বারান্দায় বৃষ্টি

আরিফুল হাসান

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৩, ১১:১৫ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

শেখ মুজিব ভাষণ দেবে, এ নিয়ে  হৈচৈ পড়ে যায় সাতমোড়া গ্রামে। ঢাকা থেকে এতদূর, এতদূর পর্যন্ত ডাক চলে এসেছে এবং সবাই যাচ্ছে যার যার সামর্থ্য মতো। রান্নাঘর থেকে মা ডেকে বলছে ছেলেকে, ছেলে হয়তো মাঠ থেকে এসেছে কৃষিকাজ সেরে, মা ডাকে, ইসমাইল, ও আব্বা ইসমাইল? জি আম্মা, ছেলে জবাব দেয়।

মা বলে-যাও না বাবা ঢাকায়, শেখ মুজিব নাকি ভাষণ দিবো। যাও, হুইনা আহো। ছেলের হয়তো ভালো লাগে। হাতমুখ ধুয়ে রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশে। আরো অনেকে অনেকে রওনা হয়। তারা যায়, মাঠের পরে মাঠের আলপথ ভেঙে যায়। গিয়ে নৌকায় ওঠে। নৌকা থেকে নেমে আবার হাঁটে। তাদের হাঁটার কাফেলা দীর্ঘতর হয়। পথে পথে লোক যুক্ত হয় সেই অভিযানে। তারুণ্যের উদ্যম কণ্ঠ আজ প্রতিবাদে জ্বালবে আগুন।

সে ভাষণ শুনতে অনেকের মতো হাফেজ মনিরুল ইসলামের সাধ হয়। বিয়ে-শাদি করেনি, থাকে মাদ্রাসাতেই। সদ্যপাস করা হাফেজের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার খুব শখ হয়। হায়, কেউ যদি নিয়ে যেত! সে তো অক্ষম, চোখ দুটো চোখে নেই। শৈশবে টাইফয়েডে গেছে।

আর তারপর সর্দার বাড়ির তুখোড় ছাত্রটি গিয়ে, এসে ভর্তি হয় হাফেজি মাদ্রাসায়। ছেলে তার মাদ্রাসাতে বহুদূরে, ভেবে তার শরীফ মায়ের চোখে অশ্রু ঝরে। তিনি কাঁদেন, মোনাজাতে হাত তোলেন-হে আল্লাহ, ছেলেটাকে আমার হাফেজ বানিয়ে দাও।

ছেলে হাফেজ হয়। তবে আরও কিছু দিন থাকতে হবে মাদ্রাসাতে। মাদ্রাসার পাশেই তার লজিং বাড়ি থেকে খাবার আসে। হাফেজ মনিরুল ইসলামের মুখ দিয়ে খাবার ঢোকে না। উৎকণ্ঠায় তার ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় পাখি হয়ে, ঝড় হয়ে রেসকোর্স ময়দানে।

রেইসকোর্সে জনতার ঢেউ নামে। ফিরে এসে মানুষেরা পৌঁছে দেয় খবরাখবর। তারা জানে, এখনই তাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তারা মাঠে ময়দানে মানুষের ভেতর যুদ্ধের বীজ পুঁতে দিতে থাকে যেন তার থেকে লাল সবুজের একটি পতাকা তারা অর্জন করতে পারে।

যুদ্ধটা মনে মনে বপন করে নেয় হাফেজ মনিরুল ইসলামও। সে যুদ্ধের প্রারম্ভিক দিক থেকে যে হাহাকারময় চারপাশ, তা অনুভব করত কুরআনের আয়াতের তেলাওতের ফাঁকে। তার চোখ ভিজে উঠত। দূরে মা বাবা থাকেন। এই যুদ্ধের সময় তারও বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ নেই। 

সে যুদ্ধে যাবে, সে সুযোগও নেই। তবে সে যুদ্ধে যাবে। জীবনে একবার হলেও যাবে এরকম পণ করার পর তার উস্তাদ তাকে নিবৃত্ত করে, চোখে চোখে রাখে। তার সাথে আর অন্য ছাত্রবন্ধুদের তেমন মিশতে দেন না। দেওবন্ধ থেকে পাস করা উস্তাদ রাজনৈতিকভাবে কী ভাবে জানে না, তবে হাফেজ মনিরুল ইসলাম এতটুকু জানে যে, 

পিতৃস্নেহে উস্তাদ তার যেতে দিচ্ছে না কোনো ছাত্রকে, তবু পালিয়ে চলে গেছে কেউ কেউ, রহমত গেছে, নিয়াজ গেছে, আরো অনেকেই। হাফেজ মনিরুল ইসলামকে শুধু কেউ নিয়ে যায়নি। তার পরানে দুখ।

মনিরুল ইসলাম ফিরে আসা মানুষদের কাছ থেকে কথা শোনে, শোনে ইঙ্গিতে মুজিব সব বলেছেন। বলেছেন স্বাধীনতার কথা। বলেছেন, বলেছেন ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে। হাফেজ মনিরুল ইসলাম কী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন? তার তো চোখে আলো নেই। যাকেই চুপিচুপি বলে-তোমরা যদি যুদ্ধে যাও আমারেও সাথে নিও। সেই মুখ পিছলায়।

এই অন্ধ মানুষটাকে নিয়ে হয়তো হাঙ্গামাই বাড়বে। হাফেজ মনির তাদের বুঝায়, বন্ধুরা, আমারে তোমরা সামনাসামনি বসাইয়া দিও। দুইচাইরটারে না মাইরা মরতাম না। বন্ধুরা তার খিলখিলিয়ে হাসে। তুই থাক বন্ধু, তুই আমাদের জন্য দোয়া করিস। পাগড়ির দীর্ঘপ্রান্তটি দিয়ে হাফেজ মনিরুল ইসলাম চোখ মোছে, যুদ্ধ কি সত্যিই শুরু হইয়া যাইবো?

যুদ্ধ শুরু হয়। এতদিন যে বীজ বুনে দিয়েছে রেসকোর্স ফেরত লোকেরা, সে বীজের আগুন হয়ে ফুটে উঠেছে পঁচিশে মার্চের রাতের পর। রেসকোর্স ফেরত লোকেরা এবং তাদের সাথে যারা বুকে আগুনের বীজ পোঁতার জন্য মাঠ প্রস্তুত করে দিয়েছিল তারা, তবু সব মিলিয়ে তারা দশ বারোজনের বেশি হয় না, তারা, তারা এবং তারা, আর যারা বিরোধিতা করে তারা ছাড়া তারা, আর সবাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা।

এ দলটি জড়ো হয়ে মাঠের উত্তরদিকে হল্লা করতে করতে কোথায় যেন যায় এবং কিছুক্ষণ পর আবার তারা ফিরে আসে এবং মাদ্রাসার মাঠে গোল হয়ে জড়ো হয়। হয়তো সেখান থেকে তারা স্কুলের মাঠে যায়। হয়তো সব জায়গার আগুন  সব জায়গায় ছড়িয়ে তারা আরও বেশি মানুষের কাছে যায়। এবং যায় তারা প্রাণের আকুল টানে।

সে যাওয়া তাদের সময়কে সংক্ষেপ করতে ভালোবাসে এবং আরও বেশি সময়, আরও আরও সময় তাদের যাত্রা আরও দীর্র্ঘতর হয়ে উঠলে বিপরীত দিকের জানালা তখন খুলতে থাকে।

গেদু চেয়ারম্যানের বাড়িতেও লোক জমতে থাকে। তারা একদিন মাদ্রাসার সব হাফেজদের তলব চায় উস্তাদের কাছে এবং তিনজন ছাত্রের তলব না দিতে পারায় উস্তাদকে বেধড়ক মারধর করে। গ্রামে এইসব কী শুরু করছো উস্তাদ, এইসব ভণ্ডামি আমার এহানে চলবে না। সাফ সাফ বলে দিলাম, পাকিস্তান আমরা রাখমুই।

উস্তাদ ফিরে আসে, তার কাটা ঘা-গুলোতে আন্দাজে হাফেজ মনিরুল ইসলাম মলম লাগিয়ে দেয়। তার চোখ থেকে দু-ফোঁটা অশ্রু হয়তো ঝরে পড়ে শিক্ষকের করপুটে।

সে মুক্তিযুদ্ধে যেতে চায়। গ্রাম থেকে অনেকেই গিয়েছে। সে যে যেতে চায় এ খবরও অনেকের কাছে পৌঁছে গেছে। অনেকে তাকে দুশমন ভাবে, অনেকে আবার পরম শ্রদ্ধা করে। লজিং বাড়ি থেকে খাবার আসলে হাফেজ মনিরুল ইসলাম খায়, না হলে না খেয়ে পড়ে থাকে। এই যুদ্ধের সময় কে কাকে খাবার এনে দিয়ে যাবে? কারোরই তো ঘরে ঠিক খাবার নেই। সবার অভাব। অভাব। কোথাও যাওয়ার নেই, উৎপাদনের পথ নেই, নেই ইনকামের পথ।

মার্চ মাস যায়, এপ্রিলের শুরুতে ঝড়-বৃষ্টি নেমে এলে হাফেজের মনটা বজ্র হয়ে পড়তে চায় পাকিস্তানিদের উপর। গেদু চেয়ারম্যানের এক কথা, মাদ্রাসার আর একটি ছাত্রও যেন না হারায়। উস্তাদ কড়া নজর রাখে। ঝড় শেষ হয়ে গেলেও ছাত্ররা আর কেউ যেতে পারে না যুদ্ধে।

তবে যুদ্ধটা কিছুটা মোড় পরিবর্তন নিয়েছে যে বুঝে হাফেজ মনিরুল ইসলাম। এখন আর গেদু চেয়ারম্যানের প্রথমদিকের মতো তেমন ক্ষমতা মেনে নেয় না সাধারণ মানুষ। তাই গেদু চেয়ারম্যান এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প আনবে বলে ঘোষণা দেয়। ক্যাম্প আনেও।

স্থানীয় স্কুল ভবনটাকে লণ্ডভণ্ড করে সেনাবাহিনী আসে। তবে তার সাথে আসে মুক্তিবাহিনীও, তারা আসে গোপনে। রাতের অন্ধকারে তারা এসে চাঁদগুলোকে নিয়ে যায় জ্যোৎস্না তোলার অভিলাষে।

একদিন গোপনে একটি নৌকা ভেড়ে মাদ্রাসার ঘাটে। চাঁদের সাথে কেউ কি তখন জেগেছিল? শবে বরাতের রাতের পর-রাতে যে জ্যোৎস্না উঠেছিল মাঠভরে তখন আর কেউ জেগে না থাকলেও জেগেছিল হাফেজ মনিরুল ইসলাম এবং তাকে পাহারা দিতে অবধারিতভাবে জেগে ছিলেন উস্তাদ।

নৌকা থেকে নিঃশব্দে দুজন লোক নামে। হাফেজ মনিরুল ইসলামকে, উস্তাদকে বলে তাদের সাথে যেতে। অস্ত্রের সাজে তাদেরকে দেখে উস্তাদ আর না করতে পারেনি এবং প্রিয় ছাত্র হাফেজ মনিরুল ইসলামকে এসব বুঝতে না দিয়ে বলে সে যেন আপত্তি না করে। উস্তাদের আদেশ মতো অন্ধ হাফেজ নৌকার পাটাতনে গিয়ে বসে।

উস্তাদের হাত মৃদু মৃদু কাঁপছে মনিরুল বুঝতে পারে। একসময় কাটাপানিকে পার হয়ে তারা তীর থেকে অনেক দূর সরে আসলে তখন আগন্তুকেরা বলে হাফেজ মনিরুল ইসলাম, বন্ধু হে, আজকে তুমি যুদ্ধ করবে। শবে বরাত আমরা পালন করতে পারিনি। আমাদের অবস্থান লোকেদের জানানো যাবে না, আমরা নৌকায় ভাসমান। আজ এখানে তো কাল এখানে।

দেশমাতার যখন ঠিক নেই, তখন আমাদের বাসস্থান থাকতে পারে কীভাবে? তোমার বন্ধু রহমত, নিয়াজদের কাছ থেকে শুনেছি, তোমাকে আমরা নিতে এসেছি। গতকালের শবে বরাতের মিলাদ তুমি এখন আমাদের জন্য পড়বে, আল্লাহর কাছে দোয়া করবে, বাঙালির ভাগ্যে যেন তিনি বিজয় লেখে দেন।

মিলাদ শেষ হয়, শেষ রাতে জোর বৃষ্টি নামে আবার, সে বৃষ্টির স্তব্ধতায় শুধু বৃষ্টির আওয়াজ ছাড়া প্রকৃতির সুনসান নীরবতার মতো নৌকাটা আবার মাদ্রাসারঘাটে এসে ভিড়ে, ভিজে চুপসে হয়ে উস্তাদের হাত ধরে হাফেজ মনিরুল ইসলাম নামে, কিন্তু তার মনটা যেন থেকে যেতে চায়, ফিরে যেতে চায় আগন্তুকদের সঙ্গে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh