  হোক আমাদের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা।

লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh