বিশ্ব পরিসরে প্রভাব বাড়াচ্ছে চীন

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৩, ০৯:৩৪ এএম

শি জিনপিং ও ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

শি জিনপিং ও ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন পর্যন্ত পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। আবার চীনের মধ্যস্থতাও মানতে নারাজ পশ্চিমা গোষ্ঠী। এমন অবস্থায় এ সংকট নিরসনে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ১২ দফা প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন। তবে বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধে শান্তি প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে মূলত চীন বিশ্ব পরিসরে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নিজের প্রভাব বাড়াতে চাইছে।

অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে পরাশক্তি হলেও কূটনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে চীন এখনো পিছিয়ে রয়েছে। আর এ সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে চীন বিভিন্ন দেশের সংকটে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধে চীন মধ্যস্থতার ভূমিকায় চলে এলে পশ্চিমাদের, বিশেষত মার্কিন প্রভাব ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

চীনের ১২ দফা

যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে চীন। দেশটি বলেছে, তারা চায় না ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাক। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তির দিনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১২ দফা শান্তি পরিকল্পনার প্রস্তাব দেয়। এতে যুদ্ধবিরতি ও শান্তি আলোচনার আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার অবসান, পারমাণবিক স্থাপনার নিরাপত্তা, বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নিতে মানবিক করিডোর গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। শস্য রপ্তানি নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়। 

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, সংঘাত ও যুদ্ধে কারও লাভ নেই। উত্তেজনার আগুনে ঘি না ঢেলে সব পক্ষেরই যুক্তিসঙ্গত ও সংযত আচরণ করা উচিত। এই সংকট যেন আরও মারাত্মক অবস্থায় না যায় কিংবা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সেদিকে সবার নজর দেওয়া উচিত।

পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্র চীনের এই পরিকল্পনার কড়া সমালোচনা করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘আমি এই প্রস্তাবে এমন কিছুই দেখিনি যার থেকে রাশিয়া ছাড়া আর কেউ লাভবান হবে।’ মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেন, ‘রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর হামলা বন্ধ করে সেনা প্রত্যাহার করলে আগামীকালই যুদ্ধ বন্ধ হতে পারে। অর্থাৎ ১২ দফা পরিকল্পনার বদলে চীন শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করলেই পারত। ইউক্রেন, ন্যাটো বা যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ায় হামলা চালাচ্ছে না। সব দেশের সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়ার কথা বলাই যথেষ্ট।’

চীন এখন পর্যন্ত রাশিয়াকে ইউক্রেনে আক্রমণের জন্য নিন্দা জানায়নি, প্রতিবেশী দেশে মস্কোর আক্রমণকে ‌‘আগ্রাসন’ অ্যাখ্যাও দেয়নি। দেশটি এমনকি রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞারও কড়া সমালোচনা করে আসছে। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ বলেন, ‘চীনের খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।

কারণ তারা রাশিয়ার অবৈধ আগ্রাসনকে নিন্দা পর্যন্ত জানায়নি। আগ্রাসন শুরুর মাত্র দিন কয়েক আগে বেইজিং মস্কোর সঙ্গে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষরও করেছে।’ ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেনও স্টলটেনবার্গের সুরে কথা বলেছেন। তিনিও মনে করেন, আগ্রাসনের আগেই রাশিয়ার সঙ্গে অসীম বন্ধুত্বে জড়িয়েছে চীন। রাশিয়ার প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকায় চীনের মধ্যস্থতা করার মতো অবস্থান নেই।

ইউক্রেন-রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে চান এবং ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের জন্য বেইজিংয়ের দেওয়া প্রস্তাব নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করতে চান। জেলেনস্কি বলেন, ‘আমি সত্যিই আশা করব চীন রাশিয়াকে কোনো অস্ত্র সরবরাহ করবে না।’ তবে জেলেনস্কি-শি শীর্ষ বৈঠকের বিষয়ে চীনা কর্তৃপক্ষ এখনো প্রকাশ্যভাবে কোনো সাড়া দেয়নি।

এদিকে চীনের এই শান্তি প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে রাশিয়া। মস্কোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা বেইজিংয়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করি।’ এর আগে গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন অভিযোগ করেছিলেন, বেইজিং রাশিয়াকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার কথা বিবেচনা করছে। এ দাবি চীন জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করে। ২৪ ফেব্রুয়ারি মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে আবার উল্লেখ করা হয় যে, চীন সরকার রাশিয়ায় ড্রোন ও কামানের গোলাবারুদ পাঠানোর কথা ভাবছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি বিষয়ক সম্পাদক জন সিম্পসনের মতে, চীন আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে। যদিও মুখরক্ষা হয় এমন একটা শান্তিচুক্তির ব্যবস্থা করে চীন প্রেসিডেন্ট পুতিনকে এই সংকট থেকে উদ্ধারের একটা পথ খুঁজতে চাইছেন।

চীনের শীর্ষস্থানীয় ক‚টনীতিক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর মস্কো সফরের পর চীনের দিক থেকে এই প্রস্তাব এসেছে। ওয়াং ২২ ফেব্রুয়ারি মস্কোতে প্রেসিডেন্ট পুতিন ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকের পর চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া ওয়াংকে উদ্ধৃত করে বলেছে, চীন চায় মস্কোর সঙ্গে ‘আরও গভীর রাজনৈতিক আস্থার সম্পর্ক’ ও ‘সুদৃঢ় কৌশলগত সমন্বয়’।

মার্কিনবিরোধী অবস্থান

ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে মধ্যস্থতায় আগ্রহী হওয়ার পেছনে চীনের বেশকিছু কারণ রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, চীন প্রথমত বিশ্বের শান্তিরক্ষক হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করতে চাইছে। তারা আসলে কাকে দলে টানতে চাইছে সেটার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত তাদের দলিলে রয়েছে, যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা তথাকথিত গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে চীন বিশ্বের বাদবাকি দেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে, যারা এখন নজর রাখছে পশ্চিমা দেশগুলো কীভাবে ইউক্রেন সংকট মোকাবিলা করে তার ওপর।

চীনের আরেকটি লক্ষ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি সুস্পষ্ট বার্তা পাঠানো। যুক্তরাজ্যের নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. আলেকজান্ডার কোরোলেভ বলেন, ‘এর মধ্যে বিরুদ্ধাচরণের স্পর্ধা দেখানোর একটি ব্যাপার রয়েছে। এটি বার্তা দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক যদি খারাপ হয়, তা হলে চীন অন্য কারও কাছে যেতে পারে। রাশিয়া একা নয়, যার মানে হলো যখন যুদ্ধ হবে তখন চীনও একা থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রও চীনকে ধমকা-ধমকি করে তেমন সুবিধা করতে পারবে না।’

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক এখন সবচেয়ে তিক্ত। সম্প্রতি গোয়েন্দা বেলুনকাণ্ডে এই সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, চীন কেন ঠিক এই সময়টিতে ইউক্রেনের শান্তির জন্য কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়েছে। মূলত পশ্চিমারা শান্তি আলোচনা এগোতে ব্যর্থ হওয়ার পরই চীন মধ্যস্থতার কথা বলেছে। মার্কিন অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করাও এ সময়ে এ প্রস্তাবের একটি কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। 

চীনের তৃতীয় একটি উদ্দেশ্য রয়েছে এবং ওয়াংয়ের ভ্রমণসূচি থেকে এটা বোঝা যায়। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও হাঙ্গেরি- যে দেশগুলোর নেতারা রাশিয়ার প্রতি কট্টরপন্থি নয় বলে চীন মনে করে, সেসব দেশ সফর করে ওয়াং হয়তো দেখতে চাইছেন, ইউরোপের কিছু অংশকে চীনা বলয়ের দিকে প্রলুব্ধ করা যায় কিনা। ইস্ট চায়না নর্মাল

বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ ঝ্যাং শিনের মতে, এই দেশগুলোর সঙ্গে বেইজিং ‘স্বার্থের যৌক্তিক মিলন’ দেখতে পাচ্ছে। চীন বিশ্বাস করে, যুক্তরাষ্ট্র একটি আধিপত্যবাদী শক্তি এবং তার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে ট্রান্স-আটলান্টিক বিশ্বের একটি বড় অংশ হয়তো উপকৃত হবে। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে চীন আদৌ সফল হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh