সৌদি-ইরান সম্পর্ক, চীনের সফলতা

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৩, ০৯:৪৯ এএম

চীনের মধ্যস্থতায় সাত বছর পর ইরান ও সৌদির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলো। ছবি: সংগৃহীত

চীনের মধ্যস্থতায় সাত বছর পর ইরান ও সৌদির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলো। ছবি: সংগৃহীত

চীনে চার দিনের গোপন আলোচনার পর গত ১১ মার্চ ইরান ও সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেওয়া হয় এবং উভয় দেশই দুই মাসের মধ্যে দুই দেশে দূতাবাস খুলবে। ২০১৬ সালে সৌদি আরবে শিয়া ধর্মীয় নেতার মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে ইরানে সৌদি দূতাবাসে আগুন দেওয়ার পর থেকে দুই দেশের মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। 

ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের আলী সামখানি ওই বৈঠকের পর বলেন, এই সমঝোতা গোটা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টার একটা অংশ। উভয় দেশই তাদের জাতীয় এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সম্মত হয়েছে। একই সঙ্গে এই সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্যে বাইরের শক্তিদের প্রভাবকে ব্যালান্স করবে। তবে এই সমঝোতার ফলে ইসরায়েল নাখোশ হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। 

আল জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই সমঝোতা সরাসরি প্রতিফলিত হবে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে; যেখানে সৌদি আরব ও ইরান জড়িত। একই সঙ্গে লেবাননের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ইরাক ও সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতেও এই সমঝোতার প্রভাব পড়তে পারে। তবে দুই দেশের মাঝে সমঝোতায় কেউ অবাক হয়নি; কারণ অনেক আগে থেকেই দুই দেশের মাঝে আলোচনা চলছিল। বিশেষ করে ২০২১ সাল থেকে ইরাকের মধ্যস্থতায় আলোচনার সুবাদে উভয় দেশের কর্মকর্তারা বাগদাদে পাঁচবার মিলিত হয়েছেন। এছাড়া দুই দেশের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ওমানেও বেশ কয়েকবার আলোচনা করেছেন। 

তবে যখন আব্রাহাম একর্ডের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইছে, তখন ইরানের সঙ্গে সৌদির সম্পর্ক উন্নয়ন ইসরায়েলের পছন্দ হওয়ার কথা নয়।

কারণ এর মাধ্যমে ইরানকে একঘরে করার ইসরায়েলি চেষ্টায় ভাটা পড়বে। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কারবি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই সমঝোতাকে স্বাগত জানাচ্ছে। বিশেষ করে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ বন্ধে এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা নিরসনে এ সমঝোতা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে বলে যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে। 

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক গালফ রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ সাগের বলেছেন, এই সমঝোতার মূলে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার কথা বলা হয়েছে এবং উভয় দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। সৌদি চাইছে যাতে ইরান তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে।

এছাড়াও জ্বালানি ও নৌ নিরাপত্তা এবং ইয়েমেন, লেবানন ও সিরিয়াতে ইরানের ভূমিকার ব্যাপারে সৌদিরা নিশ্চিত হতে চাইছে। আর চীনের জ্বালানির প্রায় ৩৬ শতাংশ যখন উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে আসে, তখন এই সমঝোতায় বেইজিংয়ের স্বার্থ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। 

সৌদি আরবের গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল-ফয়সাল বলেছেন, চীন যে এখানে মধ্যস্থতা করতে পারে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের কোনো দেশেরই সৌদি আরব ও ইরানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক নেই।

যেহেতু সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সরাসরি কিছু বলা হয়নি, তাই এই সমঝোতা ইসরায়েলের উপরে কতটা প্রভাব রাখতে পারে, তা বলা যাবে না। আর ইসরায়েল যদি ইরানের উপর হামলা করতেই চায়, তাহলে তারা ছুতো খুঁজবে না। 

জার্মান থিঙ্কট্যাঙ্ক কারপোর জ্যেষ্ঠ গবেষক সেবাস্টিয়ান সন্স বলেছেন, তার মনে হয় না, এটা কৌশলগত কোনো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। এটা মূলত দুই দেশের স্বল্পমেয়াদি স্বার্থকে কেন্দ্র করেই করা হয়েছে। সৌদি বরাবরই তেলের বাজারে উচ্চমূল্য দেখতে চায়। সেই হিসেবেই তারা রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইছে। একই সঙ্গে সৌদি ও ইরানের চলমান আলোচনার সুযোগ নিয়েছে চীন। 

আব্দুল আজিজ সাগের বলেছেন, এর আগে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার সামরিক উপস্থিতি কমায় এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে মোতায়েন করা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও সরিয়ে ফেলে। এছাড়াও ২০১৯ সালে সৌদি তেল স্থাপনার উপর হামলায় ইরানের জড়িত থাকার প্রমাণ দিলেও যুক্তরাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। যেগুলো সৌদির কাছে ভুল বার্তা দিয়েছে।

এর ফলে অনেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নির্ভরযোগ্য বন্ধু কিনা। এ কারণে সৌদি আঞ্চলিক নিরাপত্তার দিক থেকে বিকল্প বাড়াতে চাইছে। যার ফলস্বরূপ, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সরাসরি রাশিয়ার বিরোধিতা করেনি। পাশাপাশি চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিক রেখেছে। 

মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ইউরেশিয়া গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান ব্রেমার বলেন, ইন্দোপ্যাসিফিকে কোয়াড ও অকাসের মাধ্যমে এবং ইউক্রেন যুদ্ধে সামরিক সহায়তা দিয়ে নিরাপত্তার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ থাকছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন ভুল অবস্থানে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কদের বিরাগভাজন হচ্ছেন।

একই সঙ্গে সৌদি আরবের তেল স্থাপনার নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীন থেকে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছে; যা চীনকে সুযোগ করে দিয়েছে। আর ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে চীন শান্তি প্রস্তাব দেওয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী তাদের অবস্থান আরও সুসংহত হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে বেইজিংয়ের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বাড়বে। তবে এখনো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইন্টেলিজেন্স ও অস্ত্রের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপরেই নির্ভরশীল। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh