দেড় বছর ধরে গ্যারেজবন্দী ৪৫ লাখ টাকা মূল্যের অ্যাম্বুলেন্স

এস.এস শোহান, বাগেরহাট

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৩, ০২:৪৯ পিএম

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স। ছবি: বাগেরহাট প্রতিনিধি

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স। ছবি: বাগেরহাট প্রতিনিধি

বাগেরহাটের মোল্লাহাটে দেড় বছর ধরে গ্যারেজবন্দী রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স। চালক না থাকায় এই সময়ে একদিনও চলেনি ৪৫ লাখ টাকা মূল্যের এই অ্যাম্বুলেন্সটি। এরই মধ্যে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় অ্যাম্বুলেন্সটির চারটি চাকা, মবিল চেম্বারসহ বিভিন্ন মূল্যবান ষড়ঞ্জাম চুরি হয়েছে। একটি মাত্র সরকারি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে গুরুত্বর রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। এই সুযোগে রোগীর স্বজনদের পকেট কাটছে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালকরা। দফায় দফায় চুরি হলেও, চোর শনাক্ত এবং মালামাল উদ্ধার করতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ ও পুলিশ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোসহ চুরির বিষয়ে জিডি করা হয়েছে দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে।

মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অনুকূলে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ঢাকা-১৬২/২ নম্বরের একটি অ্যাম্বুলেন্স বরাদ্দ হয়েছে বলে জানান হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডাইরেক্টর বরাবর চিঠি প্রদান করেন। পরবর্তীতে অ্যাম্বুলেন্সটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এনে গ্যারেজে রাখা হয়। চালক না থাকায় অ্যাম্বুলেন্সটি জরাজীর্ণ গ্যারেজ বন্ধী থাকতে থাকে। এরই মধ্যে ২০ জানুয়ারি অ্যাম্বুলেন্সের চারটি চাকা চুরি হয়েছে মর্মে মোল্লাহাট থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন ভারপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. রায়হান। তখন জানা যায়, গ্যারেজের সিক ভেঙ্গে এই চাকা চুরি হয়েছে। গ্যারেজবন্ধী থাকতে থাকে অ্যাম্বুলেন্সটি। এর এক বছর পরে এবছরের ৫ ফেব্রুয়ারি অ্যাম্বুলেন্সের পাশের গ্লাস ভাঙ্গা, অ্যাম্বুলেন্সের অক্সিজেন সিলিন্ডার, ফায়ার বক্স সিলিন্ডার, ১২ ভোল্টের একটি ব্যাটারি, মবিল চেম্বারের ঢাকনা চুরি হয়েছে মর্মে সাধারণ ডায়েরি করেন উপজেলা স্বাস্থ্য কম্পেলেক্সের মেডিকেল অফিসার মো. নাহিদুল ইসলাম। তবে ওই সাধারণ ডায়েরিতে বলা হয় এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপাতত মামলা করতে ইচ্ছুক না। এই অবস্থায় আসলে কখনও কোনদিন এই অ্যাম্বুলেন্স চালু হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

এছাড়া এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সের জন্য নির্ধারিত কোন অ্যাম্বুলেন্স চালক নেই। আউটসোর্সিংয়ে নিয়োজিত দুইজন নৈশ্য প্রহরী থাকলেও, ১১ মাস বেতন না পাওয়ায় তারা দায়িত্ব পালন করেন না।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতাল ভবনের পিছনে জরাজীর্ণ একটি গ্যারেজের মধ্যে নতুন অ্যাম্বুলেন্স রাখা আছে। গ্যারেজের ছাদের পলেস্তারা খুলে পড়ছে অ্যাম্বুলেন্সের উপর। বাম পাশের দরজার গ্লাস ভাঙ্গা। কোন চাকা নেই গাড়িতে। গাড়ির ভেতরে অক্সিজেন সিলিন্ডার, ফায়ার বক্স সিলিন্ডার, ১২ ভোল্টের একটি ব্যাটারি, মবিল চেম্বারের ঢাকনা নেই। মনে হয় মালিক ছাড়া কোন বেওয়ারিশ অ্যাম্বুলেন্স গ্যারেজের মধ্যে ফেলে রাখা, কোন প্রয়োজন নেই এই গাড়ির।

স্থানীয় নাদিম শেখ নামের এক ব্যক্তি বলেন, প্রতিনিয়তই এই হাসপাতাল থেকে অসুস্থ রোগীদের বাগেরহাট জেলা হাসপাতাল ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। রোগীর স্বজনরা বাধ্য হয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে যায়। গ্যারেজে থাকা অ্যাম্বুলেন্সটি সচল ও চালু অ্যাম্বুলেন্সের জন্য স্থায়ী চালক নিয়োগের মাধ্যমে রোগীদের সেবা প্রদানের দাবি জানান এই যুবক।

মো. তাওহীদ ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তি বলেন, একজন রোগী সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে খুলনা নিতে লাগে ১৪‘শ থেকে ১৬‘শ টাকা। বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে দিতে হয় ২৫‘শ থেকে ৩ হাজার টাকা। যেকোনো মূল্যে হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালু করা প্রয়োজন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, দেড় বছর বসে একটি অ্যাম্বুলেন্স চালু করতে পারল না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, এটা এক ধরণের অদক্ষতার পরিচয়। আর হাসপাতালের মধ্য থেকে মাঝে মাঝেই চুরি হয়, আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি মামলাও করতে পারে না। তারা কিসের ভয় পায় এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি।

এদিকে এই অ্যাম্বুলেন্সের চাকা ও অন্যান্য মালামাল চুরির পিছনে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালক ও ব্যবসায়ীদের হাত থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চত্বরে থাকা বেসরকারি আলিফ অ্যাম্বুলেন্সের চালক মেহেদী হাসান বলেন, সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সব সময় না পাওয়ায় আমরা রোগী বহন করি। এক সময় হাসপাতালের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স রাখতে নিষেধ করা হলেও, পরে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ম্যাডাম রাখতে বলেছেন।

মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোছা. মাহফুজা খাতুনের গাড়ি চালক ওবায়দুর রহমান লিটন বলেন, খুব জরুরি রোগী হলে আমি অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাই। সব সময় যেতে পারি না। তখন রোগীদের বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে নিতে হয়।

মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোছা. মাহফুজা খাতুন বলেন, আমি যোগদানের পূর্বেই অ্যাম্বুলেন্সটির চাকা চুরি হয়, পরে আবারও কিছু মালামাল চুরি হয়। আমরা মোল্লাহাট থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি। গ্যারেজটা খুবই নরবরে এবং চাকা না থাকায় অ্যাম্বুলেন্সও সরানো যাচ্ছে না। এছাড়া আমাদের অ্যাম্বুলেন্স চালক ও নৈশ প্রহরী নেই। এসব বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

চুরির বিষয়ে বাগেরহাট জেলা পুলিশের মিডিয়া সেলের প্রধান সমন্বয়কারী এসএম আশরাফুল আলম বলেন, মালামাল চুরি হওয়া বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে।

বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. মো. জালাল উদ্দিন বলেন, লোকবল সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। আশাকরি দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে। 

মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন ২ থেকে ৩‘শ রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh