ওয়াসীম পলাশ
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ১২:২২ পিএম | আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ০২:০০ পিএম
গল্প। প্রতীকী ছবি
দীর্ঘমেয়াদি এক বন্যা জেঁকে বসেছে এ অঞ্চলে, প্রশাসনের লোকজনের খাটুনির শেষ নেই। সবাই হিমশিম খাচ্ছে। সাজ্জাদ হোসেন সারাদিন অনেক পরিশ্রমের পর বাসায় ফিরে মাত্র বসেছেন, অমনি ইউএনও সাহেবের ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনটা ধরে মিনিট দু-এক কথা শোনেন, কোনো কথা বলেন না। ফোনটা কেটে দেওয়ার পর চুপচাপ জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। দীর্ঘমেয়াদি এ বন্যার প্রকোপ উপজেলা সদর পর্যন্ত পৌঁছেছে।
বছর তিনেক আগে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন সাজ্জাদ হোসেন, এখন সহকারী কমিশনার (ভূমি)। অল্প কিছুদিন হলো এই এলাকায় এসেছেন। এর মধ্যে গত ১৫ দিন বন্যা উপদ্রুত। জেলার এই অংশে বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিজের রুটিন কাজের বাইরে বন্যায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ও এ সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনার ব্যস্ততায় দম ফেলবারও সময় নেই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার ওপর অনেকটা আস্থাশীল।
ইতিমধ্যেই এলাকায় একটা সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। শুরু থেকেই ডিপার্টমেন্টের সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, যদিও কিছু ব্যাচমেট একটু ঈর্ষা করে। কিছু সিনিয়র শুভাকাঙ্ক্ষী প্রায়ই বলেন, কেন যে সাজ্জাদ গিয়ে ফিল্ডে পড়ে আছে? ব্রিলিয়ান্ট অফিসার উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফরেন লোভনীয় পজিশনগুলোতে কাজ করবে, তা না ওই মফস্বলে গিয়ে কাদামাটি মাখামাখি করছে।
রাতের খাবার খেতে বসার আগে একটা ফোন করেন বরইতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইউসুফ হাওলাদারকে। ইউসুফ চেয়ারম্যান একজন হাতখোলা মানুষ, প্রথমবারেই এলাকায় একটা ঝড় তুলেছেন। বিষয়টা ইউসুফ চেয়ারম্যানকে জানান। ইউসুফ চেয়ারম্যান মহাখুশি! তার এলাকায় গণ্যমান্য অতিথিরা আসবেন তাও আবার প্রশাসন ও সরকারের কর্মর্কতারা, এ তো তার জন্য একটা মর্যাদার ব্যাপার।
ইনশাআল্লাহ, কোনো সমস্যা নাই স্যার। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলব।
ইউসুফ চেয়ারম্যান আশ্বস্ত করলেন সাজ্জাদ হোসেনকে।
সাজ্জাদ হোসেন ভাবছেন, ইউসুফ মিঞার তো এমপি হওয়ার কথা, চেয়ারম্যান হয়ে থেমে থাকলে কেমনে হবে। বলা যায় না সময় তো এখনো যায় নাই, কার কপাল কখন যে খোলে। আর একটা ফোন করে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের মাসুমকে।
মাসুম বলে, কোনো সমস্যা নাই স্যার। আমি কাল সকালেই আপনার অফিসে চলে আসব।
খাবার খেতে মাত্র বসেছে, ফোনটা আবারো বেজে ওঠে, দেখেন অপরিচিত নম্বর, রেখে আবার খেতে শুরু করেন। খাবার শেষে মোবাইলে একটা মেসেজ দেখতে পান। মেসেজটা পড়ে ফোন করেন, ওপাশ থেকে সালাম দিয়ে বলেন, স্যার আমি সানজিদা আক্তার, জেলা মহিলা পরিষদ থেকে বলছি। এডিসি (জেনারেল) স্যার আমাকে আপনার সঙ্গে কো-অর্ডিনেট করতে বলেছেন।
কয়েক মিনিট কথা বলে মনে হলো এমন একটা অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে সানজিদা বেশ এক্সাইটেড। ফোনটা সরিয়ে রেখে একটা চেয়ার টেনে জানালার কাছে বসেন সাজ্জাদ হোসেন। পানিবন্দি মানুষগুলোর কষ্ট তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। গত দুই সপ্তাহ এ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। এত পরিশ্রমের পর একটা প্রশান্তির বিষয় হলো বিপন্ন মানুষগুলোর জন্য কিছু করা হচ্ছে।
কিন্তু এ কোন উটকো ঝামেলা এসে হাজির। হাতে সময় মাত্র তিন দিন।
চাকরির শুরুতে এক জাঁদরেল সিনিয়রের কাছে শুনেছিলেন, প্রশাসনের চাকরির বেশিরভাগই অকাজ, এর মধ্যেই কিছু ভালো কাজ করতে হবে যা পরবর্তী জীবনে সুখস্মৃতি।
পরের দিন সকালে প্রথমে ইউএনওর সঙ্গে দেখা করেন সাজ্জাদ হোসেন। বিষয়টা সম্পর্কে বিস্তারিত নোট নেন। ‘আগামী চার দিন তোমার কাজ একটাই, অন্য সবগুলো বিষয় আমরা দেখব। বিষয়টা একটু সিরিয়াসলি নাও। স্থানীয় প্রসাসনের সাহায্য তুমি পাবে’, কথাগুলো একটানা বলে যান ইউএনও মহোদয়।
ইউএনও অফিস থেকে বেরিয়ে নিজের অফিসে ফিরতেই দেখেন ইউসুফ চেয়ারম্যান, মাসুদ তহশীলদার ও তিনজন মেম্বার হাজির। তাদের সঙ্গে ছোট একটা মিটিং সেরে ফেলেন। মিটিংয়ের পর বিষয়টা সম্পর্কে তার ধারণা একটু পাল্টে যায়, বুঝতে পারেন আরও লোকবল ও টাকা-পয়সার ব্যাপার। কিন্তু তার কাজের অভিজ্ঞতা বেশি নেই।
ইউএনওকে আবার ফোন করেন সাজ্জাদ হোসেন। ইউএনও বলেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, কয়েকজন কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসনকে আমি বলে দিচ্ছি। খরচটা তোমাকে ম্যানেজ করতে হবে। চেয়ারম্যানরা আছে, তোমার এত চিন্তা করতে হবে না। আমি ডিসি স্যারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। তুমি আমাকে নিয়মিত আপডেট জানাবে।
এই ‘ম্যানেজটা’ এখনো সাজ্জাদ হোসেনের ঠিকঠাক বোঝা হয়নি। কিছু বিষয়ে একটা ধারণা দিয়ে অন্যদের বিদায় করেন আর ফোনে সব সময় রেডি থাকতে বলেন। একটু অবাক হলেন এই ভেবে, এদের প্রত্যেকের ধারণা ও উৎসাহ তার চেয়ে অনেক বেশি।
এ পর্যন্ত সাজ্জাদ হোসেন এটুকুই বুঝলেন জেলা লেডিস ক্লাব, মহিলা পরিষদ ও প্রশাসনের কয়েকজন গণ্যমান্য ভাবি বন্যা দুর্গতদের ত্রাণ দিতে আসবেন বরইতলা ইউনিয়নে। তাকে এ বিষয়টা একটু কো-অর্ডিনেট করতে হবে। সাজ্জাদ হোসেনের মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে, আচ্ছা বন্যা তো জেলার বড় একটা অংশ জুড়ে, জেলা সদরের কাছেও অনেক বন্যা কবলিত মানুষ আছে, তাহলে ওনারা এই অঞ্চলে আসবেন কেন?
চিন্তাটা মাথায় পোক্ত হওয়ার আগেই সানজিদা ফোন করে, ‘স্যার ডিসি ভাবি এইমাত্র ফোন করে জানালেন প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের স্ত্রীও নাকি আসবেন। তার অনেক দিন নিজের শ্বশুরবাড়ি এলাকায় বন্যা দেখা হয়নি।’ আরও কয়েকটা জরুরি কথা তড়িঘড়ি করে সেরে ফেলে। তখন পর্যন্ত সাজ্জাদ হোসেন বিষয়টির বিস্তার আর করতে পারেননি।
যা-ই ঘটুক না কেন সাজ্জাদ হোসেন সবসময় স্থির থাকার চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে সামষ্টিক অপচয় দেখে তার কষ্ট লাগে, আবার নিজের বিবেচনায় স্বাভাবিক কার্যক্রম এগিয়ে নেয়। দুপুরবেলা ইউএনওর ফোন পেয়ে বুঝতে পারেন বিষয়টা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিকতার দিকে গড়াচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগেই দুপুর গড়িয়ে যায়। সামনে সময় আর মাত্র দুই দিন। এ দুদিনে এখনো অনেক কাজ বাকি।
দুপুর গড়িয়ে যে বিকেল আসে, সে বিকেলে সাজ্জাদ হোসেনকে একটা ধারণা দেয় মন্ত্রীর স্ত্রীসহ ৫/৭ জন গণ্যমান্য ভাবি আসবেন বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ দেওয়ার জন্য, সঙ্গে হয়তো আরও কয়েকজন থাকবেন। তাদের জন্য একটু চা-নাশতার ব্যবস্থা করা ও স্থানীয় কিছু বন্যাদুর্গত মানুষকে কলেজ মাঠে এনে হাজির করা। এ কাজটাই সুন্দরভাবে কো-অর্ডিনেট করা। মন্ত্রীর স্ত্রী থাকায় একটু বাড়তি খাতির যে প্রয়োজন তাও সাজ্জাদ হোসেনের মাথায় আছে। এই দুর্যোগের জালে এটুকু প্রত্যাশা মেনে নিয়েই এগোচ্ছিল ত্রাণ কার্যক্রমের অতিরিক্ত ব্যস্ততা।
সময় গড়াতে থাকে, সঙ্গে মানুষের প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষা নিয়ে সাজ্জাদ হোসেনের ধারণা আস্তে উবে যেতে থাকে। অভিজ্ঞতার ঝুলি এখনো যে অনেকটাই শূন্য তা বুঝতে আরও তিন দিন অপেক্ষা করতে হয় তাকে। সময় গড়াচ্ছিল আর ফরমায়েশের ফর্দটা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছিল। সানজিদা ফোন করে সাজ্জাদ হোসেনকে যে তথ্য দিল তাতে ত্রাণ কর্মসূচি অনেকটাই ভ্রমণ সূচিতে পরিণত হলো।
দুপুরে অতিথিরা পৌঁছবেন জেলা সদরে এবং সার্কিট হাউসে তারা লাঞ্চ সারবেন। সেখানেই বিশ্রাম নেবেন। বিশ্রামের পর জেলা চেম্বার অব কমার্সের পক্ষ থেকে তাদের একটা সংবর্ধনা দেয়া হবে। সোনালি রঙের ক্রেস্ট রেডি। এরপর লেডিস ক্লাব ও জেলা মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে প্রীতিভোজে অংশগ্রহণ করবেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব আয়োজন করা শেষ। জেলা কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে একটা উৎসবের মেজাজ বইছে। দু-একজন কর্মকর্তা বন্যার মধ্যে এসব আয়োজনে একটু নাখোশ হলেও এগুলো ম্যানেজ করে চলাই তাদের প্রধান কর্তব্য।
সাজ্জাদ হোসেন বরইতলার ত্রাণ কার্যক্রমের অস্বাভাবিকতাটুকুও মেনে এগোচ্ছিলাম এ কদিন। কিন্তু গত ছ’ঘণ্টার নতুন নতুন নির্দেশনায় মনে হচ্ছে অস্বাভাবিকতার মাত্রাটাও শোভনীয়তা হারিয়েছে। প্রায় ৫০ জন মানুষের দুপুরের খাবারের আয়োজন করতে হবে। নদীর রুই মাছের সঙ্গে দেশি মুরগির রোস্ট, বিলের কৈ মাছ হলে ভালো হয়। বলাইচাঁদের কাঁচাগোল্লাসহ মোট ১০/১২টা আইটেমের আয়োজনের একটা বার্তা আসে। বিষয়টা ঠিকভাবে হজম করতে না পেরে সাজ্জাদ হোসেন ফোনটা ধরিয়ে দেন মাঝে দাঁড়ানো ইউসুফ চেয়ারম্যানকে। ইউসুফ চেয়ারম্যান যে আরও দু-একটা আইটেম বাড়িয়ে ফেলবেন এটা নিশ্চিত সাজ্জাদ হোসেন।
‘ইনশাআল্লাহ্ সবকিছু ঠিকঠাক হবে, কোনো সমস্যা নেই। আপনাদের খেদমত করার সুযোগ তো সবসময় পাওয়া যায় না। আপনারা সহি-সালামতে আসেন।’ বলে ফোনটা কেটে সাজ্জাদ হোসেনের হাতে দেন।
আগামীকাল সন্ধ্যার আয়োজনের কথা ভেবে সানজিদা পার্লারে গিয়ে একটু ফেসিয়াল আর চুলটা ওয়াশ করে একটু রং করায়। রং জেলা সদরেও একটু লেগেছে। পার্লারে গিয়ে দেখে আগামীকাল দুপুর আর বিকেলটা সিনিয়র ভাবিদের জন্য বুকিং করা। নবনী বিউটি পার্লার গণ্যমান্য মেহমানদের কথা ভেবে রাজধানী থেকে কয়েকটা লেটেস্ট আইটেম আনিয়েছে। সানজিদার একটা আত্মবিশ্বাস আছে, সে এখানে সবার চেয়ে ছোট আর শরীরের কাঠামোটা এখনো বেশ সুন্দর আছে, রং-ঢং-এ খুব বেশি ঢাকার প্রয়োজন হয় না, তবুও একটু প্রস্তুত থাকা ভালো। শুনেছে কয়েকটা টিভি চ্যানেল আসবে।
জেলা সদরের ত্রাণ উৎসবের আমেজে বন্যাক্রান্ত মানুষগুলো যখন অনেকটা দিশেহারা ঠিক তখন এই মুহূর্তগুলোকে আরও একটু রাঙাতে এক ক্ষমতাসীন ভাবি বললেন, ‘মন্ত্রী ভাবি এখানে এসেছেন যদি নল বুনিয়ার ইকো রিসোর্টটা না দেখে যায় তা হলে এটা কেমন দেখায়। তাদেরই এক ব্যবসায়ী ভাবি যিনি আবার রাজনীতিও করেন, খাস জমিতে যতœ করে এটা বানিয়েছে। ভাবি অনেক শৌখিন, দুই বছর অনেক যতœ করে এটা তৈরি করেছেন। গেলে ভালো লাগবে, দারুণ মজা হবে।’
প্রীতিভোজের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হয় কাল সকালে প্রথমে এখান থেকে যাবে ইকো রিসোর্টে। ওখানে গিয়ে এক এক ভাবি এক একটা পছন্দের ডিশ বানাবে। কয়েকজন ভাবি ইতিমধ্যে সানজিদার কাছে বেশ কয়েক পদের আইটেম বলেছেন এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের এক একটা লম্বা তালিকা ধরিয়ে দিয়েছেন। এখন সবাই মন্ত্রী ভাবির ডিশটার নাম শোনার অপেক্ষায়। তিনিও বেশ চিন্তিত, অবশেষে সবাইকে চমক দিয়ে ঘোষণা দিলেন, তিনি কিছুদিন আগে ইউটিউবে দেখে অনেক পরিশ্রম করে একটা আইটেম শিখেছেন-ড্রাই স্যুপ। সবাই ওয়াও ওয়াও বলতে শুরু করল। এটা নিশ্চয়ই খুব স্পেশাল হবে।
জেলা প্রশাসনের সর্বকনিষ্ঠ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জান্নাতুল ফেরদাউস, সানজিদা আখতার ও মুনসেফ নাজির নেমে পড়ে সব আয়োজনের কেনাকাটার জন্য। ড্রাই স্যুপের উপকরণগুলো একটু বিশেষ মনোযোগ দিয়ে লিখে নেয়। সবার মনোযোগ আপাতত ড্রাই স্যুপে।
নিউ ভ্যালি কোম্পানির ২০০ প্যাকেট ত্রাণ পাঠানোর কথা। পাঠাতে একটু দেরি হচ্ছে, কারণ বিশিষ্ট আর্টিস্ট আমিরুল আবেদীনের প্যাকেটের লোগো ডিজাইন করার কথা, কিন্তু তার নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে কাল সকালে জেলা সদরে পৌঁছে যাবেন। কয়েকজন সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও টিমের কয়েকজন সদস্য ও ব্যানার আগেই পৌঁছে যায় উপজেলা সদরে। তারা গিয়ে দেখা করেছেন সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে।
ভাবিদের মধ্যে একজন ফোক গানের বেশ সমঝদার, এ অঞ্চলে লোকগানের বেশ সুনাম। একটু না শুনে গেলে কেমন হয়। একটা গায়ক দলকে হাজির করার একটা নির্দেশ আসে। ফোনটা কেটে সাজ্জাদ হোসেন একটা অট্টহাসি হাসেন। ফোনটা আবার বেজে ওঠে, আচ্ছা বন্যাদুর্গতদের দুর্দশা নিয়ে একটা গান রচনা করলে কেমন হয়। একটা ভিডিও শুট করা যাবে। ভিউ নিশ্চয়ই অনেক হবে।
সাঁওজাল বয়াতি আর তার দলকে খবর দেয়া হয়। সারা রাত অনেক খেটে কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল আমিনুর রহমান হৃদয় নিংড়ানো দরদ দিয়ে একটা গান লেখেন। তার বিশ্বাস অতিথিরা আসার আগেই বয়াতি সুর তুলে ফেলবেন। আমিনুর রহমান শিক্ষকতার বাইরেও একজন কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। মন্ত্রীকে নিয়েও তার অনেক কবিতা আছে। ভাবছেন কালকের বিষয়টা নিয়েও একটা কবিতা লিখবেন।
সাজ্জাদ হোসেন থানা সদরে আজ সারাদিন তার কাজের সঠিক প্রস্তুতি নেন আর ইউসুফ চেয়ারম্যান ও তার টিম বরইতলা ইউনিয়নের ত্রাণ উৎসবের প্রস্তুতি সারেন। পরের দিন সকালবেলা সাজ্জাদ হোসেন তার সহযোগীদের নিয়ে বরইতলা রওনা হন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যান বরইতলা হাজী আকবর আলী কলেজ মাঠে। দুদিনের প্রস্তুতিতেই ইউসুফ চেয়ারম্যান এলাহিকা- ঘটিয়েছেন। তার টিমের সদস্যরা, মেম্বার, দফাদার, চৌকিদার সবাই ব্যস্ত যার যার কাজ নিয়ে। সবাই এসে তাদের কাজের একটা আপডেট জানিয়ে যায় সাজ্জাদ হোসেনকে।
ওদিকে জেলা সদর থেকে সকালের ভারী নাশতা সেরে সব গণ্যমান্য ভাবিকে নিয়ে বাহারি ফুল দিয়ে সাজানো একটা লঞ্চ রওনা দেয় গ্রিন ইকো রিসোর্টে। ওখানে পৌঁছতে ঘণ্টা দুই লাগবে। রঙিন শামিয়ানা দিয়ে সুন্দরভাবে ঢেকে দেয়া হয়েছে যাতে রোদে ভাবিদের মেকাপ নষ্ট না হয়ে যায়। এই যাত্রায় কেউ যাতে বোরিং ফিল না করে সেজন্য সব আয়োজন রাখা হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। নানান আয়োজন চলতে থাকে, কিন্তু মন্ত্রী ভাবির মন পড়ে আছে ড্রাই স্যুপে। এটা স্পেশাল হওয়া চাই। ২৭টা উপকরণের মধ্যে দুটি উপকরণ পাওয়া যায়নি, এ নিয়ে তিনি কিছুটা উদ্বিগ্ন।
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সাজ্জাদ হোসেনকে বলতে ভুলে গেছে সানজিদা। সানজিদাও ড্রাই স্যুপের মধ্যেই বুঁদ হয়ে আছে। সানজিদা জানায়, স্যার মন্ত্রী মহোদয়ের মেয়েও এসেছেন। তিনি বিদেশে গবেষণা করেন। এদিকে তো তার আর আসা হবে না। তাই যদি নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন বিষয়ক কোনো প্রজেক্টের একটা ফিল্ড ভিজিট এ ফাঁকে করতে পারেন তার জন্য সেটা বেশ ভালো হবে। বরইতলায় যেন এ রকমের একটা প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা করা হয়। কথাটি শোনার পর সাজ্জাদ হোসেন তাকান ভাইস প্রিন্সিপাল আমিনুর রহমানের দিকে। তিনি এই বন্যায় ডোবা এলাকায় সাদা কোট-টাই পরে হাঁটছেন, পা খালি ও ভেজা। তার দিকে তাকাতেই বললেন, স্যু ওখানে রাখা আছে, অতিথিরা আসার আগেই পরব।
প্রজেক্টের বিষয়টা ইউসুফ চেয়ারম্যানকে জানান সাজ্জাদ হোসেন। পাশেই দাঁড়ানো ছিল স্কুল শাখার প্রধান শিক্ষিকা কমলা রানী সাহা। তিনি বললেন, মাইল দুই দূরেই একটা প্রজেক্ট আছে নারী শক্তি, কিন্তু এখন তো সব বন্যায় ডুবে আছে। পাশে দাঁড়ানো নুর মেম্বার বলেন, সমস্যা নাই স্যার, একটা ট্রলার রেডি রাখি, ট্রলারে করে তাদের ওখানে নিয়ে যাওয়া যাবে। অফিসের সাইনবোর্ডটা এখনো ডোবে নাই।
বরইতলার এই কলেজ মাঠকে ঘিরে আশপাশের বাজার এলাকায় একটা উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে। মানুষ তার দুর্দশার কথা কত তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। কলেজের পশ্চিম দিকে শিক্ষকদের কক্ষের পাশে সমসের বাবুর্চির তত্ত্বাবধানে নলকুনিয়া বিলের রুইমাছ, কইমাছ আর নানান পদের রান্না শুরু হয়েছে। আর একপাশে বাচ্চা-কাচ্চা, নারীসহ মোট ৫৬ জনকে এনে খালি মাঠের একটু উঁচু অংশে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছে। জয়নুল চৌকিদার হাঁকডাক দিয়ে লাইনটা সোজা রাখার চেষ্টা করছে। মাঝখানে একদল গায়ক তাদের বাদ্যযন্ত্রের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এলাকার মূল গায়েন সুশীল বাবু আসেননি। তিনি নাকি বলেছেন, মানুষ মরতাছে বানের তলে, এর মধ্যে আবার গান-বাজনা কী!
সাজ্জাদ হোসেন একটা কাঠের চেয়ারে কলেজের বারান্দায় বসে আছেন। বাদ্যযন্ত্রের টুং-টাং ধ্বনিটা এসে তার কানে লাগে। একটু দূরেই প্রধান শিক্ষিকা আর একজন অশীতিপর বৃদ্ধ চুপচাপ বসে আছেন। সবাই তাকে বেশ সম্মান করে। প্রধান শিক্ষিকা বললেন, ইনি আমাদের আমজাদ স্যার, এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী মানুষ। সাজ্জাদ হোসেন তার চেয়ারটা একটু টেনে তার কাছে গিয়ে বসেন। আস্তে সালাম দেন। তিনি তার মাথাটা একটু উঠিয়ে উত্তর দেন।
সাজ্জাদ হোসেন জিজ্ঞেস করেন, কেমন আছেন?
তিনি অনেকটা চুপচাপ, কিছু বলেন না। একটু পর চোখ বন্ধ করেই বলেন, সময় পাল্টাইয়া গেল, মানুষের বিবেক-বুদ্ধি একটুও বাড়ল না। এই ঘোর বিপদের মধ্যে এই সব তামাশা। মানুষজন কি আর সাবালক হইবে না?
সূর্য চলতে চলতে মাথার উপর ওঠে। খোলা মাঠে মানুষগুলোর চামড়া পুড়তে থাকে। অনেকেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। জয়নুল চৌকিদারের আরও দু-একটি ধমক শোনা যায়। নুর মেম্বার তড়িঘড়ি করে আসেন আর বলেন, হারামজাদাগো একটু ধৈর্য নাই। পয়সা খরচ কইরা কয়হেগো ত্রাণ লাগব না, বাড়ি যাইব। কত কষ্ট কইরা নায়ে, ট্রলারে পয়সা খরচ কইরা আনছি কি চইলা যাওয়ার জন্যে?
সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ওদের জন্য কিছু শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করেন, ছোট বাচ্চারা আছে তো। অনেক অপেক্ষার পর আমজাদ কাজী নড়েচড়ে বসেন। বলেনশোনেন, বন্যা তো এই অঞ্চলে আছেই। কিন্তু গত কয়েক বছরে নানান এলোপাতাড়ি উদ্যোগে সবাই মিলে প্রকৃতির উপর যে অবিচার করেছি, তার ভোগান্তি পোহানো লাগবে আরও বহুদিন। প্রকৃতি ক্ষমা করবে না। এর সঙ্গে তাল মিলিয়েই হাঁটতে হয়, পূর্বপুরুষরাও তাই করছেন, বিবাদে জড়াইতে নাই।
রোদের তেজটা বেড়ে যাওয়ায় চেয়ারটা একটু টেনে শ্রেণি কক্ষের মধ্যে বসেন সাজ্জাদ হোসেন। তার চোখ যায়, মঞ্চের মতো বানানো অংশের লম্বা ব্যানার দুটিতে; একটি প্রশাসনের, অন্যটি নিউ ভ্যালি কোম্পানির। তাদের টিমের ক্যামেরাম্যান ও সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোবাইলে ব্যস্ত যার যার মতো করে।
সময় অনেক গড়িয়েছে, একটা উদ্বেগ বাড়তে থাকে তার মাথায়। ত্রাণের প্যাকেট এখনো এসে পৌঁছেনি। জেলা সদর থেকে খুব সকালে রওনা দেওয়ার কথা। সাজ্জাদ হোসেন ফোন করেন সানজিদাকে। রিং বাজছে কিন্তু ধরছে না। পরে ফোন করেন ইউএনওকে-তার ফোন ব্যস্ত। উদ্বেগ থেকে একটা তন্দ্রার মতো তৈরি হয়ে সাজ্জাদ হোসেনকে গ্রাস করে। সবার মধ্যে একটা ঝিমুনি ভাব আসে। পোলাওয়ের গন্ধটাও এসে নাকে লাগে, তন্দ্রা চলে যায়। বাতাস যেহেতু সাম্যবাদী, গন্ধটা নিয়ে যায় ত্রাণের জন্য অপেক্ষারত মানুষগুলোর নাকেও। কিন্তু গন্ধও তাদের আটকাতে পারে না, নুর মেম্বার হাঁপাতে হাঁপাতে আবার আসে-হারামজাদারা পালাইছে অনেকজন। এখন ২৭ জন আছে। হেগো কইছি দুই প্যাকেট করে দেওয়া হইবে।
সাজ্জাদ হোসেন আবার ফোন করেন সানজিদাকে। আনন্দের হট্টগোলের মধ্যে বলে, স্যার এখানে সব ভাবির রান্না চূড়ান্ত পর্যায় চলছে। সবাই ব্যস্ত। মন্ত্রী ভাবির ড্রাই স্যুপ তো অস্থির হচ্ছে। তিনি খুবই এক্সাইটেড।
সাজ্জাদ হোসেন হট্টগোলোর মধ্যেই আবার বলেন, ত্রাণের ট্রলার এখনো এসে পৌঁছেনি। একটু জানার চেষ্টা করেন। সানজিদা কিছু শুনতে পাচ্ছে না, সে ড্রাই স্যুপের কথা বলেই যাচ্ছে।
সাজ্জাদ হোসেন নুর মেম্বারকে জিজ্ঞেস করেন, চেয়ারম্যান সাহেব কোথায়?
নামাজ পড়তে গেছে স্যার।
একটা অস্থিরতা জমা হয় তার মনে, পোলাওয়ের গন্ধের মতো তা কিছুটা ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। মাঠের পানি আরও একটু বেড়েছে। সূর্যটা হেলে গেছে পশ্চিমে।
সানজিদাকে আবার ফোন করেন সাজ্জাদ হোসেন।
ওপাশ থেকে সানজিদা বলে, মন্ত্রী ভাবির ড্রাই স্যুপটা অসাধারণ হইছে। সবাই প্রশংসা করছে। আপনি থাকলেও এনজয় করতেন স্যার। এখন তারা সবাই রেস্ট নিচ্ছেন। বিশ্রাম শেষ হলেই আমি আপনাকে ফোন করব। সাজ্জাদ হোসেন ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন, একটা চিৎকার করেন। চিৎকার শোনার আগেই ফোনটা কেটে দেয় সানজিদা। তার চিৎকার আমজাদ কাজীর ঝিমুনিটা কাটে, প্রধান শিক্ষিকাও একটু নড়েচড়ে বসেন ও নিজের শাড়িটা একটু ঠিকঠাক করেন।
একটু দুরে চুপচাপ বসে থাকা আমজাদ কাজী ভারী গলায় বলেন, ধৈর্য হারালে কেমনে চলবে সাজ্জাদ সাহেব, জীবন তো মাত্র শুরু করেছেন, এখনো অনেক পথ বাকি।
ভাইস প্রিন্সিপাল আমিনুর রহমান এসে বলেন, গানের সুরটা বয়াতি বেশ তুলেছে, সুরে একটা বন্যার দুঃখ আছে। সাজ্জাদ হোসেন তার দিকে তাকান এবার তার পায়ে কালি করা চক্চকে স্যু।
ইউসুফ চেয়ারম্যানও হাজির।
স্যার, খাবার রেডি, তারা আসলেই পরিবেশন করা হবে। রুই মাছটা দারুণ হইছে। এমন রুই সচার-আচার পাওয়া যায় না। মেহমানদের ভাগ্য ভালো।
গরম পোলাও ঠাণ্ডা হয়ে তার গন্ধটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, ত্রাণ প্রার্থীদের অনেকেই ধৈর্য হারিয়ে কয়েকটা তাজা গালি দিয়ে চলে গেল। প্রধান শিক্ষিকা মনে মনে ভাবছেন বোধ হয় পাশের গ্রামে যাওয়া লাগবে না।
এমনি সময়ে সানজিদা ফোন করে চাপা গলায় বলল, স্যার ম্যাডামরা আজ আর ত্রাণ দিতে যাবেন না। ড্রাই স্যুপ খাওয়ার পর সবার পাতলা পায়খানা শুরু হয়েছে। কিছু ওরস্যালাইন পাঠাতে পারবেন?
ফোনটা কেটে দেয়ার পর সাজ্জাদ হোসেনের মনটা একটু উদাস হয়ে ওঠে। তাকিয়ে থাকেন মাঠের পশ্চিম পাশে টাঙানো ব্যানারের দিকে, খেয়াল করেন একটা বানান ভুল। দু-একজন শিল্পী তাদের বাদ্যযন্ত্রে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে।
পাশেই দাঁড়ানো ইউসুফ চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করে, স্যার কোনো সমস্যা?
সাজ্জাদ হোসেন ফ্যাকাসে কণ্ঠে বলেন, তারা আসবেন না।
কোনো সমস্যা নাই স্যার, তাদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।
ক্যামেরাম্যান এসে বলে, ত্রাণের ট্রলার ভুলে কড়াইতলা চলে গেছে। বরইতলা বুঝতে পারেনি।
সমস্যা নাই, আমি সব ছবি তুলে নিয়েছি। এরপর ফটোশপের মাধ্যমে ম্যাডামকে একটা দারুণ ছবি তৈরি করে দেব। তিনি সেটা ফেসবুকে দিতে পারবেন।
জয়নুল চৌকিদার দূরে মাঠের পশ্চিম দিকটায় দাঁড়িয়ে বিড়িতে কয়েকটা লম্বা টান দিয়ে বিড়িটা ফেলে দৌড়ে আসে সাজ্জাদ হোসেনের কাছে। স্যার হারামজাদারা এত বদমাইশ, হগলডি গেছে। আমি তিনটারে এহনো বাইন্দা কোনো রহম রাখছি।
নুর মেম্বার বলে, যাও চৌকিদার, মেহমান আইবো না।
সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ওদেরকে ছেড়ে দেন।
মাঠের ওপরে ফুলে ওঠা বন্যার জলের দিকে তাকিয়ে জয়নুল চৌকিদার আস্তে আস্তে বলে, সমস্যা নাই স্যার, বন্যা তো ফি বছর আছেই। হেরা আগামীবার আবার আইতে পারব। ক্লান্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে সাজ্জাদ হোসেন মনে মনে ভাবছেন, কিন্তু তার মেয়ে তো আর আসবেন না।