ডিজিটাল আইনের ‘শুদ্ধ প্রয়োগ’ নিশ্চিত হবে কীভাবে

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৪২ পিএম

আমীন আল রশীদ। ছবি: সংগৃহীত

আমীন আল রশীদ। ছবি: সংগৃহীত

পরপর কয়েকটি ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার আগে থেকেই বিতর্কিত ও সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। প্রশ্ন উঠেছে এর প্রয়োগ ও অপব্যবহার নিয়ে।

বিশেষ করে নওগাঁয় র‌্যাবের নিরাপত্তা হেফাজতে সুলতানা জেসমিন নামে এক নারীর মৃত্যুর পর তার বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা দায়েরের মধ্য দিয়ে বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি সমালোচনা শুরু হয়। স্বয়ং আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও স্বীকার করেছেন যে, নওগাঁয় সুলতানা জেসমিনকে যখন তুলে নেওয়া হয় তখন তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা ছিল না। মামলা করা হয়েছে তার পরের দিন। (ডেইলি স্টার অনলাইন, ৩০ মার্চ ২০২৩)। 

আইনমন্ত্রী বলেছেন, সুলতানা জেসমিনকে আটকের ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এটি যদি আইনের ‘অপব্যবহার’ হয়, তাহলে ‘ব্যবহার’টা কী? এ পর্যন্ত এই আইনে যতগুলো মামলা হয়েছে, তার কয়টির সঠিক ব্যবহার হয়েছে? 

এই ঘটনার কয়েক দিন পরই সমকালকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ শুদ্ধভাবে করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমি ২০২০ সাল থেকে বলে আসছি এবং বুঝতে পেরেছি, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের কিছু মামলা প্রয়োগে অপব্যবহার হচ্ছে। এই মিসইউজ এবং অ্যাবিউজ বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের অফিসে আমি দুইবার আলাপ করেছি। সারা পৃথিবীতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে হয়তো আইন নেই, কিন্তু এ ধরনের আইন আছে। সারা পৃথিবীতে বেস্ট প্র্যাকটিস আমরা গ্রহণ করতে পারি কিনা, সেটা পর্যালোচনার জন্য আলাপ-আলোচনা করছি।’ (সমকাল, ২ এপ্রিল ২০২৩)।

একই দিন ঢাকা চেম্বারে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের সুযোগ নেই। তবে নাগরিক সমাজের দাবির মুখে আইনটির কিছু ধারায় পরিবর্তন আনা হবে। (সাম্প্রতিক দেশকাল অনলাইন, ২ এপ্রিল ২০২৩)। 

সম্ভবত এটিই দেশের একমাত্র আইন যেটি সংসদে পাস হওয়ার আগে থেকেই জনপরিসর ও গণমাধ্যমে সমালোচনা হচ্ছে। মূলত ২০১৭ সালের নভেম্বরে আইনটি খসড়া চ‚ড়ান্ত হওয়ার পরই এই আলোচনার সূত্রপাত। সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, নাগরিক সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনও আইনের অন্তত ৯টি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল। এই দাবিতে মানববন্ধন এবং সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকও কাজে আসেনি। বরং ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়। 

২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত ৪২৬টি মামলা বিশ্লেষণ করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) বলছে, এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৯১৩ জনকে। তাদের মধ্যে ১১ শতাংশের বেশি রাজনীতিবিদ এবং ১০ শতাংশের বেশি সাংবাদিক। এসব মামলায় আটক হয়েছেন ২৭৩ জন, যাদের প্রায় ১৩ শতাংশ হচ্ছেন সাংবাদিক। 

সবশেষ দেশের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং সাভারে কর্মরত পত্রিকাটির নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়। কাছাকাছি সময়ে আরেকটি জাতীয় দৈনিক যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার মাহবুবুল আলম লাবলুসহ আরও একাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এটি এখন আর ডিজিটাল নিরাপত্তা নয়, বরং গণমাধ্যমকর্মী নিয়ন্ত্রণ আইনে পরিণত হয়েছে। অথচ এই আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন। প্রশ্ন হলো, একজন সাংবাদিকের রিপোর্ট কী করে ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের মধ্যে পড়ে এবং এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে কী করে এই আইনে মামলা হয়? 

এরকম বাস্তবতায় আইনমন্ত্রী বলছেন, আইনটি শুদ্ধ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে। এই আইনে যেসব ধারা এবং আইন প্রয়োগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা ও মানহানির মতো বিষয়গুলোর ব্যাপারে সুস্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকা তথা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে রেখে আইনের শুদ্ধ প্রয়োগ আদৌ সম্ভব কি? মন্ত্রী বলছেন, প্রয়োজনে আইনে সংশোধন আনা হবে। কোথায় সংশোধন আনা হবে? ডিজিটাল অপরাধ এবং মানহানির সংজ্ঞায় কি পরিবর্তন আনা হবে? 

সরকারের তরফে বারবার বলা হয়েছে যে এই আইনে যাতে পেশাদার সাংবাদিকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সরকার সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকবে। কিন্তু তা হয়নি। পক্ষান্তরে এ প্রশ্নও উত্থাপনের সুযোগ রয়েছে যে, কোনো একটি আইনে আলাদাভাবে সাংবাদিকরা বিশেষ সুবিধা কেন পাবেন? আইনটি যদি জনবান্ধব হয়, যদি আইনটি সংবিধানপ্রদত্ত কোনো বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, তাহলে তো আলাদা করে সাংবাদিকের বিশেষ সুবিধার প্রয়োজন হয় না। বরং এই আইন নিয়ে প্রধান যে সমালোচনা তা হলো, এই আইনের অপপ্রয়োগ বলে কিছু নেই। বরং এর প্রয়োগটাই অপপ্রয়োগ। 

তাহলে কি এই আইনটি বাতিল করা উচিত?

সম্প্রতি এই আইনের প্রয়োগ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, গণতন্ত্রের জন্য গণমাধ্যমকর্মীসহ সবার বাক স্বাধীনতার বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, বিশেষ করে বাংলাদেশে নির্বাচনের বছরে। (প্রথম আলো, ৩১ মার্চ ২০২৩)। অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ অবিলম্বে স্থগিত করতে বাংলাদেশকে আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক। (দেশ রূপান্তর, ১ এপ্রিল ২০২৩)। 

কিন্তু যে প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই তা হলো, কোনো আইন না থাকলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে কীভাবে? কেননা এ পর্যন্ত এই আইনে যতগুলো মামলা হয়েছে তার মধ্যে অধিকাংশই হয়েছে সমাজের ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের কথিত সম্মানহানির অভিযোগে। 

সম্প্রতি মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মার্চে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে ১০টি মামলার মধ্যে ৭টি হয়েছে সমালোচনামূলক পোস্ট, শেয়ার এবং কমেন্টের মাধ্যমে দেশ ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে। (ডেইলি স্টার অনলাইন, ১ এপ্রিল ২০২৩)।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই আইনটি করা হয়েছে মূলত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের জীবিত ও মৃত নেতা, এমপি, মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের বক্তব্য, রসিকতা, ব্যঙ্গ, কার্টুন, ছবি ইত্যাদি ঠেকানোর জন্য। 

কিছুদিন পরপরই নানা ঘটনায় যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো, এই আইনের উদ্দেশ্য কি সংবাদমাধ্যমকে চাপে রাখা? একসময় দেশের সংবাদপত্রসমূহে রাজনৈতিক কার্টুন বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু এই আইন পাস হওয়ার পর গণমাধ্যম থেকে ব্যঙ্গ কার্টুন বলতে গেলে উধাও হয়ে গেছে। দেশের একজন প্রভাবশালী ব্যাংক মালিকের কার্টুন এঁকে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর এখন দেশান্তরী কার্টুনিস্ট কিশোর।

এই আইন হওয়ার পর থেকে যে ভয়াবহ প্রবণতাটি গণমাধ্যমকে সবচেয়ে বেশি চাপে ফেলেছে তা হলো, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা। কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট ছাপা হলেও সেটি ডিজিটাল মাধ্যমে তার মানহানি করেছে, এমন অভিযোগে মামলা দায়েরের ঘটনা ভূরি ভূরি। শুধু মামলা দায়ের নয়, বরং মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, এমনকি মামলা হওয়ার আগেই সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারকে ধরে নিয়ে জেলে ঢুকানোর নজির আছে। আর এসব ঘটনার কারণে সংবাদমাধ্যমগুলো সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করতে বাধ্য হয়। 

সব মিলিয়ে এই একটি আইন দেশের পুরো গণমাধ্যমকে যেরকম চাপে রেখেছে বা রাখছে, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য এরকম আইন আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। সুতরাং আইনের শুদ্ধ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে আগে ঠিক করতে হবে যে, রাষ্ট্র এই আইন দিয়ে আসলে কী করতে চায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh