ভারতে সাংবাদিকতার বাস্তবতা

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৩, ১০:১৭ এএম

ভারতে মিডিয়া সরকারের প্রচারমাধ্যমে পরিণত হচ্ছে। ছবি: দ্য প্রিন্ট

ভারতে মিডিয়া সরকারের প্রচারমাধ্যমে পরিণত হচ্ছে। ছবি: দ্য প্রিন্ট

বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। অপর তিন স্তম্ভ হলো- আইনসভা, নির্বাচিত সরকার ও বিচার বিভাগ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ মূর্ত হয় এই চার স্তম্ভের মাধ্যমে।

দক্ষিণ এশিয়ায় কয়েক বছর আগেও ভারতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বেশ বড় প্রভাব ছিল। এখন তা মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। এমনকি বেশিরভাগ মিডিয়া সরকারের রাজনৈতিক প্রচারমাধ্যম হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।

২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি। তারপর থেকে একের পর এক হামলা-মামলা আসতে থাকে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের তালিকায় গত বছর দেশটির অবস্থান ছিল ১৫০তম। তালিকায় এত নিচে আগে কখনো নামেনি দেশটি। ২০২১ সালের সূচকে ভারত ১৪২তম স্থানে ছিল। 

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স এক প্রতিবেদনে জানায়, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও রাজনৈতিকভাবে একপেশে সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সংকট দেখা দিয়েছে। করোনা ভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে মোদি সরকার ও তার সমর্থকেরা সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রায় ‘গেরিলা যুদ্ধে’ নেমেছিল বলে দাবি সংগঠনটির। তাদের দাবি, করোনা নিয়ে সরকারি বিবৃতির সঙ্গে যেসব সংবাদমাধ্যমের বক্তব্য মেলেনি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সরকার ও তার সমর্থকেরা। 

সম্প্রতি ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোশ্চেন’ শীর্ষক বিবিসিতে প্রচারিত এক তথ্যচিত্রে ২০০২ সালে তিন দিনের মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদির ভ‚মিকা তুলে ধরা হয়েছে। ওই দাঙ্গায় সরকারি হিসাবে ৭৯০ জন মুসলিমসহ সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়। বিবিসি-২ চ্যানেলে তথ্যচিত্রের প্রথম অংশটি ১৭ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় অংশটি ২৪ জানুয়ারি প্রকাশ হয়। ভারতে প্রচার না হওয়া সত্ত্বেও তথ্যচিত্রটি জনসাধারণের চোখে ঘটনাগুলো ফিরিয়ে এনেছে, যা দেশটির ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও প্রধানমন্ত্রী মোদিকে নিশ্চিতভাবেই ক্ষুব্ধ করেছে।

ওই তথ্যচিত্রে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত এক জায়গায় এনে বিবিসি যে সারাংশ দাঁড় করিয়েছে, সেটি হলো- গুজরাট দাঙ্গা মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হতে সাহায্য করেছে। এই প্রক্রিয়ায় কীভাবে তার দল বিজেপি, হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং হিন্দুত্ববাদী নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি ভারতের বিচারব্যবস্থা তাকে সাহায্য করেছে, তা দেখানো হয়েছে তথ্যচিত্রে।

এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি এটিকে একটি ‘প্রপাগান্ডা ছবি’ বলে বর্ণনা করে বলেছেন, ‘তথ্যচিত্রটি বানানো হয়েছে একটি বাতিল হয়ে যাওয়া আখ্যানের ভিত্তিতে।’ প্রতিক্রিয়া এখানেই শেষ হয়নি। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের আয়কর বিভাগের প্রায় ২০ জন কর্মকর্তা ও পুলিশ রাজধানী দিল্লিতে বিবিসির কার্যালয়ে উপস্থিত হন এবং কর্মীদের তাদের কম্পিউটারের কাছ থেকে সরে যেতে এবং মোবাইল ফোন তাদের হাতে তুলে দিতে নির্দেশ দেন। কাছাকাছি সময়ে ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ে বিবিসির অন্য একটি কার্যালয়েও হাজির হন আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা।

মিডিয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্প্রতি কিছু সংবাদমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করে সংবাদ প্রকাশ করার কারণে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা অভিযানের নামে হেনস্তার শিকার হয়েছে। তাদের সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে না এবং কয়েকজন সাংবাদিক গ্রেপ্তারও হয়েছেন। মিডিয়া সম্পাদকদের সংগঠন ‘এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়া’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘সংবাদ সংস্থাকে ভয় দেখানো এবং হয়রানি করার জন্য সরকারি সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করার যে প্রবণতা ভারতে রয়েছে, বিবিসির কার্যালয়ে অভিযান তারই অংশ।’ 

স্বাধীন অনলাইন মিডিয়া গ্রুপ ‘নিউজলন্ড্রি’র প্রধান নির্বাহী অভিনন্দন সেখরি বলেন, ‘ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার স্বর্ণযুগ কখনোই ছিল না; কিন্তু বর্তমানে যে অবস্থায়, সেটাও কখনো ছিল না।’ মোদি সরকারকে নিয়ে সমালোচনামূলক খবর প্রকাশ করায় ভারতের আয়কর কর্মকর্তারা ২০২১ সালে দুইবার ‘নিউজলন্ড্রি’র কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছিল।

এ ছাড়া অভিনন্দনের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি এবং কর মূল্যায়ন প্রতিবেদন জাল করার অভিযোগে কর বিভাগ থেকে একটি ফৌজদারি মামলাও করা হয়। গত নভেম্বরে দিল্লির এক বিচারক ওই অভিযোগ খারিজ করে দেন। পরে অভিনন্দন তার মৌলিক অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হামলার অভিযোগ এনে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। দিল্লি হাইকোর্টে ওই মামলার শুনানি চলছে।

২০২১ সালে সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আয়কর কর্মকর্তারা এমন আরও চারটি অভিযান পরিচালনা করেন। ওই বছর জুলাই মাসে দৈনিক ভাস্করের কার্যালয়ে অভিযান চালান কর কর্মকর্তারা। অভিযোগ ছিল, সার্কুলেশনের দিকে দিয়ে ভারতের সর্ববৃহৎ এই পত্রিকাটি তাদের ৭০০ কোটি রুপি আয়ের ওপর কর ফাঁকি দিয়েছে। দৈনিক ভাস্কর কর্তৃপক্ষ কর কর্মকর্তাদের ওই অভিযোগের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হন এবং মামলাটি এখনো চলছে।

তালিকায় যুক্ত হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমসও। কাশ্মীরে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাহীনতা নিয়ে মতামত ছাপানোয় যুক্তরাষ্ট্রের এ পত্রিকার কড়া সমালোচনা করেছে ভারত। ওই মতামত নিবন্ধটি লিখেছেন কাশ্মীরের ‘দ্য কাশ্মীর টাইমস’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক অনুরাধা ভাসিন। জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর ২০১৯ সাল থেকে কীভাবে সাবেক এ রাজ্যের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে, সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন চলছে, তা তিনি বর্ণনা করেছেন।

জাতীয় স্বার্থে কীভাবে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ হচ্ছে, ভয় দেখানো হচ্ছে, নানা আইনে মিথ্যা মামলায় আটক করা হচ্ছে, বিদেশে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, এমনকি হত্যাও করা হচ্ছে, তা তুলে ধরে ওই নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, অবশিষ্ট ভারতের ভাগ্যও কাশ্মীরের মতো হয়ে উঠতে পারে। 

ভারতের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর পরপর কয়েকটি টুইটবার্তায় ১০ মার্চ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওই সংবাদপত্র অনেক দিন আগেই নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছে। ভারত সম্পর্কে সংবাদপত্রটি যখন খুশি যা তা প্রকাশ করে চলেছে। এবারও কাশ্মীরের বাক স্বাধীনতা না থাকা নিয়ে যা লেখা হয়েছে, তা দুরভিসন্ধিমূলক ও কল্পনাপ্রসূত।

ওই নিবন্ধের উদ্দেশ্য একটাই- ভারত সরকার, ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা। তিনি আরও লেখেন, নিউইয়র্ক টাইমসের মতো আরও কয়েকটি সমভাবাপন্ন বিদেশি গণমাধ্যম এভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত মোদি সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এই মিথ্যাচারিতা বেশিদিন টিকবে না।

ভারতে সংবাদমাধ্যমের সংকটের বাস্তবতা এখানেই শেষ হয়নি। মোদি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীগোষ্ঠী একের পর এক মিডিয়া গ্রুপ অধিগ্রহণ করছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স এ ঘটনাকে ভারতে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করার প্রচেষ্টা বলে উল্লেখ করেছে। এর সর্বশেষ ঘটনা আদানি গ্রুপের নিউ দিল্লি টেলিভিশন লিমিটেড (এনডিটিভি) অধিগ্রহণ।

ভারতের জনপ্রিয় সাংবাদিক রবিশ কুমার দেশটির সবচেয়ে পুরনো বেসরকারি চ্যানেল এনডিটিভি থেকে নভেম্বরের শেষে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তার পদত্যাগ ছিল কথিত সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ধ্বংসের অনুস্মারক। এনডিটিভির অধিকাংশ শেয়ার কেনার মাধ্যমে চ্যানেলটির মালিকানায় যখন বিশ্বের অন্যতম ধনী গৌতম আদানি আসেন, তখনই রবিশ পদত্যাগে বাধ্য হন। আদানিকে মোদির ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে মোদি আদানির বিমান ব্যবহার করেন।

২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত আদানির সম্পদ ৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১১০ বিলিয়ন ডলার হয়। রবিশ দুই যুগের বেশি সময় ধরে এনডিটিভির জনপ্রিয় কণ্ঠ ছিলেন। ভয়-ভীতিহীন, কঠিন প্রতিবেদন সরাসরি উপস্থাপন ও ক্ষমতাসীনদের চ্যালেঞ্জ করার জন্য তিনি পরিচিত। মোদি সরকারের পক্ষ নিয়ে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতায় ইন্ধন দেওয়ার জন্য সম্প্রতি তিনি অন্য সংবাদমাধ্যমগুলোর তীব্র সমালোচনা করেন।

আদানি যদিও তার মালিকানায় এনডিটিভির স্বাধীনতা বজায় রাখা এবং সরকার যখন ভুল করে তার সমালোচনার কথা বলেছেন। তবে এটিকে ঠাট্টা হিসেবে উল্লেখ করেছেন রবিশ। পদত্যাগের পর নিজের ইউটিউব চ্যানেলে তিনি বলেন, ‘কীভাবে একটি চ্যানেল সরকারের সমালোচনা করবে, যে চ্যানেলটি এমন এক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়; সরকারের আনুকূল্যে যাদের ব্যবসায়িক সাফল্য এসেছে। ফলে আমার কাছে এটা পরিষ্কার- আমাকে পদত্যাগ করতেই হবে।’

ব্যবসা, রাজনীতি ও ভারতীয় মিডিয়ার মেলবন্ধন মানে যে কোনো কোম্পানির চেয়েও ক্ষমতাবান। জি-মিডিয়া করপোরেশন আরেকটি প্রভাবশালী টিভি নেটওয়ার্ক। এটি এসেল গ্রুপের অংশ, যার নেতৃত্বে রয়েছেন সুভাষ চন্দ্র, যিনি ভারতের উচ্চকক্ষের সাবেক সদস্য। তিনি বিজেপির সমর্থন পেয়েছেন। রাজনীতি-মিডিয়া-ব্যবসার মেলবন্ধনকে রবিশ পরিভাষা দিয়েছেন, ‘গদি মিডিয়া’। বিশেষত করোনাকালে বিজেপির নেতৃত্বে মুসলিমবিদ্বেষী, কৃষক ও গণআন্দোলনবিরোধী, সরকারপন্থি একতরফা সাংবাদিকতায় গদি মিডিয়ার কর্মকাণ্ড আরও ফুটে উঠেছে। আর এটাই এ সময়ে ভারতে সাংবাদিকতার বাস্তবতা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh