বাঘের চোখে চোখ

আরিফুল হাসান

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৩, ১২:১৩ পিএম

গল্প। প্রতীকী ছবি

গল্প। প্রতীকী ছবি

ঘুমের ভেতর দুঃস্বপ্নের মতো শিশির দেখে কেউ তার বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। আকাশে বাতাসে উড়ছে শকুন, বড় বড় ঠোঁটওয়ালা বীভৎস শকুন। লম্বা গলাওয়ালা সেসব শকুন খেয়ে নিচ্ছে সভ্যতার ভাগাড়। সে দেখে, লাশের পর লাশ বিছিয়ে পড়ে আছে চারপাশে। শুধু মৃত্যু, শুধু মৃত্যুর উৎসবে ঘুম তার ভেঙে চুরমার হয়। সে দেখে, অন্ধকারের ভেতর থেকে জ্বলে ওঠে আগুন।

সে দেখে, সে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে শান-কাওনের মাঠ, সে দেখে, সে আগুনে ঝলসে যাচ্ছে মানুষের চোখের মণি এবং মণির বিপরীতে জ্বলে ওঠে অগ্নিগোলক। সে দেখে, তার বাবা আবার ফিরে এসেছে; কাঁধে রাইফেল, হাতে দেশের পতাকা উঁচিয়ে তার বাবা ফিরে আসে। তবে যুদ্ধ শেষ হয় না। তার বাবা আবার ফিরে যায়। তার সাথে ফিরে যায় আরও অনেকগুলো মানুষ। তাদের তাম্বুল গ্রামে, পাশের নানাবাড়ি বিরানপুর থেকে, অদেখা-দেখা হায়দ্রাবাদের আরও বহু মানুষ যোগ দিয়েছে তার বাবার সাথে। হ্যাঁ, কারা যেন তার বাবার গুদামটা পুড়িয়ে দিয়েছে, তাতে ভয় পায়নি তার বাবা।

নতুন উদ্যমে গামছা বেঁধে কোমরে, আবারও ঝাঁপিয়ে পড়েছে যুদ্ধে। সে দেখে, স্বপ্নের ভেতর বহুদিন পরপর ফিরে আসে বাবা, বলে- এসব এলাকা এখনো যুদ্ধমুক্ত হয়নি। তাদেরকে সাবধানে থাকতে বলে। বলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে। তারা যায় না। তার মা যায় না। শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে, বাপ-মায়ের কবর ছেড়ে সে আর কোত্থাও যাবে না। সে দেখে, বাবার শৌর্য তার মায়ের মুখে খেলা করে।

বাবা তার হেসে বলে- বিখ্যাত বাজার আন্দোলনের নেতা মহান বাপের মতো মেয়ে হইছে। মা তার নিঃশব্দ হাসে। মা ভাত রাঁধে, একজনের না, দুই জনের না, অসংখ্য মানুষের। অসংখ্য মানুষের আনাগোনা হয় তাদের বাড়ির উঠোনে। ঘুমের ভেতর শিশির এত এত মানুষ দেখে পুলকিত হয়। আবার আনন্দ তার মাটি হয় যখন দেখে স্বপ্নের ভেতর শেয়ালও আসে।

যখন দেখে নদীর জল সব আগুনের ঢেউ হয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে হাহাকার আর আগুনের নদী বেয়ে ভেসে আসছে লাশ আর লাশ। যখন দেখে স্বপ্নে তার শকুনের পাখার ঝাপটা, তখন ঘুমটা তার দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সে খবর পায়, তার বাবার সহযোদ্ধা একজনের মৃত্যু হয়েছে, দুই জনের মৃত্যু হয়েছে, পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে, অমুকের পা উড়ে চলে গেছে, তখন তার ঘুম আরও মৃত্যুময় হয়। শিশির ঘুমের ভেতর হয়তো কেঁদে ওঠে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুলে ওঠে বুক।

সে তার স্বপ্নের ভেতর পুষে একটি আনন্দ আর একটি বেদনা। সেই স্বপ্নেরই এক পর্যায়ে তার বাবা আর অনেক দিন আসে না। আসে না, আসে না। তখন তার বেদনা আরও গাঢ়তর হয়। তার বেদনার লাগামহীন যাপনচিত্রে হঠাৎ শুনতে পায় তার নানার বাড়িঘর সব পুড়িয়ে দিয়েছে, বলগ্রাম আর মজমাগ্রামে ক্যাম্প গেড়েছে হানাদাররা আর মজমাকান্দি বাজারে হানাদারদের দোসরদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে।

শিশির দেখে, তার মা চিন্তিত হয়ে চোখ মোছে, কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মোছে। শিশির দেখে, স্বপ্নের ভেতর তার মা তাকে নিয়ে চলতে শুরু করে। রাত গভীর, অন্ধকার কেটে কেটে তার মা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে আঁচ করতে পারে না। যেন চেনা পথ নয়, যেন এ পথে সে কখনো আসেনি। সেই অচেনা অন্ধকারে ঝোপে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তার মা নিঃশব্দ চলছে সরীসৃপের পা রেখে।

চলতে চলতে সে তার মাকে বলে- মা, তুমি ক্লান্ত হও নাই তো, মা মাথা নাড়ে। হাত দিয়ে খোকার চুল আঁচড়ে দেয়। আঁচলটা টেনে আরও ঢেকে দেয় শিশিরকে। রাত চলছে, মা কোথায় চলছে জানি না, মা, মা, ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাও সোনা, আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাও, শিশির ঘুমায়। মা তাকে কোথায় রেখে নিরুদ্দেশ হয় জানি না।

স্বপ্নের ভেতর এবার তার ঘুম ভাঙে। তার বাবা ফিরে আসে আবার। হাতে সেই স্বদেশের পতাকা। কাঁধে রাইফেল। গলায় বিজয়ের মালা, চোখে অশ্রু। সারা দেহ আঘাতে ঝরঝর, শতচ্ছিন্ন বস্ত্র, পায়ের গোড়ালি ফেটে চৌচির হয়ে আছে। মেটে রঙটা আরও পুড়ে বাবা তার ছাই রঙা হয়ে গেছে। অনাহারে অর্ধাহারে, দেহতার হয়েছে কঙ্কালসার। মুখের বলিরেখাগুলো, আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে মহাকালের অভিজ্ঞতার জানান দিচ্ছে। বাবা ঘরে ফিরেছে, ফিরেছে ঠিকই, কিন্তু ঘরে তার মনভারি আরও বেশি বেড়ে যায়। সবসময় চুপ থাকে বাবা, কম কথা বলে, ক্ষণে ক্ষণে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। শূন্য ঘরটার একা যন্ত্রণা বাবা সহ্য করতে পারে না। 

দলে দলে লোকজনেরা আসে, পত্রিকার লোকেরা আসে। বাবা মেপে মেপে কথা কয়। বাবার সহযোদ্ধারা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতে গিয়ে তারই মতো চুপসে গিয়ে মলিন মুখে ফেরে। বাবা আরও গম্ভীর হয়ে যান। শোনা যায়, বাবা তার ব্যবসাটা আবার চালু করবেন। শোনা যায়, মজমাকান্দি বাজার আবার বিরানপুর আর হায়দ্রাবাদের লোকেদের হয়েছে। শোনা যায়, বলগ্রাম আর মজমাগ্রামে এখন আর কোনো মানুষ অবশিষ্ট নাই।

হয় শকুনের পেটে, না হয় পালিয়েছে কোথাও, শেয়াল-হায়েনার মতো ঘাপটি মেরে আছে। শোনা যায়, মুক্তিযোদ্ধারা তাদের খুঁজে খুঁজে বের করছেন। শোনা যায়, মজমাগ্রামের আকাশে এখনো শকুনগুলো রয়ে গেছে। বলগ্রাম জঙ্গলের বড় বড় গাছগুলোতে, তারা বিশ্রাম নিচ্ছে এখনো। শোনা যায়, এ সবই স্বপ্নের ভেতরে, তার প্রিয় বাংলাদেশ ফিরে এসেছে, শোনা যায়, শুধু ফেরেনি তার মা। 

এবার ঘুম থেকে সত্যি সত্যি জেগে ওঠে শিশির। জেগে উঠে তার মাকে খুঁজতে বের হয়। তখনও আলো পুবদিকে ওঠেনি। ঘুমের সূর্য তখনও আড়াল হয়নি অন্ধকার থেকে। সেই আবছায়া থেকে পথ চিনতে, চিনে নিতে শিশিরের অসুবিধা হয় না। সে পুকুরের উত্তরপাড় ঘুরে পশ্চিম পাড়ে নেমে যায় পৌষ শেষের মাঠে। মাঠের প্রাথমিক প্রান্তরগুলো শর্ষে চাষে ভরে আছে। বিঘা কি বিঘা জমি প্রশস্ত ঘন শর্ষের ভেতর সে লুকিয়ে যেতে পারে সহজেই।

তার উপর আবার সকালের আবছায়া না কাটতেই যেহেতু বেরিয়েছে তাই তাকে দেখার সুযোগ এ মুহূর্তে কারো নেই। তবু সে সতর্কতা অবলম্বন করে। একটু পরে শিশু মিয়া- তার আব্বু, ঘুম থেকে জেগে তাকে দেখতে না পেলে নিশ্চয়ই ডাকবে, তারপরে খুঁজতে বেরোবে। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে এলে হয়তো তার অস্তিত্ব টের পেয়ে যাবে। তাই সে দ্রুত হাঁটে, হাঁটে না, যেন দৌড়ায়। দৌড়াতে দৌড়াতে সে সোজা তাম্বুলগ্রামের মাঠ ছাড়িয়ে যায় সূর্য ওঠার আগেই।

সূর্য উঠে গেলে সে তখন বিরানপুর মাঠের ভুট্টার আড়ালে নিজের ছোট্ট দেহের আবছায়া বাঁচিয়ে ছুটতে থাকে আরও উত্তরে, আরও উত্তরে, আরও উত্তরে। ছুটতে ছুটতে সে বিরানপুর কবরের কাছে চলে আসে। এখানে তার নানা-নানি সমাহিত। সে একটু থামে। আবার সে পথ চলতে থাকে বুকে ক্রল করে বিস্তৃত সরিষা মাঠের আড়ালে। কৃষকরা একেক করে আসছে মাঠে।

কেউ তাকে দেখছে না, অথবা সে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে অলৌকিক কৌশলে। শিশির ছোটে, আরও উত্তরে ছোটে, মজমাকান্দি বাজারের পেছন দিয়ে, হায়দ্রাবাদের সরিষার মাঠের আড়াল দিয়ে সোজা পশ্চিমে ছোয়া মজমাগ্রামের প্রান্তসীমা দিয়ে। ছুটতে ছুটতে তার সময় কখন যে বেড়ে গেছে জানা নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেলে পড়েছে মাথার উপরের সূর্য। সে একটি তির্যক পথে সোজা বলগ্রামের জঙ্গলে প্রবেশ করে।

এদিকে ঘুম থেকে উঠে শিশিরকে না পেয়ে শিশু মিয়া প্রথমে আশেপাশে খোঁজে, তারপর না পেয়ে গ্রামময় খোঁজে, অতঃপর গ্রামবাসী এসে জাল ফেলে পুকুরে এবং দলবদ্ধভাবে খুঁজতে শিশিরকে আশপাশের গ্রামগুলোতেও যায়। মজমাকান্দি বাজারেও যায়, বিরানপুর তার নানার বাড়ির কুটুম্বদের কাছেও খোঁজ লাগায়, যায় হায়দ্রাবাদ, খোঁজে চারপাশ। কোথাও শিশিরকে না পেয়ে শিশু মিয়া হতাশায় ভেঙে পড়ে। পরিপাশের লোকেরা শেষ ভরসা আল্লাহর হাতে দিয়ে যার যার কাজে ফিরে যায়। শিশু মিয়া বিরস বদনে পশ্চিম দিকে মুখ করে পুকুরপাড়ে বসে। সামনে বিস্তীর্ণ সরিষা মাঠ, তারপর তিল তিসির বিছিয়ে থাকা প্রান্তর, তারও ওপার বলগ্রামের ঘনজঙ্গল তার চোখে ছায়া হয়ে ভাসে।

বলগ্রাম জঙ্গলের প্রবেশ মুখে বাঘ, শিশিরকে জিজ্ঞেস করে, এ গায়ে কেন? শিশির বাঘের চোখে চোখ রেখে উত্তর দেয়, আমি আমার মাকে খুঁজতে এসেছি। না, বাঘ নয়, শনবনের উপর শিশিরের ছায়া দীর্ঘায়িত হয়। শিশির একটি শক্ত গাছের ডাল ভেঙে শন বনের উপর আঘাত করতে থাকে। আঘাতে আঘাতে দুমড়ে-মুচড়ে দেয় সবুজ অভেদ্য দেয়াল। তৈরি পথে সে এগিয়ে যায় জঙ্গলের আরও গভীরে।

তার তাণ্ডবে পাখিরা হয়তো ভীত হয়, কিন্তু শিশিরের ওসব বুঝে কাজ নেই, সে তার মাকে খুঁজতে এসেছে। জঙ্গলের প্রতিটি ইঞ্চি তন্নতন্ন করে সে খুঁজবে, খুঁজে বের করবে মাকে। হঠাৎ একদল শকুনের নজরে পড়ে সে। যুদ্ধক্লান্ত দেহটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারেনি তাই আরো কিছুদিন বিশ্রাম করবে এ জঙ্গলে। তারা শিশিরকে তাড়া করে। শিশির প্রথমে ভয় পায় না। তারা নখরে খামচে দেয় শিশিরের গাল, শিশির লাঠি ঘুরায় শাঁ শাঁ ঘূর্ণিবায়ুর মতো। শকুনগুলো ছুটে সরে যায় আবার এগিয়ে আসে।

একসময় শিথিল হতে থাকে শিশিরে হাত, সে তখন পিছু হটতে থাকে। পিছু হটতে হটতে জঙ্গলের ধাঁধার থেকে বের হয়ে ছুটতে থাকে তার জন্মগ্রামের দিকে তিল তিসির প্রান্তরের উপর দিয়ে। তার উপর দিয়ে আকাশের মেঘে কালো পালক ফেলে তাড়া করতে করতে ছুটে আসে শকুনের দল। শিশির দৌড়ায়, আরও প্রাণপণে দৌড়ায়, মনে হয় সে পড়ে যাবে, মরে যাবে এক্ষুনি, এক্ষুনি শকুনের বীভৎস ঠোঁটে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে সে। সে দেখে, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তবু সে দৌড়ায়। শকুন ডানার কালো বৃত্তভেঙে সে বেঁচে থাকতে চায়।

আশাহীন পশ্চিমদিকে চেয়ে থেকে একসময় শিশু মিয়ার চোখ ঘোলা হয়ে আসে, আবার দপ করে জ্বলে ওঠে। ওই কে আসে দৌড়ে, বিস্তীর্ণ মাঠের ও পাড়ে বলগ্রামের জঙ্গলের ভেতর থেকে কে আসে এমন রুদ্ধশ্বাসে। শিশির ওরফে শিশু মিয়াও দৌড়াতে থাকে। তার খোকার নামও শিশির, সেও দৌড়াতে থাকে বিপরীত দিক হতে। শেষমেশ শিশির পড়ে যাওয়ার প্রাক্কালেই ধরে ফেলে শিশু মিয়া।

সোনার মানিককে বুকে নিয়ে শিশিরের বাবা দক্ষিণের হাহাকার ভরা মাঠের শেষপ্রান্তে চোখ রাখে, যেখানে মøানসূর্যের আভা মেখে দিগন্তে ছেয়ে আছে গমক্ষেতের শিস।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh