প্রতীক সিফাত
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৩, ০৯:১২ এএম | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৩, ০৯:১৭ এএম
এফ-কমার্স। ছবি: সংগৃহীত
ভুয়া পেজে অর্ডার দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভোক্তাদের নকল পণ্য দেওয়া হয়। অনেক ক্রেতা অর্থ পরিশোধ করে পণ্যও পান না। শুধু তাই নয়, পণ্য অর্ডার বা সরবরাহের নাম করে ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন তথ্য, ই-মেইল বা সামাজিক যোগাযোগের সাইটের অ্যাকাউন্ট ঠিকানাও সংগ্রহ করে সাইবার অপরাধীরা। এর ফলে ব্যবহারকারীদের অনলাইন নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুক বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কাজেই এর মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো সহজ। আবার সহজেই খোলা যায় এর পেজ, কোনো টাকাও লাগে না। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই, বিশেষ করে তরুণরা উদ্যোগী ভূমিকা নিয়ে হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তা। অন্যদিকে অফলাইনে একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে গেলে পোহাতে হয় নানা ঝক্কি। পছন্দমতো স্থান নির্বাচন, ভবন মালিককে অগ্রিম টাকা দেওয়া, মানানসই ডেকোরেশন, ঠিকঠাকভাবে পণ্য গুছিয়ে রাখা-আরও নানা কিছু।
এফ-কমার্স বা ফেসবুক কমার্স এসে অবশ্য এ পথচলা সহজ করেছে। বর্তমানে দেশে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসার যত ধরন, তার মধ্যে এফ-কমার্সে জনসম্পৃক্ততাই সবচেয়ে বেশি। এর সুযোগ নিচ্ছে প্রতারক চক্রও, বিভিন্ন নামে-বেনামে পেজ খুলে ফাঁদ পেতেছে। আকর্ষণীয় পণ্যের ছবি দেখিয়ে হাতাচ্ছে টাকা। আবার ব্যবসায় ভোক্তা সেবা নিয়েও বাড়ছে অনিয়মের অভিযোগ। সাধারণত ই-কমার্সের ক্ষেত্রে এসব অভিযোগ উঠতে দেখা যায়।
ফেসবুকে যেসব ব্যবসা চলে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পোশাক, তৈজসপত্র, উপহার সামগ্রী, কসমেটিকস ও জুয়েলারি। ইদানীং খাদ্যপণ্যও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনে এনে বিক্রি করেন। আবার ফেসবুক তৈরি করেছে উদ্যোক্তাও, যারা একদম উৎপাদন থেকে প্রতিটি ধাপ পার করে এফ-কমার্সে পণ্য বিক্রি করেন।
ফেসবুকের এ ব্যবসার ধারণা মূলত ২০১২ সাল থেকে। যদি গত এক দশকের উপাত্ত বিবেচনা করা যায়, কিছু উদ্যোগ ৪০ গুণ বড় হয়েছে, কেউ কেউ ১০ গুণ পর্যন্ত তাদের ব্যবসা বাড়িয়েছেন।
তবে অন্য সব ব্যবসার মতো এখানেও টিকে থাকতে এক প্রকার যুদ্ধ করতে হয়। ফলে উদ্যোগগুলোর ঝরে যাওয়ার হারও কম নয়। বর্তমানে এফ-কমার্স কত বড় হয়েছে, এর কোনো সঠিক তথ্য নেই।
বাংলাদেশে গত বছরের জুলাইয়ে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ কোটি ৮৯ লাখ ৪৩ হাজার। মূলত করোনা অতিমারি শুরু হলে লকডাউনের মধ্যে হু-হু করে এর সংখ্যা বেড়ে যায়। জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটির মূল প্রতিষ্ঠান মেটা তাই জানিয়েছিল, সক্রিয় ব্যবহারকারীর দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ তিনে। কিন্তু গত ছয় মাসে দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২১ শতাংশ কমেছে বলে তথ্য দিয়েছে পোল্যান্ডভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট এবং অ্যানালিটিকস প্ল্যাটফর্ম নেপোলিয়নক্যাট।
সংস্থাটি জানিয়েছে, বাংলাদেশে ছয় মাসের ব্যবধানে প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ ৯৫ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী কমে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ কোটি ৬৫ লাখ ৪৮ হাজারে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ১০ শতাংশই অনলাইন ক্রেতা। মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ১০ কোটির বেশি মানুষ।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোহাম্মদ মফিজুর রহমান বলেন, ‘অনলাইন ব্যবসায়ের মাধ্যমে তরুণদের অনেক বেশি ক্ষমতায়ন করা সম্ভব। আমরা চাই না বাংলাদেশ থেকে একজন উদ্যোক্তাও হারিয়ে যাক। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। এরপর উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা যদি এখন নারীদের ঘরে বসিয়ে রাখি তাহলে সেই লক্ষ্যে আমরা কখনো পৌঁছতে পারব না। সে লক্ষ্য পূরণে নারী-পুরুষ মিলে একযোগে কাজ করতে হবে।’
ফেসবুকের মালিকানাধীন সংস্থা মেটা জানিয়েছে, মহামারির পর থেকে ফেসবুক-ভিত্তিক ব্যবসায়ের ৭০ শতাংশের মালিক নারী। তারা ইনস্টাগ্রামে যে ব্যবসা করে, সেখানে ৬৫ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই নারী উদ্যোক্তাদের ধৈর্য ধরার এবং এ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার জন্য উদ্যোক্তার মনোভাবকে ধরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান।
এফ-কমার্স বিষয়টি বুঝতে ফেসবুক সম্পর্কে ভালোভাবে জানা জরুরি। সেটি না জানার কারণে অনেকে ঠিকভাবে ভোক্তার কাছে পৌঁছতে পারেন না। শুরুর দিকে স্বল্প পুঁজি দিয়ে অনেকে এফ-কমার্সে সফল হয়েছেন। আবার অতিরিক্ত মূল্য, পণ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকায় অনেকের ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়েছে। মূলত এফ-কমার্সে যুক্ত হতে গিয়ে অনেকের মধ্যে ভুল ধারণাও কাজ করে। আর দশটা ব্যবসায়ের মতো এটাতে যে ঝুঁকি আছে; গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য নিশ্চিত করা, সঠিক সময়ে ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেওয়া-এ নিয়ে গাফিলতির কথা প্রায়ই শোনা যায়। উল্টোপিঠে ব্যবসায়ীদের অনেকেই ভুগছেন ক্রেতাদের মাধ্যমে। কিছু ক্রেতা পণ্য গ্রহণ করেন না, পণ্য পৌঁছে গেলে কেউবা ফোন বন্ধ রাখেন। ফলে অনেকে শতভাগ ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ থেকে সরে আসছেন। প্রতারক চক্র আবার এর সুযোগ নিচ্ছে।
সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান নরটনলাইফলকের গবেষণা উইংস নরটন ল্যাবস সম্প্রতি অনলাইন কেনাকাটা নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। ‘কনজ্যুমার সাইবার সেফটি পালস রিপোর্ট’ শীর্ষক সেই গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন পণ্যের ভুয়া বা লোভনীয় অফার দিয়ে থাকে সাইবার অপরাধীরা। সবচেয়ে বেশি অফার দেওয়া হয় ইলেকট্রনিকস, গয়না, পোশাকসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যে। ভুয়া পেজগুলোতে লোভনীয় অফারের পাশাপাশি পণ্যের বিষয়ে ভুয়া ইতিবাচক মতামতও দেওয়া থাকে। এর ফলে সত্যিকার এফ-কমার্স বা অনলাইন শপ বলে ভুল করেন অনেকেই।
কিন্তু ভুয়া পেজে অর্ডার দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভোক্তাদের নকল পণ্য দেওয়া হয়। অনেক ক্রেতা অর্থ পরিশোধ করে পণ্যও পান না। শুধু তাই নয়, পণ্য অর্ডার বা সরবরাহের নাম করে ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন তথ্য, ই-মেইল বা সামাজিক যোগাযোগের সাইটের অ্যাকাউন্ট ঠিকানাও সংগ্রহ করে সাইবার অপরাধীরা। এর ফলে ব্যবহারকারীদের অনলাইন নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৮০ শতাংশ ওয়েবসাইটই ব্যবহারকারীদের সার্চ ইতিহাস বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে সরবরাহ করে থাকে। সার্চ ইতিহাস পর্যালোচনা করে ব্যবহারকারীদের আগ্রহ জানার পাশাপাশি তাদের আইপি ঠিকানার মাধ্যমে অবস্থানও শনাক্ত করা সম্ভব। এসব তথ্য কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচারের পাশাপাশি অনেক সময় সাইবার আক্রমণও চালানো হয়।
প্রতারণার শিকার বাড্ডার এক গৃহবধূ তামান্না আক্তার জানান, গত ফেব্রæয়ারির শুরুর দিকে একটি পেজে তার কন্যাশিশুর জন্য তিনটি পোশাক অর্ডার করেন। অর্ডার নিশ্চিত করতে বিকাশে পরিশোধ করেন ১৫০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে সেই পণ্য আসে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। সাড়ে চার হাজার টাকা পরিশোধ করে বিক্রেতার পাঠানো পার্সেল গ্রহণ করেন তামান্না। এরপর সেখানেই পার্সেলটি খুলে দেখতে পান, অর্ডার করা পোশাকের বদলে তাকে দেওয়া হয়েছে নিম্নমানের অন্য পোশাক। পেজটির অ্যাডমিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি। বারবার মেসেজে অভিযোগ জানানোর একপর্যায়ে তাকে বøক করে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর কিংবা থানায় কোনো অভিযোগ করেছেন কিনা জানতে চাইলে তামান্না আক্তার বলেন, ‘সাড়ে চার হাজার টাকার জন্য আর থানা পুলিশ করতে আগ্রহ হয়নি। তাছাড়া সেখানেও তো নানা হয়রানি। আর ভোক্তা অধিকারে কীভাবে অভিযোগ দিতে হয় তা আমার জানা নেই।’
অনলাইন ব্যবসায় ঠকলেই প্রতিকারের একমাত্র জায়গা এখন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সকাল থেকে সন্ধ্যাবলা যায় সারাদিনই এ ব্যবসা নিয়ে জমা পড়ছে নানা অভিযোগ। এ পর্যন্ত কয়েক হাজার অভিযোগ নিষ্পত্তিও করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তবে অনেক অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ পেজে পণ্য বা সেবা সরবরাহকারীর ঠিকানা এবং ফোন নম্বরের অনুপস্থিতি। ফলে ভোক্তা প্রতারিত হলেও পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকারের এ সংস্থা।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে উপপরিচালক (অভিযোগ উপবিভাগ) মো. মাসুম আরেফিন বলেন, ‘পণ্য বিক্রি এবং মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখনো দুর্বলতা আছে। ফেসবুকভিত্তিক এফ-কমার্স কর্মকাণ্ডে ঠকছেন ক্রেতা। এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা পেজগুলোতে উৎপাদনকারীর নাম, ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দেওয়া থাকে না। ফলে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ছলচাতুরীর আশ্রয় নিলেও ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।’
অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণা থেকে নিরাপদ থাকতে বেশ কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে নরটন ল্যাবস। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, অপরিচিত ওয়েবসাইট বাজারদরের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রির অফার দিলে সতর্ক থাকতে হবে। সন্দেহ হলে ওয়েবসাইটের ডোমেইন ঠিকানা সম্পর্কেও খোঁজ নিতে হবে। একই সঙ্গে এড়িয়ে চলতে হবে অপরিচিত আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমও।