আল জাজিরাকে সাক্ষাৎকার

নির্বাচন নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হবে: প্রধানমন্ত্রী

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৩, ০২:৫৩ পিএম | আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৩, ০২:৫৩ পিএম

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: ভিডিও

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: ভিডিও

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেছে। তাই আগামী সংসদ নির্বাচনও নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হবে।

কাতারের রাজধানী দোহায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পঞ্চম জাতিসংঘ সম্মেলনের (এলডিসি৫) ফাঁকে ৮ মার্চ কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন। 

সাক্ষাৎকারের একটি সংক্ষিপ্ত অংশ আগেই সম্প্রচার করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ অংশটি গতকাল শনিবার  (১১ মার্চ) বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে সম্প্রচার হয় আল-জাজিরায়।

সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে, পশ্চিমা গণমাধ্যমের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় কোথায় ছিলো জাতিসংঘ আর পশ্চিমাদের মানবাধিকার? তিনি বলেন, আমি জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি। আমি বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি।

বছরের শেষে আবারো নির্বাচন আসছে। সেই নির্বাচিন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কিনা, এমন এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের সরকার প্রধান বলেন, অবশ্যই। আমি শতভাগ নিশ্চিত করছি। গত দুটি নির্বাচনে তারা নানা অভিযোগ এনেছে, কিন্তু কোনোটাই প্রমাণ করতে পারেনি। 

তিনি আরও বলেন, দেশে স্বচ্ছ নির্বাচন হয়েছে এবং ভোটাররা আমার দলকে ভোট দিয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। কেন? কারণ তাদের নেতারা দুর্নীতি ও অস্ত্রমামলা, গ্রেনেড হামলা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ছিল।

সাক্ষাৎকারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা আছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যারা নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ আনে, প্রথমেই আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে তারা কারা? তত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। এখন যেসব দল আবার সেই তত্বাবধায়ক সরকার চাচ্ছে, আসলে তারাই এই ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিয়েছিল।

অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বে কারা ছিলেন- এমন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিলো; তারা শুধু মানবাধিকার লঙঘনই করেনি, তারা মানুষকে হত্যা করেছে, আমাদের দেশকে ধ্বংস করেছে, অর্থনীতি ধ্বংস করেছে। সে সময় দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আমাদের দেশের নাম পাঁচবার এসেছে। অন্য অনেকের মতো আমিও ভুক্তভোগী হয়েছি।

বিএনপির আগ্রাসী রাজনীতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা আমাকে একাধিকবার হত্যা করার চেষ্টা করেছে। প্রকাশ্য দিবালকে (২১ আগস্ট) তারা আমার ওপর হামলা চালিয়েছে। নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ আমার দলের ২২ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি এ নিয়ে কোনো তদন্ত, এর কোনো বিচার পর্যন্ত হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, শুধু তাই নয়, তাদের (বিএনপি) দুর্নীতির বিষয় দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রমাণিত হয়েছে। এরপর তাদের সন্ত্রাসবাদ। দেশের পাঁচ শতাধিক স্থানে এক ঘণ্টার মধ্যে তারা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বাংলাদেশকে তারা একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল। তাদের অপকর্মের জন্য তখন জরুরি অবস্থাও জারি হয়েছিল। আমি দেশের মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছি, আমি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি।

আল জাজিরার এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পশ্চিমা গণমাধ্যম যারা আমাকে স্বৈরাচারী শাসক বলে তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, যখন আমার দেশে সেনাশাসন চেপে বসেছিল...তখন তারা কোথায় ছিল? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন আমার বাবা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে, ১৮ জন সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হলো... তারপর সেনা সরকার ক্ষমতা নিলো...তখন আমি দেশে আসতে পারিনি, শরণার্থী হিসেবে আমাকে বিদেশ থাকতে হয়। এমনকি যখন আমি দেশে ফিরলাম, তখন এমনকি খুনিদের বিরুদ্ধে বিচার চাওয়ারও অধিকার আমার ছিল না।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের প্রশংসা করা হয় আল জাজিরার পক্ষ থেকে। অভূতপূর্ব এ সাফল্যের কারণ জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমাদের পুঁজি সীমিত। কিন্তু আমি একটি কথা বলতে পারি, আমাদের দেশের জনগণ খুবই ভালো ও প্রাণবন্ত। আর উন্নয়নের বিষয়টি নির্ভর করে নীতির ওপর। এজন্য আমরা সুর্নিদিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। সে অনুযায়ী আমাদের দীর্ঘমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি, স্বল্পমেয়াদি এবং তাৎক্ষণিক কিছু পরিকল্পনা রয়েছে, যা আমরা বাস্তবায়ন করছি। এভাবেই আমাদের উন্নয়ন তরান্বিত হচ্ছে।  

বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুলাংশে গার্মেন্টস শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। তবে অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ সরকার এর বাইরে অন্য কোনো খাতে গুরুত্ব দিচ্ছে কি-না বা কী করছে তা জানতে চাওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। 

উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার ছিল, গবেষণার মাধ্যমে আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো। এর মাধ্যমে আমরা মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। এছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণেও আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। পাশাপাশি, কীভাবে আরও বেশি মানুষের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা যায়; সেদিকেও আমরা নজর দিয়েছি।

দেশের আর্থিক উন্নয়নে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সব দিক উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আমাদের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছি। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছি। তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করেছি। আমাদের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও উল্লেখ ছিল যে, বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল দেশ।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের আইসিটি খাতে গুরুত্বারোপের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এখন দেশের সর্বত্র ইন্টারনেট আছে। সাবমেরিন ক্যবল, ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে আমরা মানুষের কাছে পৌঁছেছি। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছিলাম; এখন দেশের প্রতিটি অঞ্চলে, প্রতি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে।

চলমান অর্থনৈতিক সংকট, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আল জাজিরাকে বলেন, আমাদের আর্থিক নীতি খুবই সময় আবদ্ধ। জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে এবং চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এর মাধ্যমে তারা নিজেরাই তাদের ভাগ্য গড়বে। এভাবেই আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রশংসা করে এ বিষয়ে জানতে চায় আল জাজিরা। এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে আমাদের জনগণ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হন এটা সত্য। তবে আমরা জানি, এটি কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় এবং এ বিষয়ক সব প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। 

বাংলাদেশের সরকার প্রধান জানান, ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় আমরা জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছি এবং এসব এলাকার উন্নয়নেও আমরা কাজ করছি যাতে সেখানকার মানুষ ভালো জীবনযাপন করতে পারে। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে সহায়তা করার জন্য আমরা ৮৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশের নদী-খালগুলো খননে জোর দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।  

সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গা ইস্যুতেও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। জানান, মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিতে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে না। যখন ঘটনার সূত্রপাত্র হয় তখন অনেক রোহিঙ্গা নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আমাদের খুব খারাপ লেগেছিল। তাই আমরা সীমান্ত খুলে দিয়ে তাদের আসতে দেই। 

তিনি আরও বলেন, মানবিক দিক থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। একইসঙ্গে আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করি। তাদের বলি, রোহিঙ্গারা তোমাদের দেশের নাগরিক, তাদের ফিরিয়ে নেয়া উচিত। তবে, দুর্ভাগ্যবশত মিয়ানমার ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে না। আমি মনে করি, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া উচিত।

রোহিঙ্গাদের ভালো ব্যবস্থাপনায় রাখতে বাংলাদেশ সরকার কাজ করছে জানিয়ে শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমরা তাদের জন্য ভাসানচরে আবাসনের ব্যবস্থা করেছি। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরের পরিস্থিতি খুব ভালো না। তারা এখন নিজেদের মধ্যেই সংঘাতে জড়াচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।

দেশের উন্নয়নের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমরা গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রেখেছি। যার কারণে দেশে ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে। আমাদের জিডিপি বাড়ছে। আমার বাবা বেঁচে নেই। কিন্তু আমি তার আদর্শ অনুসরণ করি। আমি চেষ্টা করি, তিনি যেভাবে দেশের চেয়েছিলেন সেভাবেই দেশের মানুষের সেবা করতে। এ কারণেই ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের চেহারা অনেকটাই পাল্টে গেছে। আমি বলব, আমার পিতার দোয়ার কারণেই আমি দেশের জন্য কাজ করতে পেরেছি।


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh