তীব্র রাজনৈতিক বিভাজনে পাকিস্তান

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৩, ১০:০০ এএম

ইমরান খানের ব্যানারকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা এক আন্দোলনকারী। ছবি: এপি

ইমরান খানের ব্যানারকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা এক আন্দোলনকারী। ছবি: এপি

গত এক বছর ধরে রাজনৈতিক ও আর্থিক সংকটে বিপর্যস্ত পাকিস্তান। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে একঘরে করতে প্রায় সব রাজনৈতিক দল মিলে জোট গঠন করে। অভিযোগ উঠেছিল দুর্নীতি ও আর্থিক সংকট মোকাবিলা করতে না পারার।

তবে পদচ্যুত হলেও রাজনীতিতে সমান সক্রিয় রয়েছেন ইমরান। বরং আগের চেয়ে শক্তিশালীভাবে জনসমর্থন নিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সম্প্রতি ইমরানকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা লক্ষণীয়। আর তা কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। আর এতে দেশটির রাজনৈতিক বিভক্তি ও সামরিক অন্তর্ভুক্তি আরও তীব্র হচ্ছে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, পাকিস্তানের ইতিহাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতার পরই এসেছে সামরিক আইন জারির বিষয়টি। তবে এমন আর্থিক সংকটে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করবে কি না, সেটি কোনোভাবেই নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ এতে সামরিক বাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

আর্থিক দুর্নীতি মামলায় ইমরানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর থেকেই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সমর্থকেরা দেশজুড়ে আন্দোলন তীব্র করে। পুলিশ যেন ইমরানকে গ্রেপ্তার করতে না পারে, সেজন্য গত ১৪ মার্চ পাকিস্তানের লাহোরের জামান পার্কের বাড়ির সামনে জড়ো হন কয়েক হাজার সমর্থক।

পুলিশ ও ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলতে থাকে। দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। ইটপাটকেল, কাঁদানে গ্যাসের শেল, পেট্রলবোমা-পুরো রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে জামান পার্কে ইমরানের বাড়ির আঙিনা। তবে পিটিআই কর্মী-সমর্থকদের বাধার মুখে পিছু হটে পুলিশ। ইমরানকে গ্রেপ্তার না করেই ফিরতে হয় তাদের।

যদিও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়েই সেখানে গিয়েছিল পুলিশ। ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় পাওয়া উপহার রাষ্ট্রীয় তোশাখানায় জমা না দিয়ে বিক্রি করেছেন তিনি। এ ঘটনায় পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন মামলা করেছে। জারি হয়েছে অজামিনযোগ্য পরোয়ানা। নানা নাটকীয়তার পর ১৭ মার্চ লাহোর হাইকোর্টে হাজির হন ইমরান। সঙ্গে ছিল হাজারো কর্মী-সমর্থক। ১৮ মার্চ শুনানি পর্যন্ত পরোয়ানা স্থগিত করেন আদালত। 

ইমরান যখন আদালতের পথে তখন লাহোরে জামান পার্কে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ বাহিনী। এ অভিযানে ইমরানের বাসভবন থেকে অ্যাসল্ট রাইফেল ও বুলেট উদ্ধারের দাবি করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় রাষ্ট্রীয় কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে ইমরানের দলের ৬০ জনের বেশি কর্মী-সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বাড়িতে পুলিশের অভিযানের কথা শুনে ইমরান টুইট করে বলেন, ‘পাঞ্জাব পুলিশ আমার বাড়ি জামান পার্কে হামলা চালিয়েছে, সেখানে আমার স্ত্রী বুশরা বেগম একা। কোন আইনে তারা এমনটা করছে? এটি লন্ডন পরিকল্পনার অংশ। যেখানে একজনকে নিয়োগে সম্মত হতে পলাতক নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।’

ইমরানের দল পিটিআইয়ের পোস্ট করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, বাড়ির ভেতরে পুলিশ দলের কর্মীদের পেটাচ্ছে। আরেক কর্মীর পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায়, জামান পার্কের বাড়ির সামনের ফটকের পাশের দেয়াল এক্সকাভেটর দিয়ে ভাঙা হচ্ছে। এরপর ফটক দিয়ে পুলিশের সদস্যরা ভেতরে প্রবেশ করেন। পুলিশ ইমরানের বাড়িতে অভিযানের আগে ঘোষণা দেয়, ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। জমায়েত নিষিদ্ধ।

পাঞ্জাবের আইজিপি উসমান আনোয়ার এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, পুলিশ জামান পার্ক এলাকায় অনুসন্ধান ও উচ্ছেদ অভিযান সম্পন্ন করেছে। এ অভিযানে প্রচুর গুলি ও একে-৪৭ রাইফেল জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া ককটেল তৈরিতে ব্যবহৃত কাচের বোতল ও পুলিশের ওপর আক্রমণে ব্যবহৃত মারবেল উদ্ধার করা হয়েছে।

তিনি আরও দাবি করেন, ইমরানের বাড়ি থেকে পাঁচটি কালাশনিকভ রাইফেল উদ্ধার করা হয়েছে। এগুলোর বৈধতা যাচাই করা হচ্ছে। ইমরানের বাড়িতে অভিযান চালাতে বাধা দেওয়ার জন্য কনটেইনার বসানো হয়েছিল। এগুলো এখন পরিষ্কার করা হয়েছে। এ সময় পুলিশ জলকামান, দাঙ্গা পুলিশ, প্রিজন ভ্যান ব্যবহার করেছে। ৬০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অজ্ঞাত স্থানে নেওয়া হয়েছে।

ইমরানের বাড়ির বাইরে বানানো বিভিন্ন অস্থায়ী শিবির উচ্ছেদ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, পুলিশের ওপর হামলার তদন্তের অংশ হিসেবে লাহোর হাইকোর্ট ইমরানের জামান পার্কের বাসভবনে তল্লাশি করার অনুরোধ মঞ্জুর করেন। পাঞ্জাবের আইজিপি আনোয়ার এ অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় অদক্ষতার অভিযোগে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন তার রাজনৈতিক বিরোধীরা। পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরান সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা হাতে নেয় শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক জোট পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)। এরপর সময় পেরিয়েছে ১০ মাস। এ সময়ে পাকিস্তানের অর্থনীতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। দেশটি এখন দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এর ফলে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। 

ইমরানের বাড়িতে পুলিশি অভিযানের সমালোচনা হয়েছে বিভিন্ন মহলে। গত বছরের এপ্রিলে পার্লামেন্টের অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে তিনি পাকিস্তানজুড়ে লংমার্চ করেছেন। লংমার্চে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সুস্থ হয়ে আবারও পথে নেমেছেন ইমরান। দাবি, জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা। এবার তিনি ডাক দিয়েছেন ‘জেল ভরো’ আন্দোলনের।

অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রেপ্তার হয়ে পাকিস্তানের কারাগারগুলো ভরিয়ে ফেলতে দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামরিক বাহিনী সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

পাকিস্তানে রাজনীতিই শেষ কথা নয়। সামরিক আমলাতন্ত্র সেখানে ক্ষমতাচর্চার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। যে কারণে সেখানে ক্ষমতায় থাকা বা না থাকার বিষয়টি অনেক ‘তবে-কিন্তু’র উপর নির্ভরশীল। সামরিক বাহিনীর মার্কিনপন্থি অবস্থানের পরিবর্তন ছাড়া মার্কিনবিরোধী কেউ ক্ষমতায় বেশি টিকে থাকতে পারবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

যদি ইমরান তা করতে চান, তাহলে হয় তাকে মার্কিন প্রশ্নে নমনীয় হতে হবে, তা না হলে গোটা সামরিক আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি নিয়ে মাঠে নামতে হবে। পাকিস্তানে রাজনৈতিক ক্ষমতা কখনোই সামরিক বাহিনীর বাইরে যে ছিল না, সেটিও ইমরান স্পষ্ট করেই বলেছেন। আর এটি গোটা ব্যবস্থাপনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। যদিও ২০১৮ সালে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নিয়েই ক্ষমতায় বসেছিলেন ইমরান। 

পদচ্যুত হওয়ার পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইমরান সাবেক সেনাপ্রধান জাভেদ কামার বাজওয়া সম্পর্কে বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শুধু একজন ব্যক্তি দায়ীজেনারেল (অব.) বাজওয়া। আমাদের শত্রুরা এত ক্ষতি করতে পারেনি, যা তিনি করেছেন। আমি তার বিরুদ্ধে কথা বলিনি কারণ তিনি সেনাপ্রধান ছিলেন।

আমরা চাই আমাদের সেনাবাহিনী শক্তিশালী হোক তাই আমরা চুপচাপ থাকলাম এবং কীভাবে ষড়যন্ত্র হলো তা দেখতে থাকলাম। আমি প্রধানমন্ত্রী ছিলাম; কিন্তু মূল ক্ষমতা ছিল বাজওয়ার হাতে।’ বাজওয়া পিটিআইকে ক্ষমতা থেকে সরাতে সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীকে ব্যবহার করেছে বলেও ইমরান অভিযোগ করেন।

সম্প্রতি ইমরান ভয়েস অব আমেরিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পাকিস্তানের এখনকার পরিস্থিতির পেছনে একজন ব্যক্তি কলকাঠি নাড়ছেন। তিনি নাম উল্লেখ না করলেও, এই ব্যক্তি যে পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান আসিম মুনির, তা স্পষ্ট। এখানে আসিম মুনির বা বাজওয়া শুধুই ভিন্ন দুটি নাম। মূল সমস্যাটা যে পাকিস্তানের সামরিকতন্ত্রের রাজনৈতিক ক্ষমতার লিপ্সা, সেটি ইতিহাস থেকে স্পষ্ট।

পাকিস্তানের করাচির সেন্টার ফর এক্সিলেন্স ইন জার্নালিজমের পরিচালক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আম্বের রহিম শামসি বলেন, ‘এখানে ইমরান খান ব্যতিক্রম। সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে ক্ষমতা হারানোর পর পাকিস্তানের আর কোনো নেতা এত বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে, পরাক্রম নিয়ে রাজনীতি করতে পারেননি। এমন নজির পাকিস্তানে নেই বললেই চলে।

ইমরান এই ইতিহাস ভেঙে দিয়েছেন। পাকিস্তান এখন এমন এক পর্যায়ে রয়েছে, গণতন্ত্র আর কর্তৃত্ববাদের মধ্যবর্তী এক অরাজক সময়কাল চলছে। এখন দেখার বিষয়, এ পরিস্থিতির সুবিধাভোগী কে হবে দেশটির সামরিক বাহিনী, নাকি বেসামরিক শক্তি।’


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh