বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় শিশুরা

মাহাবুবা আখতার

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৩, ০১:২১ পিএম | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৩, ০৬:২২ পিএম

মাহাবুবা আখতার। ফাইল ছবি

মাহাবুবা আখতার। ফাইল ছবি

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। বাংলা পঞ্জিকা মতে, ১৩২৬ বঙ্গাব্দ। চৈত্রের রাত। চাঁদ না থাকায় অন্ধকারটা যেন জেঁকে বসেছে বাইগার নদীর তীর ঘেঁষা ছোট্ট গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায়। আকাশে শ্রবণা নক্ষত্র ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম দিগন্তপানে

আনমনে সেটাই যেন দেখছিলেন শেখ লুৎফর রহমান। হঠাতাঁর কানে ভেসে এলো সদ্যোজাত এক শিশুর কান্নার আওয়াজ। ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, ছেলে হয়েছে। মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেলেন তিনি দেখলেন যেন পুরো ঘর আলোকিত করে স্ত্রী সায়েরা খাতুনের কোলজুড়ে এসেছে ভীষণ মায়াকাড়া চেহারার এক শিশুপুত্র তাঁর মনে হলো শিশুটি যেন তাঁর দিকেই হাত বাড়িয়ে রয়েছে তিনি আবেগ-কম্পিত হয়ে দু'হাতে তুলে নিলেন শিশুটিকে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, খোকা!

‘খোকা’ নামের শেখ পরিবারের সেই আদরের শিশুটিকে নিয়ে ভাবতে গেলেই মনে পড়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘শিশু জাদুকর’ কবিতার কয়েকটি লাইন-

পার হয়ে কত নদী কত সে সাগর
এই পারে এলি তুই শিশু যাদুকর!
কোন রূপ-লোকে ছিলি রূপকথা তুই,
রূপ ধরে এলি এই মমতার ভুঁই।
নবনীতে সুকোমল লাবণি লয়ে
এলি কে রে অবনীতে দিগ্বিজয়ে।

সত্যিই তো! হাজার বছরের ক্ষণজন্মা এই বাঙালি শিশু- ‘খোকা’র জন্মই যেন হয়েছিল মহান উদ্দেশ্যে, দিগ্বিজয়ের লক্ষ্যে; নিজের দেশকে, দেশের মানুষকে শোষণ আর পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি দিতে যিনি ‘খোকা’ থেকে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির ‘মুজিব ভাই’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু’। তাঁর হাত ধরেই আসে বাঙালির স্বাধীনতা, জন্ম নেয় বাংলাদেশ।

জাতির পিতার জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস

যে ব্যক্তিটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, যার জন্ম না হলে একটি জাতি হয়ত পরাধীনই থেকে যেত; সেই ব্যক্তির জন্মদিনটিই যে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্‌যাপন ও উপলক্ষ্যের দিন হবে সেটাই তো স্বাভাবিক আর তাই, ১৯৯৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার প্রথম জাতীয় সম্মেলনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ড. নীলিমা ইব্রাহিম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শিশুরা যেন অনুপ্রাণিত হয় সেজন্য বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার উদ্যোগে ১৯৯৪ সালের ১৭ মার্চ প্রথম বেসরকারিভাবে জাতীয় শিশু দিবস  পালন করা হয়। এরপর, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে দিনটি জাতীয় শিশু দিবস রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৯৭ সাল থেকে সরকারিভাবে ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস পালিত হয়।

শিশুবন্ধু শেখ মুজিব

শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা ছিল নিখাদ উনার হাসিটা এতটাই স্নেহমাখা থাকত যে তখনকার যেসব শিশুরা বঙ্গবন্ধুর অনুষ্ঠানে আসত, তারা বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার জন্য ছুটে যেত। আর বঙ্গবন্ধুও তাঁর অমলিন হাসি দিয়ে তাদেরকে কাছে টেনে নিতেন সবসময় 

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনা প্রধান আইয়ুব খান জোর করে ক্ষমতা দখল করে নিলে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়পাঁচ বছরের জন্য পুরো দেশে রাজনীতি বন্ধ করে দিলে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে তিনি তরুণদের নির্দেশ দিলেন, ‘এই পাঁচ বছর তোমরা শিশু সংগঠন কচি-কাঁচার মেলার মাধ্যমে কাজ করো। নিজেদের সচল রাখো।’  বঙ্গবন্ধু জানতেন, শিশুদেরকে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে সে জাতি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবেই

এরপর, ১৯৬৩ সালেও জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে কচি-কাঁচার মেলা আয়োজিত শিশু আনন্দ মেলায় এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুতাঁর ভাষায় ‘এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে মিশে মনটাকে একটু হালকা করার জন্য এলাম।’

মুক্তিযুদ্ধ নিজের চোখে দেখার স্মৃতি থেকে ১৯৭২ সালে শিশুরা প্রায় তিনশ ছবি আঁকে। এর মধ্যে বাছাই করা ৭০টি ছবি রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই বঙ্গবন্ধুকে দেখান

ছবিগুলো দেখে বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে, এসব না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না।’

১৯৭২ সালের শেষের দিকের কথা। একদিন সকালে বঙ্গবন্ধু হাঁটতে বেরিয়েছেন সঙ্গে বড় ছেলে শেখ কামাল। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু দেখলেন- একটি ছোট্ট ছেলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বঙ্গবন্ধু ছেলেটিকে কাছে ডেকে ছেলেটির পায়ের জুতা খুলে দেখেন, জুতার ভেতর লোহার খোঁচায় ছেলেটির পা দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তখনই ছেলেটির চিকিৎসার জন্য তার দেহরক্ষী পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার ‘আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে লিখেছেন,‘রাসেল আব্বাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত। আব্বাকে মোটেই ছাড়তে চাইত না।’

 শেখ হাসিনা আরও লিখেছেন, ‘রাসেলের সব থেকে আনন্দের দিন এলো যেদিন আব্বা ফিরে এলেন। এক মুহূর্ত যেন আব্বাকে কাছ ছাড়া করতে চাইত না। সব সময় আব্বার পাশে ঘুরে বেড়াত।’

এইসব ঘটনাগুলো এটাই প্রমাণ করে সংগ্রামী জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝেও বঙ্গবন্ধু নিজের শিশুপুত্র রাসেল ও দেশের শিশু-কিশোরদের জন্য সবসময় ভাবতেন। তাদেরকে আনন্দ আর হাসি-খুশিতে রাখার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। শিশুদের সান্নিধ্য তাঁকে দিত সব অবসাদ থেকে মুক্তি।

শিশুদের বিকাশে বঙ্গবন্ধু

বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান লাকী ইনাম তাঁর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘লেখাপড়ার পাশাপাশি শিল্প-সংস্কৃতির চর্চার মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোরদের বিকাশে মনোযোগী ছিলেন বঙ্গবন্ধু 

বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে।’

বঙ্গবন্ধু চাইতেন শিশুরা হাসবে, গাইবে, ছবি আঁকবে, গল্প লিখবে। শিশুরা হেসে-খেলে বড় হবে। তাই তিনি কচিকাঁচার মেলা বা তার সময়ে যেসব সংগঠন ছিল সেসব সংগঠনগুলোকে শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিতেন।

বর্তমান সরকার শিশুদের জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেগুলোর সব কিছুর সূচনা বঙ্গবন্ধু করে গেছেন। শিশু-কিশোরদের সঠিক বিকাশে প্রত্যেকটা জায়গায় ধরে ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রকে নির্দেশনা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শিশু সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিশু সংগঠন, প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের সুবিধাগুলোর ভিত্তি বঙ্গবন্ধু নিজ উদ্যোগে করেছেন, তাও মাত্র সাড়ে তিন বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ে

শিশুদের জন্য প্রণীত বঙ্গবন্ধুর শিক্ষানীতি

১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে বঙ্গবন্ধু সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ বলেছিলেন। নিরক্ষরতা দূর করার পাশাপাশি পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ চালুর কথাও বলেন তিনি। দারিদ্র্য যেন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেধাবীদের জন্য বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখার কথাও বলেন বঙ্গবন্ধু।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায় রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদক্ষেপে। তার সরকারের শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার পদক্ষেপগুলো উঠে এসেছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ গ্রন্থের ‘সমাজের হাতে ও রাষ্ট্রের হাতে প্রাথমিক শিক্ষা’ প্রবন্ধে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছেন,‘১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে সম্পূর্ণভাবে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রস্তাব করা হয়, প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনায় ১৯৭৩-৭৮ সালে দেশে ৫০০০ নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি হবে। ১৯৭৪ সালে কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশন সুপারিশ করে, প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৮ বছর করা হোক।

বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণে সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদে গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার বিধান রাখেন। নিরক্ষরতা দূর করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও সংবিধানে বলা হয়।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণে ‘The Primary Schools (Taking Over) Act-১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন। এরপর বলা চলে, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর সময়েই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে বই, অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ ও খাবার বিতরণ করা হত শিশুদের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ্ব করতে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগও দিয়েছিলেন তিনি। গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পোশাকও দেওয়া হত।’

পরিশেষে এটাই বলা যায়, বঙ্গবন্ধু কেবল একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রই জন্ম দেননি। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কীভাবে মাথা উঁচু করে টিকে রইবে, তাঁর দার্শনিক ভাবনা থেকেই করে গেছেন অনেক কিছু। তিনি বিশ্বাস করতেন-‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুরই অন্তরে।’ দেশকে যুগে যুগে যোগ্য নেতৃত্বের হাতে নিরাপদে রাখতে প্রতিটি শিশু-কিশোরকে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছেন আগামীর ভবিষ্যৎ হিসেবে। এমন চিন্তার অসংখ্য প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কন্টকার্কীর্ণ দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে। দেশ গঠনে রাজনীতির কঠিন অধ্যায়ের বিকল্প যে শিশু-কিশোরদের জন্য কাজ করা তারও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনিই দেখিয়েছেন।


লেখক: মাহাবুবা আখতার (প্রভাষকপ্রাণিবিদ্যা বিভাগ, বাউফল সরকারি কলেজপটুয়াখালী)

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh