বঙ্গবন্ধু-গবেষণা

মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৩, ১১:৩৪ এএম

মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম। ফাইল ছবি

মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম। ফাইল ছবি

যে সমস্ত বিষয় বিচার-বুদ্ধির অধীন, সে সব বিষয়ে কথা বলা আজ কঠিন। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া যে-সমস্ত বিষয় মেনে নেওয়া যায় না, সে সব বিষয়ের চর্চা আজ সহজ নয়। আমাদের স্থান ও কাল আজ এতটাই বিরুদ্ধ। আজ আমাদের বেঁচে থাকার অর্থ মনে হচ্ছে কেবলি দিনগুজরান। তেলাপোকার মতো বেঁচে থাকা- খেয়েপরে, জীবনের প্রশ্নহীন দিন যাপন আজ আমাদের একমাত্র কাজ।

যে-বাঙালি বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন করেছেন, যে-বাঙালি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, সেই বাঙালি আজ কোথায়! এই বাঙালির গভীর উপস্থিতি-সংকটই আজ শুদ্ধবুদ্ধির সংকট। ইতিহাস বিচার তেমনি একটি সংকট। ইতিহাসের শিক্ষার্থী মাত্রই জানেন যে, মানববিদ্যার যত বিষয় আছে, তার মধ্যে ইতিহাস একটি সেক্যুলার বিষয়। শুধু তাই নয়, ইতিহাস নিজেই একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। ইতিহাস অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না। কৃতিত্বই তার স্বধর্ম।

কেননা ইতিহাস তৈরি হয় কৃতিত্ব দিয়ে, অস্তিত্ব দিয়ে নয়। আমরা অনেকেই অস্তিত্বে বিশ্বাস করি, কারণ আমাদের কৃতিত্ব নেই। বঙ্গবন্ধু অস্তিত্ব স্বীকার করতেন, কিন্তু তাতে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিল কৃতিত্বে। তিনি জেনেছিলেন অস্তিত্বের সঙ্গে জড়ের সম্পর্ক আছে, কিন্তু মানুষের মধ্যে আছে অস্তিত্ব অতিক্রমী এক চেতনা। সেটা একদিকে যেমন অস্তিত্বকে মান্যতা দেয়, তেমনি তাকে অতিক্রম করে, এবং একই সঙ্গে বাড়িয়ে তোলে আত্মস্বরূপকে। ব্যক্তি থেকে বিশ্বের দিকে এই আত্মস্বরূপের প্রকাশ।

কেমন করে কীভাবে বঙ্গবন্ধুর মধ্যে এই কীর্তির প্রকাশ ক্রমাগত নানা বাধার ভিতর দিয়ে এগিয়েছে, স্থান ও কালের বৈশিষ্ট্যের পরিচয়ের সঙ্গে সেই কীর্তিও ইতিহাস লেখা একটা জাতীয় কর্তব্য হিসেবে দেখা যেতে পারে। এখন পর্যন্ত এ কর্তব্য সম্পর্কে আমরা ভালোভাবে সচেতন হয়ে উঠিনি মনে হয়। কেননা এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কোথাও কোনো উল্লেখযোগ্য অভিসন্দর্ভ লেখা হয়নি। না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে, না কোনো উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। তাঁকে নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি কোথাও হয়েছে, শোনা যায়নি, যদিও তিনি পিএইচডির থেকে বহুগুণ বড়।

কেন তাঁকে নিয়ে গবেষণা? এ ব্যাপারে মোটাদাগে দু-একটি কথা প্রস্তাব আকারে পেশ করা যাক। আজ আমরা তাঁকে বঙ্গবন্ধু বলে জানি। তিনি একটা মহান জাতির স্রষ্টা। বাঙালি জাতির জনক বলে তিনি নন্দিত। তাঁকে আমরা বলছি, তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁকে না-হলে বাংলাদেশ হতো না, বাঙালি জাতির পরিচয় তাঁর কীর্তির সঙ্গেই যুক্ত। তাঁর এই সব পরিচয়ের ভিত্তি শুধু রেডিও-টেলিভিশনের পর্দায় আটকে থাকলে চলবে না। চলবে না তাঁর এত বড় বড় পরিচয় কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীর মুখে মুখে জীবিত থাকলে। 

কোন পুণ্যের বলে, কী গুণের সজীবতায় তাঁর এই সব পরিচয় আজ সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হলো, তার প্রত্যেকটি স্তর, তার প্রত্যেকটি পর্ব বিশদ-ব্যাখ্যায় লেখা দরকার। আমরা ভুলে যাব না উপস্থাপিত বিষয়ে তথ্য হবে প্রামাণ্য, ব্যাখ্যা হবে নির্ভুল, যুক্তি হবে অকাট্য, তবেই তত্ত্ব মান্যতা পাবে। এর ব্যতিক্রমে, শুধু মুখের কথা হাওয়ায় উড়ে শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে। একমাত্র লেখার কথা- যার ভিত্তি সংবাদপত্র নয় কেবল, যা প্রামাণ্য নজিরের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাই বেঁচে থাকে। গবেষণা বলতে শিক্ষিত লোকে তাই বোঝেন যা এই সত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।

বঙ্গবন্ধুর যে সব পরিচয় আজ বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, উল্লিখিত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তার একটি। বাঙালির এই হাজার বছর কখন থেকে শুরু হয়েছে, এ কথার মীমাংসা আজও হয়নি। কেননা বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদের প্রামাণ্য রূপ এ পর্যন্ত অপ্রস্তুত রয়েছে। এটা যে বাংলা ভাষা অনেক বিদ্বানই তা স্বীকার করেননি। বাংলা ভাষা ছাড়া বাঙালি জাতির কল্পনা আসত না। 

আমরা মানতে বাধ্য যে, বাংলা ভাষা ও তার অক্ষরমালা নিয়ে বাঙালির পরিচয়ে পর্বের সূচনা। এ দুটির উদ্ভব এবং বিকাশ ঘটে মুসলিম রাজত্বকালে। মুসলিম সুলতানরা এর পৃষ্ঠপোষক ও উদ্যোক্তা। মোগলরা যেটাকে ‘সুবে বাংলা’ নাম দিয়েছেন, দেখা যায়, তাই আসলে বাংলা ও বাঙালির সাধারণ পরিচয়ের আদি ভিত্তি। এটা সত্য হলে, আমাদের ধারণা সত্য, তাহলে হাজার বছরের ধারণা নিয়ে গবেষণা চলতে পারে। বিস্মৃত হলে চলবে না যে, বহুকাল পূর্বে প্লেটো আবেগের সঙ্গে সত্যকে মেলাতে বলেছিলেন।

এই যে বস্তুগত ইতিহাসের ধারণা, বাঙালি কোনো হিন্দু ঐতিহাসিক অবশ্য আজও এই সত্য স্বীকার করেননি। এই সত্যে ভুল আছে সেটাও তাঁরা প্রমাণ করতে পারেননি। মোটকথা, এই সময় থেকে অসংখ্য মনীষীর জন্ম হয়েছে। বাংলা ও বাঙালির ধারণা গড়ে তোলায় এবং গড়ে ওঠায় এসব মনীষীর অবদান স্বীকার্য। তাদের অবদানে বাঙালির স্বরূপ ধীরে ধীরে বিকাশ ও প্রকাশ লাভ করে। 

ইতিহাসের এই বিকাশ ধারায় একটা পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক জাতিসত্তা রূপ নেয় আজকের বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ফলে। এ এক অসাধারণ ও অভ‚তপূর্ব রাজনৈতিক সংগ্রামের ফল। সন্দেহ নেই বঙ্গবন্ধু এর মুকুটমণি। বিশেষ গবেষণার ভিতর দিয়ে আমাদের এই কথা জানাতে হবে। আজকের জন্যে না-হোক, আগামীকালের জন্যে প্রয়োজন হবে। কালান্তরে, প্রজন্মান্তরে এই তত্তে¡র অমলিন রূপ যিনি অক্ষুণ্ন রেখে যাওয়ার প্রয়াসে বিরক্ত হবেন, ধৈর্য হারাবেন, তিনি মুখে বঙ্গবন্ধুর হিতৈষী হলেও কার্যক্ষেত্রে সুবিধাবাদী।

বঙ্গবন্ধুর পরিচয়কে খাটো করে দেখা, তাঁর জীবনব্যাপী সাধনাকে অস্বীকার করবার চেষ্টা আজ আমাদের প্রতিহত করতে হবে এক একটা পর্বের এক একটা গবেষণা-কর্মের মাধ্যমে। এ জন্যে অবশ্য দীর্ঘ দিনের ও বহু শিক্ষিত আর বিবেকী গবেষকের নিরলস শ্রম ও চেষ্টা দরকার হবে। বঙ্গবন্ধু-গবেষণাকে নিতে হবে বাঙালির আত্মপরিচয়ের একটা প্রধান ইস্যু হিসেবে। কেননা তাঁর কীর্তির মধ্যে ছিল একটা সেক্যুলার জাতির সংগঠনের সংকল্প। বাঙালি জাতি আর বাঙালির জন্যে একটা সুন্দর রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা ছিল সেই সংকল্পের সর্বপ্রধান লক্ষ্য।

বাংলা ভাষা ও বাঙালির সেক্যুলার বৈশিষ্ট্য যদি রক্ষা না পায়, তবে বঙ্গবন্ধু হবেন কেবল ইতিহাসের ব্যাপার। এ জন্যে প্রত্যেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বাংলা একাডেমির মতো উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু-গবেষণা সেল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাঁকে কেবল রাজনৈতিক ইস্যু করে নয়, বাঙালির অস্তিত্ব, বাঙালির কৃতিত্ব এবং বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ লক্ষ্য করেই এটা জাতীয় কর্তব্যের মধ্যে নিতে হবে। জয়তু বঙ্গবন্ধু!

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh