সংকটই ব্যাংক খাতের সঙ্গী

এমএইচ রশিদ

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৩, ০৯:০৯ এএম

বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি: সংগৃহীত

খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি ও সুশাসনের ঘাটতি ব্যাংক খাতের পুরনো সংকট। এখন যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার সংকট এবং আমানতকারীদের আস্থাহীনতা। বড় কয়েকটি ব্যাংকে মালিকপক্ষের নজিরবিহীন দুর্নীতির কারণে আমানতকারীদের মধ্যে কিছুটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এ কারণে অনেকেই ব্যাংক থেকে জমানো অর্থ তুলে নিয়েছেন, আবার অনেকেই অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর করেছেন।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। এসব প্রভাবে ব্যাংকিং খাতের ওপর আরও নেতিবাচকভাবে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে, ব্যাংক পরিচালনায় এখনো সব নীতি পরিপালন করা হচ্ছে না। তবে নিয়মের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। 

বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় আর্থিক কাঠামো অনেক ছোট হলেও বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের সংখ্যা ৯টি। বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৪৩টি এবং বিদেশি মালিকানাধীন ব্যাংক রয়েছে ৯টি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রায় সবগুলোই একক ব্যক্তি, পরিবার বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও নিয়ন্ত্রিত। এই ব্যাংকগুলোর অনুমোদন পাওয়া এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব সবচেয়ে বেশি বিবেচিত হয়েছে। 

দেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালনার ত্রুটি রয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘নৈতিকতা ও সুশাসন ব্যাংকিংয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ব্যাংক খাতে এর কিছু ব্যত্যয় হচ্ছে। কিছু ব্যাংকের পরিচালক নিজেদের ব্যাংকের মালিক মনে করছেন। আবার কিছু ব্যাংকার তাতে সহায়তাও করছেন। ব্যাংক পরিচালনায় পরিচালক ও ব্যবস্থাপকের ভূমিকা কী হবে, তা নির্দিষ্ট করা আছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, তথ্য প্রকাশ ও নৈতিকতা বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।’

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। রাজনৈতিক ও ব্যক্তির দুর্নীতির কারণে নানা সংকট শুরুতেই ছিল। এই খাতের উন্নয়নে বেসরকারিভাবে ব্যাংক চালুর সিদ্ধান্তও সুশাসনের ঘাটতি দূর করতে পারেনি, বরং ভিন্নমাত্রায় মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে যারা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের অধিকাংশ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছেন।

এর ফলে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকের অ্যাননটেক্স কেলেঙ্কারি, ইসলামী ব্যাংকের মালিকপক্ষের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ছে। কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির সংবাদ গ্রাহকদের আতঙ্কিত করে তুলছে। এ পরিস্থিতিতে মুডি’সের ঋণমান অবনমন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবে। এতে ব্যাংকের আমদানি-রপ্তানিসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কমিশন বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যও হুমকিতে পড়তে পারে।

সুশাসনের ঘাটতি ও ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণকে এখন দেখা হচ্ছে দেশের ব্যাংক খাতের দুষ্টচক্র হিসেবে। ব্যাংক পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনকানুন ও বিধিমালা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই এর ব্যত্যয় ঘটে। ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনায় পর্ষদ সদস্যদের অনৈতিক হস্তক্ষেপ, প্রভাব খাটিয়ে নিজ ব্যাংক থেকে পরিচালকদের বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া, এক ব্যাংকের পরিচালকের অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া, নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ঋণ প্রদান, পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই ঋণ প্রদান, ভুয়া নথিপত্র জমা দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার মতো অনেক নজির রয়েছে। সুশাসনের এ ঘাটতিকেই এখন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। তবে খেলাপির তুলনায় ব্যাংকগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ চার গুণ বেশি। বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি, পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনসহ দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা।

শুধু ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পাঁচ বছরেই ব্যাংকগুলো ১ লাখ ২০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। দুর্দশাগ্রস্ত এসব ঋণের বড় অংশই বেসরকারি ব্যাংক পরিচালক ও উদ্যোক্তাদের। পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে এসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। খেলাপি হওয়ার পর ব্যাংকাররা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিচালকদের ঋণই পুনঃতফসিল করছেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতের সুশাসনের ঘাটতির জন্য সবপক্ষই দায়ী। ব্যাংকগুলো আইন ভাঙছে, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইন মানাতে যথেষ্ট কঠোরতা আরোপ করছে না। নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় অনেক গাফিলতি রয়েছে। ঋণখেলাপিদের ওপর কঠোর না হয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এটিই এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংক খাতের জন্য সবচেয়ে বড় চাপ। এসব বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছাড়া ব্যাংক খাতের ঝুঁকি কমানো যাবে না।’

ব্যাংক খাতের পুরনো সংকটগুলো নতুন করে আলোচনায় আসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের বিষয়টি সামনে আসার পর থেকে। আইএমএফ বাংলাদেশে জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। তবে এই ঋণের জন্য বাংলাদেশকে অনেকগুলো শর্ত জুড়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক এই সংস্থা। দেশের আর্থিক ও ব্যাংক খাতের জন্যও বেশকিছু শর্ত ও সংস্কার বাস্তবায়নের শর্ত দেওয়া হয়েছে। 

আইএমএফ মনে করছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্রমবর্ধমান ও খেলাপি ঋণের উচ্চহার এবং নিম্ন মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত এ খাতের অর্থায়ন সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করবে। একই সঙ্গে সরকারের আর্থিক বোঝা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রবৃদ্ধিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ জন্য সুশাসন, নিয়ন্ত্রণ, তদারকি ও আর্থিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কাঠামোগত দুর্বলতাসহ ব্যাংকের দুর্বল পারফরম্যান্সের মূল কারণ চিহ্নিত করা, খেলাপি ঋণের ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানো, খেলাপি ঋণ কমানোয় ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ভ‚মিকা পুনর্মূল্যায়ন করতে বলেছে আইএমএফ। 

এছাড়া ঝুঁকিভিত্তিক ব্যাংকিং তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং ফাইন্যান্স কোম্পানি আইনের সংশোধন, মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে ইন্টারেস্ট রেট করিডোরের ব্যবস্থা নেওয়া, আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাবায়ন ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করার উদ্যোগ গ্রহণের শর্ত দেওয়া হয়েছে। 

ঋণ পুনঃতফসিলের সময় কমানো, ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে আর্থিক সম্পদ ও দায় শ্রেণিকরণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ নিশ্চিত করা এবং ব্যালান্সশিটের দুর্বলতা কমাতেও সংস্কারমূলক উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেছে আইএমএফ। এর পাশাপাশি সংস্থাটির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও রিপোর্টিংয়ের মান বৃদ্ধি, নজরদারি ও নীতি প্রণয়নের সক্ষমতা বাড়ানো এবং বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত বার্ষিক ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে ব্যাংকের মন্দ ঋণ ও পুনঃতফসিল করা ঋণের তথ্য প্রকাশের কথাও বলা হয়েছে। 

এ সংকটের সঙ্গে প্রকট হয়েছে ডলার সংকট। ডলার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশি। দীর্ঘদিন ধরেই দেশে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫-৮৬ টাকা। গত বছরের এপ্রিলেও তা ছিল ৮৬ টাকার ঘরে। এর পর থেকেই শুরু হয় মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ১৩ মার্চ আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের বিনিময় হার সর্বোচ্চ ১০৭ টাকায় উঠেছিল। গত ৬ মার্চ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে ১ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোয় ডলার সরবরাহ কমে সংকটের মাত্রা বাড়ার বড় আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। নগদ ডলারের দাম ব্যাংকে ১০৯ টাকা এবং খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৩ টাকা থেকে ১১৫ টাকা পর্যন্ত। ডলার সংকটের কারণে দেশের নিত্যপণ্যের বাজারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে।

ব্যাংক খাতের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির আলোচনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি ব্যাংক বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। আমানতকারীরা অর্থ তুলে নেওয়ায় সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক এবং সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। আমানতকারীদের অর্থ তুলে নেওয়ার ঘটনায় ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ফারমার্স ব্যাংক বন্ধের উপক্রম হয়। তবে নাম পাল্টে পদ্মা ব্যাংক নামে ধুঁকছে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংক। 

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যে ব্যাংক দুটি দেউলিয়া হয়ে গেছে, সেটির চেয়েও দুর্বল ব্যাংক দেশটিতে রয়েছে। দুবাইয়ের একটি শক্তিশালী ব্যাংক একদিনের মধ্যে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। ব্যাংক টিকে থাকে গ্রাহকদের আস্থার ওপর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ ভূমিকা থাকলে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার সুযোগ নেই। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে জনগণের একযোগে কোনো ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার মতো মানসিকতা নেই। গণমাধ্যমসহ সব পক্ষ দায়িত্বশীল আচরণ করলে বাংলাদেশে কোনো ব্যাংকের দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা নেই।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh