খুনের আসামির দোকান উদ্বোধনে দুবাইয়ে সাকিব

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৩, ০৬:৫৬ পিএম | আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৩, ০৬:৫৯ পিএম

রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভ খান এবং ক্রিকেট অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। ছবি: সংগৃহীত

রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভ খান এবং ক্রিকেট অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বসেরা ক্রিকেট অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান দুবাইয়ে আজ বুধবার (১৫ মার্চ) যার জুয়েলারি দোকান উদ্বোধন করবেন তিনি হত্যা মামলার পলাতক আসামি। আরাভ জুয়েলার্স নামে ওই দোকানটির উদ্বোধনে সাকিবের পাশাপাশি উপস্থিত থাকবেন দীঘি, হিরো আলমসহ শোবিজের অনেকে। থাকবেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিচালক দেবাশীষ বিশ্বাস, গায়ক নোবেল, রুবেল খন্দকার, বেলাল খান, জাহেদ পারভেজ পাভেলের মতো অনেকে। 

কে এই আরাভ জুয়েলার্সের মালিক?

জানা যায়, দুবাইয়ের এই বিলাসবহুল দোকানের মালিকের নাম রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভ খান, যিনি দেশে পুলিশ হত্যা মামলায় পলাতক আসামি। 

গণমাধ্যম বলছে, রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভ খান ঢাকায় পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) স্কুল অব ইন্টেলিজেন্স পরিদর্শক মামুন ইমরান খানকে হত্যা মামলার ৬ নম্বর পলাতক আসামি। তথ্য নিশ্চিত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের মতিঝিল বিভাগ।

হত্যা মামলার এজাহার অনুযায়ী, রবিউল ইসলাম আসল নাম হলেও ‘আপন’ ওরফে ‘সোহাগ’ ওরফে ‘হৃদয়’ নামেও তিনি পরিচিত। পুলিশের জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে তিনি পলাতক আসামি। পরে পাসপোর্টের নাম পরিবর্তন করে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। নাম নেন আরাভ খান।

আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, হত্যা মামলার সাজা থেকে বাঁচতে আবু ইউসুফ লিমন নামে এক তরুণকে বিকেএসপিতে খেলার সুযোগের প্রলোভন দেখান আরাভ। এই প্রলোভনে লিমন আদালতে আরাভের বদলে আত্মসমর্পণ করেন। পরে আদালত লিমনকে কারাগারে পাঠায়।

এই ফাঁকে আরাভ ঊর্ধ্বতন এক সরকারি কর্মকর্তার সহায়তায় নকল পাসপোর্ট বানিয়ে দেশত্যাগ করে দুবাইয়ে চলে যায়। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে লিমনকে আদালত খালাস দেয়।

এদিকে, ডিবির অনুসন্ধানেও রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভের নিজের বদলে অন্যকে আসামি বানিয়ে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি প্রমাণিত হয়। পরে সেই ব্যক্তি পালিয়ে চলে যান ভারতে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভারত থেকে বানিয়ে নেন একটি পাসপোর্ট। ভারতীয় নাগরিক পরিচয়েই বসবাস শুরু করেন দুবাইতে। সেখানে আরাভ নামে একটি জুয়েলারি নেন। সেই দোকানের উদ্বোধন করতেই দুবাই গেলেন ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান ছাড়াও বাংলাদেশ শোবিজ অঙ্গনের একঝাঁক তারকা।

বিষয়টি নিয়ে খোদ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীতেই চলছে তোলপাড়। তাদের বিস্ময়, খুনের মামলার এক আসামি কীভাবে দুবাই গিয়ে এত সম্পদের মালিক হলো!

প্রকাশ্যে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৮ জুলাই রাতে নিখোঁজ হন এসবির পরিদর্শক মামুন ইমরান খাঁন। পরিবারের সদস্যরা তার খোঁজ না পেয়ে পরদিন সবুজবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সেই জিডির তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিম জানতে পারে, রহমত নামে এক বন্ধুর সঙ্গে মামুন ইমরান বনানীর একটি বাসায় আফরিন নামে এক কথিত মডেলের জন্মদিনের পার্টিতে গিয়েছিলেন। সেখানে আফরিনের সহযোগীরা তাকে ব্লাকমেইল করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে করা হয়। সেই মরদেহ উদ্ধার করা হয় গাজীপুরের একটি বাঁশঝাড় থেকে।

দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ পুলিশ রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় ওরফে হৃদিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এ সময় রবিউল ইসলাম ওরফে আপন পলাতক ছিলেন। আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর রবিউল ইসলাম ওরফে আপন নামে ওই ব্যক্তি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

সূত্র জানায়, পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খাঁন হত্যাকাণ্ডে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপনের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার আশুতিয়ায়। তার বাবার নাম মতিউর রহমান মোল্লা। আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর আপন নিজেকে বাঁচানোর জন্য ফন্দি আঁটেন। কৌশলে চাঁদপুরের কচুয়া থানাধীন সিংআড্ডা এলাকার নুরুজ্জামানের ছেলে আবু ইউসুফকে অর্থের প্রলোভনে তার বদলে আদালতে আত্মসমর্পণ করাতে রাজি করেন।

অর্থের লোভে আবু ইউসুফ নিজেকে রবিউল ইসলাম ওরফে আপন পরিচয় দিয়ে আত্মসমপর্ণ করেন। আদালত আবু ইউসুফকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। পরে আপন তার পরিবারকে অর্থ দেয়া বন্ধ করে দিলে ইউসুফ বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষকে জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মহানগর দায়রা জজ ফয়সল আতিক বিন কাদির ২০২১ সালের ২ মার্চ বিষয়টি তদন্ত করার জন্য মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে আদেশ দেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে রবিউল ইসলাম ওরফে আপনের নামে আবু ইউসুফের কারাবন্দি থাকার বিষয়টির প্রমাণ পায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিজের বদলে আবু ইউসুফকে কারাগারে পাঠানোর আগেই আপন ভারতে পালিয়ে যায়। ২০২০ সালের ২৮ জুলাই তিনি পশ্চিমবঙ্গের নরেন্দ্রপুর উদয় সংঘ ক্লাব এলাকার বাসিন্দা হিসেবে একটি ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। জালিয়াতি করে বানানো ওই পাসপোর্টে তার বাবার নাম হিসেবে ব্যবহার করেন জাকির খান, মায়ের নাম দেন রেহানা বিবি খান এবং স্ত্রীর নাম সাজিমা নাসরিন। তার ভারতীয় পাসপোর্ট নম্বার ইউ ৪৯৮৫৩৮৯।

সূত্র জানায়, ভারতীয় পাসপোর্ট সংগ্রহ করে আপন আরাভ নাম নিয়ে দুবাই যাতায়াত শুরু করেন। তার পাসপোর্টে শেনজেন ভিসাও রয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, রবিউল ইসলাম ওরফে আপনের বাংলাদেশি একটি পাসপোর্টও তারা পেয়েছিলেন। হৃদি শেখ নামে ওই পাসপোর্টের (নম্বর এনও ০৩৮৫১৮৮) সূত্র ধরে পুলিশের বিশেষ শাখায় চিঠি দিয়ে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়। কিন্তু তিনি বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশত্যাগ করেননি।

বিষয়টি জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, খুনের মামলার ফেরারি আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে আরাভের দুবাইয়ে জুয়েলারি ব্যবসার বিষয়টি তাদের নজরে এসেছে। এ বিষয়ে তারাও আনুষ্ঠানিকভাবে খোঁজখবর শুরু করেছেন। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য সহযোগিতা চাওয়া হবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh