দুর্ঘটনার জন্য দায়ী সরকার

ভূমিকম্প সহনশীল নগর গড়তে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৩, ০৯:০৭ এএম

অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী। ফাইল ছবি

অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী। ফাইল ছবি

একের পর এক বিস্ফোরণ। ঢাকা যেন মৃত্যুপুরী। সামনে আছে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি। সব মিলিয়ে ঢাকার নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি ঘুরপাক খাচ্ছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। আর এ নিয়ে সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী। যিনি ভূমিকম্প, ভবন ধস ও নগর দুর্যোগ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণাসহ নানা কাজ করছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহিদুর রহমান।

সম্প্রতি রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় গঠিত কারিগরি কমিটির আপনি সদস্য। এর আগেও রানা প্লাজাসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় গঠিত কমিটিতে আপনি ছিলেন। এ রকম দুর্ঘটনার বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

এই দুর্ঘটনাগুলোর জন্য আমি ভবন মালিকদের চেয়ে সরকারি এজেন্সিগুলো বেশি দায়ী বলে মনে করি। কারণ একটা বিল্ডিং হওয়ার পর ৫ বছর অন্তর সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরিদর্শন করে একটা রিপোর্ট তৈরি করতে হয়, সেটা হচ্ছে না। আবার রাজউক বা ফায়ার সার্ভিসও একটা বিল্ডিং নির্মাণের সময় পরিদর্শন না করেই সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছে। এখানে ঘুষ বাণিজ্য চলে, যার কারণে সঠিক চিত্র কখনো পাওয়া যাবে না। ঢাকা শহরে ৬ লাখ বিল্ডিং, অধিকাংশই এভাবে তৈরি হয়েছে। যত দিন না আমাদের এজেন্সিগুলো এ অবস্থা থেকে বের হবে, তত দিন পরিস্থিতি উন্নতির আশা করা উচিত হবে না।

এ তো গেল বিস্ফোরণ, বাংলাদেশ তো ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশে এই ঝুঁকি কতটুকু? 

১০০ বছর আগে বাংলদেশে এর চেয়ে বড় ভূমিকম্পও হয়েছে। ১০০-২০০ বছরের মধ্যে আবার বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা আছে। কিন্তু আমরা সেই ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত নই। তুরস্ক ভূমিকম্পের জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করে। তারপরও সেখানে ভবন ভেঙে অনেক লোক মারা গেছেন। তার মানে ভবন ঠিক থাকলে এত ক্ষতি হতো না।

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের পূর্বানুমান সম্ভব?

আনুমানিক আন্দাজ করা যায়। ১৭৬২ সালে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। তার প্রায় আড়াইশ বছর পার হয়ে গেছে। এ রকম ভূমিকম্প আবার বাংলাদেশে হওয়ার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু তুরস্কের ভূমিকম্প নিয়ে তো তিন দিন আগেই টুইট করেছিলেন এক ডাচ গবেষক।

তিনি কীভাবে করেছেন তা আমার জানা নেই। ভূমিকম্পের পূর্বাভাসের জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ কোটি কোটি টাকা খরচ করেও সফল হয়নি। জাপানে ১৫ সেকেন্ড আগে পূর্বাভাস দেওয়ার প্রযুক্তি আছে। কিন্তু এগুলো কোনোটিই সঠিক বার্তা সব সময় দেয় না। নির্দিষ্ট তারিখ ও সময় কোনোভাবেই সম্ভব নয়।  আমেরিকা ও জাপান এখন পূর্বাভাস দেওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ১৫ সেকেন্ড আগে বার্তা পেলে তো মানুষকে বাঁচানো যাবে না। বাংলাদেশে আনুমানিক অতি সম্প্রতি (৫-২০ বছরের মধ্যে) একটি ভূমিকম্প হতে পারে এটা বলা যায়। মূল বিষয় আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।

রানা প্লাজা ধ্বংসের পর ২০০ কোটি টাকার সরঞ্জামও কেনা হয়েছিল। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে আপনি ছিলেন। সেসব সরঞ্জামের এখন কী অবস্থা?

আমাদের সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করার সুযোগ হচ্ছে না। কিন্তু এগুলো ব্যবহার করতে হবে, যত্ন নিতে হবে, না হলে নষ্ট হয়ে যাবে। এখন এগুলো কী অবস্থায় আছে তা আমার জানা নেই।

তুরস্কে কিন্তু সরঞ্জামের অভাব নেই- তারপরও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যায়নি।

ঠিকই বলেছেন, ভূমিকম্পে সরঞ্জামও অনেক সময় কাজে লাগে না। একটি দুটি ভবন হলে সরঞ্জাম কাজে লাগে, অনেক ভবন ধসে পড়লে উপায় থাকে না। রানা প্লাজায় প্রথম উদ্ধার কাজে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় জনগণ। এ জন্য লোকাল কমিউনিটিকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ঢাকায় ওয়ার্ড ও গ্রামে থানা পর্যায়ে মহল্লাভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানতে বাধ্য করতে হবে। পুরনো ভবনকে চিহ্নিত করতে হবে। রানা প্লাজা ধসের পর ৩ হাজার ৫০০ ভবনকে আমরা লাল, কমলা, সবুজ ও হলুদ রং দিয়ে চিহ্নিত করেছি। লাল হচ্ছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।

এভাবে চিহ্নিত করে ভবন মালিককে চাপ দিতে পারে সরকার।  সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে ভ‚মিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণে ব্যয়ও বেশি নয়। রাজউক থেকে সব ভবন মালিকের কাছে চিঠি দিতে হবে ভবন পরীক্ষা করে সনদ জমা দেওয়ার জন্য। ওই সনদ অনুযায়ী রাজউক ব্যবস্থা নেবে, ভবন কালার করে দেবে। এতে আগে থেকেই সরকার প্রস্তুতি নিতে পারবে। তবে এ কাজগুলো আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমেই করতে হবে। কারণ রাজউকের দক্ষ জনবল নেই। রানা প্লাজা ধসের পর ঢাকায় এখন অন্তত ৫০টি প্রতিষ্ঠান আছে যারা এসব কাজ করার সামর্থ্য রাখে। এ প্রস্তুতিগুলো আমাদের একটার পর একটা নিতে হবে।

এ কাজগুলো করতে হলে কী দরকার?

কিছুই না, শুধু দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সিদ্ধান্তগুলো চাপিয়ে দিতে এবং নাগরিকসহ সংশ্নিষ্ট সবাইকে এটি মেনে নিতে হবে। সে অনুযায়ী সার্কুলারগুলো আসতে হবে।

কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদদের তো এ কাজে বেশি আগ্রহ দেখা যায় না।

সেজন্য আমাদের দুই রকমের নেতা দরকার। এক ধরনের নেতা, বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। যিনি যে কোনো দুর্যোগ বুঝবেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। আমেরিকায় ডিজাস্টার জ্ঞানসম্পন্ন নেতা আছে। সেখানে কিছু এমপি আছেন যারা রাস্তা নিয়ে, কিছু পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন। তারা এসব নিয়ে সারা বছর লেগে থাকেন। ওই ধরনের মন-মানসিকতার নেতা তৈরি করতে হবে।

২০০১ সালে বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আপনি এর মহাসচিব- সেটির এখন কী অবস্থা?

জামিল স্যার (জামিলুর রেজা চৌধুরী) সভাপতি এবং আমি প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছিলাম। এরপর থেকে আমাদের কাজ ভালোই চলছিল। ২০১৫ সালের দিকে আমরা সেটি ছেড়ে দিয়েছি। কারণ সরকারের একজন যুগ্মসচিব সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হয়ে এর কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব আমাদের কাছ থেকে নিয়ে নেন। এরপর এই প্রতিষ্ঠানের আর কোনো খবর নেই। আমাদের দেশে ভালো কিছু করা কঠিন। আপনি সরকারকে নানা প্রস্তুতির কথা বলছেন, কিন্তু বেসরকারিভাবে ভূমিকম্প নিয়ে কি কাজ হচ্ছে?

বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চুয়েট ছাড়া বাংলাদেশে ভূমিকম্প নিয়ে কেউ কোনো কাজ করে না। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিকম্প নিয়ে ইনস্টিটিউট আছে। সেখান থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী বের হচ্ছে। কিন্তু তাদের কাজে লাগানোর জায়গা নেই। কিছু এনজিও কাজ করছে। সরকার থেকে নির্দেশনা না এলে বড় পরিসরে কাজও শুরু হবে না।

তুরস্কের ভূমিকম্পের পর রাজনৈতিকভাবে আমাদের নড়াচড়া বাড়াতে হবে এবং সেটি দীর্ঘমেয়াদি করতে হবে। এখানে সরকারের একটি টাকাও ব্যয় হবে না। দরকার শুধু মানসিকতার পরিবর্তন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh