সড়ক দুর্ঘটনা নিরসন প্রসঙ্গে

মাহবুব আলী

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৩, ০৯:১৫ এএম

মাহবুব আলী। ছবি: সংগৃহীত

মাহবুব আলী। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০২২ সালে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৯ হাজার ৯৫১ জন। ২০২৩-এর জানুয়ারি মাসের শুরুতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত ‘বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন ২০২২’ প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানানো হয়। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সড়কে দুর্ঘটনা ১৯.৮৯ এবং প্রাণহানি ২৭.৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রতিবেদনে সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ বিবেচনায় এও প্রকাশ পেয়েছে যে, বিগত আট বছরে নিবন্ধিত যানবাহনের পাশাপাশি মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে চারগুণ। এ ছাড়া সরকারের নির্দেশ অমান্য করে থ্রি-হুইলার, রিকশা-ভ্যানে মোটর বসিয়ে জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়কে নির্বিবাদে চলাচল করায় সড়ক দুর্ঘটনা পরিস্থিতি আরও জটিল ও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকেই সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্বের কারণে বরণ করে নিচ্ছেন অসহায়-পরনির্ভরশীল করুণ জীবন। বাংলাদেশ একটি জনসংখ্যা আধিক্যের রাষ্ট্র। কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না, তার যাত্রা সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। ট্রাফিক আইন জানেন না, এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল; কিন্তু সতর্কতা এবং আইন অনুসরণে মাঝেমধ্যে অনীহা বা অবহেলা দেখা যায়। আবার এও সত্য, একজন ব্যক্তি সবকিছু জেনেবুঝেই রাস্তায় চলছেন, অথচ অন্য কারও বেপরোয়া চলাচলের কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন।

আজকাল প্রায়ই আমরা খবরে পড়ি, ইজিবাইক বা সিএনজিকে বেপরোয়া গতিতে বাস বা ট্রাক পেছন দিক থেকে আঘাত করলে উক্ত লঘু যানবাহনের সকল যাত্রী মারা গেছেন। দুর্ঘটনা মাত্রই বিয়োগান্তক ও দুঃখজনক। মর্মন্তুদ এইসব ঘটনায় দেখা যায় নিহতেরা সকলেই একই পরিবারের সদস্য। নিঃসন্দেহে এমন দুর্ঘটনার খবরও পাঠকের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একটি প্রাণ অনেক মূল্যবান। সুতরাং যে কোনো মূল্যেই সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ বা নিরসন করতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিষয় বিশেষজ্ঞগণ বলে থাকেন, যানবাহনের বেপরোয়া গতি, সড়ক আইন না মানা ছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং, সড়কের নির্মাণ ত্রুটি, রাস্তার সংস্কার না হওয়া, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের চলাচল ইত্যাদি অনেক কারণ আছে। আইন প্রক্রিয়ারও দোষত্রুটি আছে বলে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের সোচ্চার বক্তব্য।

এ ছাড়াও রাস্তায় ফুটপাত দখল, রাস্তার উপর হাটবাজার, নিবন্ধনবিহীন চালক, চালকের মাদকাসক্তি, অন্যদিকে মনোযোগ, খোলা রেলক্রসিং ইত্যাদি অনেক কারণ অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে। এসবের মধ্যে থ্রি-হুইলার, মোটরচালিত রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইকও কম দায়ী নয়। 

বিগত বছরগুলোর দিকে একটু আলোকপাত করলে দেখা যায়, দেশে বেশুমার গতিতে ব্যাটারিচালিত লক্ষ লক্ষ ইজিবাইক এসেছে। এসব নতুন-পুরনো ইজিবাইকের সঠিক সংখ্যা কত হতে পারে বোধকরি সংশ্লিষ্টদের তথ্য-উপাত্তে নেই। দেশের চৌষট্টি জেলায় কত সংখ্যক ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক বা অটোরিকশা চলে, সেটি সকালবেলায় রাস্তায় তাকালে সহজেই অনুমেয়।

এসব ইজিবাইক সারাদিন রাস্তা জ্যাম করে রেখে দেয়। সরকার এবং নিরাপদ সড়ক পরিকল্পপনা বাস্তবায়নকারীদের অসতর্কতা-অমনোযোগিতা-অবহেলা এবং দায়হীন দায়িত্বের কারণে যানজট ও দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের দেশে ইজিবাইক বা অটোরিকশা ২০০৭ সালে প্রবেশ করে। এই হালকা যানবাহন ডিজেল বা পেট্রোল চালিত নয় বিধায় কার্বন-মনোঅক্সাইড বা বিষাক্ত ধোঁয়া নেই, মূল্য কম, মানুষের কায়িক শ্রম লাগে না, অধিকন্তু প্রায় শব্দহীন বলে শব্দদূষণ নেই, অল্প দূরত্বের গন্তব্যে যেতে-আসতে সহজলভ্য ও সুবিধাজনক ইত্যাদি কারণে খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে ১৫ থেকে ১৬ লক্ষ ইজিবাইক সারাদেশে চলাচল করছে বলে জানা যায়। 

ইজিবাইক ব্যাটারি চার্জের জন্য শহর ও গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় নতুন এক ব্যবসা বা পেশাজীবীর সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ চার্জিং স্টেশন। অভিযোগ পাওয়া যায় যে, এসব চার্জিং স্টেশনের কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ বিভাগের একশ্রেণির অসাধু কর্মীর মাধ্যমে অবৈধ সংযোগে বিদ্যুৎ চুরিও হয়। কখনো বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা ঘটে। সড়কে অসহনীয় যানজট ও দুর্ঘটনার জন্য এই ইজিবাইক অনেকাংশে দায়ী বলে অভিজ্ঞ মহলের বিশ্বাস। 

বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয়েছে এভাবে যে, প্রথমত ইজিবাইক কারা চালায়? তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি না? দ্বিতীয়ত ইজিবাইকের ফিটনেস ও সার্ভিস মেয়াদ অর্থাৎ একটি নতুন ইজিবাইক কত দিন পর্যন্ত সুষ্ঠুরূপে ব্যবহারযোগ্য? তৃতীয়ত একটি শহরে কতগুলো ইজিবাইক পর্যাপ্ত বলে মনে করা যেতে পারে ও সড়ক পরিকল্পনা-ব্যবস্থাপনা-নিয়ন্ত্রণ কোন পর্যায়ে আছে? অকেজো ও বিপজ্জনক ব্যাটারি বা ইজিবাইকের ডাম্পিং বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা আছে কি না?

আমরা যদি প্রথম প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধানে যাই, দেখতে পাব যে, দেশের প্রত্যেক শহরে ইজিবাইকের বেশিরভাগ চালকই হচ্ছেন সাবেক রিকশাচালক, যারা প্যাডেলে অভ্যস্ত। এ ছাড়া বারো-চৌদ্দ বছরের কিশোর থেকে শুরু করে পঁয়ষট্টি-সত্তর বছরের বৃদ্ধও চালক হিসেবে সহজ দৃশ্যমান। ইজিবাইক চালকের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স করতে হয় ইজিবাইকের এবং সেটি স্থানীয় পৌরসভা ইস্যু করে থাকে। আশ্চর্য বিষয় এই যে, একজন কিশোর বা বৃদ্ধ রুটিরুজির কারণে ইজিবাইকের হ্যান্ডেল ধরছেন, বাস্তব পরিস্থিতি এটি কতটা বিপজ্জনক তা বিবেচনায় আনা হয় না। 

আমরা দেখি মুখোমুখি বা পেছন থেকে ট্রাক বা বাসের ধাক্কায় যে ইজিবাইকের চার-পাঁচজন আরোহী, একই পরিবারের সদস্য ছিলেন, তার চালক প্রায়ই একজন কিশোর বা বৃদ্ধ। বৃদ্ধ মানুষের চোখের দৃষ্টি ও কানের শ্রবণশক্তি ক্ষীণ, অথচ তিনি এসব বিনাবাধায় চালাচ্ছেন। 

দ্বিতীয়ত একটি নতুন ইজিবাইকের মূল্য দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকা। এই ইজিবাইক সুষ্ঠুভাবে কত বছর চলাচল উপযুক্ত থাকে, সেটি নির্ধারণ ও কার্যকর মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক চালকই ইজিবাইক পুরনো হয়ে গেলে তিরিশ-চল্লিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন। তখন অন্য চালক ফিটনেসবিহীন ইজিবাইকে যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় চলাচল করে থাকেন। 

দেশে কোথাও কোনো ডাম্পিং গ্রাউন্ড নেই। স্বাভাবিক মনিটরিং কি ট্রাফিক সপ্তাহ উদযাপনে মোটরসাইকেলের কাগজপত্র কঠোরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও ইজিবাইকের ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। তৃতীয়ত দেশের জেলা শহরগুলোতে সড়ক বা রাস্তা তৈরির অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি বা সমস্যা দেখা যায়। এরপর রয়েছে ফুটপাত দখল, রাস্তার উপর অবৈধ দোকানপাট, স্কুলের শুরু ও ছুটির সময় ইত্যাদি প্রেক্ষিত। এর কারণে ইজিবাইক ভয়ংকর যানজট তৈরি করে থাকে। 

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর অকালে অনেক প্রাণ ঝরে যায়। কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে পরিবারে কষ্টের কারণ হন। সরকারের উচিত থ্রি-হুইলার, রিকশা-ভ্যানে মোটর সংযোগ কঠোরভাবে বন্ধ করা। তেমনই ইজিবাইক চলাচল নিয়ে খুব দ্রুত বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। 

কথাসাহিত্যিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh