তরমুজের লাভ মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৩, ০২:০৮ পিএম

তরমুজের দাম এলাকাভেদে ১০ গুণও বেড়ে যায়। ছবি: সংগৃহীত

তরমুজের দাম এলাকাভেদে ১০ গুণও বেড়ে যায়। ছবি: সংগৃহীত

রোজার দিনে শরীরে পানির চাহিদা পূরণে ইফতারে তরমুজ অনেকেরই পছন্দ। ফলন ভালো হওয়ায় এবার বাজারে এ ফলের সরবরাহও প্রচুর। ফল বিক্রেতারা বলছেন, চৈত্র মাসের মাঝামাঝিতে শুরু হওয়া রোজা শেষ হবে অর্ধ বৈশাখে।

আম-লিচুর মৌসুম শুরু হতে দেরি থাকায় ইফতারের টেবিলে তরমুজ, আনারস, বাঙ্গির মতো ফল মাসজুড়েই থাকবে। চৈত্রের এই তপ্ত আবহাওয়ায় সারাদিন রোজা রাখার পর একটু স্বস্তির জন্য জুড়ি নেই রসালো তরমুজের।

তবে এই স্বস্তি ক্রেতাকে এবারও খুঁজতে হচ্ছে চড়া মূল্য দিয়ে। দাম বেশি হওয়ায় তরমুজের স্বাদ নিতে গিয়ে পকেটে টান পড়ছে তাদের। কারণ বাজারে প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকায়। নানা চক্রের কারসাজিতে মাঠ থেকে রাজধানীতে পৌঁছতে পৌঁছতে ১০ টাকা কেজি দরের তরমুজ হয়ে যাচ্ছে ৫০ টাকা।

অর্থনীতির নিয়মে সরবরাহ বেশি হলে সেই পণ্যের দাম কমে আসার কথা। কিন্তু তরমুজের ক্ষেত্রে খাটছে না এ নিয়ম। কারণ কৃষকের কাছ থেকে কম দামে তরমুজ কিনে মধ্যস্বত্বভোগী চক্র কারসাজি করে খুচরা বাজারে দাম অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে পথে পথে চাঁদাবাজি। অথচ তরমুজের বাজারকে স্থিতিশীল করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তেমন কোনো পদক্ষেপই চোখে পড়ছে না।

তরমুজের উৎপাদন: রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ফল বিক্রেতা ইকবাল হোসেন বলেন, এখন ৫-৬ কেজি ওজনের তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। প্রতি কেজির দাম পড়ছে ৪০ টাকার বেশি। গত বছরও দাম এ রকমই ছিল।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে ৬৭ হাজার ৯৫২ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষাবাদ হয়েছে। চলতি বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩৩ লাখ ১১ হাজার ৯৮০ টন ধরা হয়েছে। দেশের মোট আবাদের ৬৫ শতাংশই হয় বরিশাল বিভাগে।

ঢাকা মহানগর ফল আমদানি ও রপ্তানিকারক এবং আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের তথ্যমতে, ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি বাজারে প্রতিদিন বিক্রি হয় পাঁচ কোটি টাকার তরমুজ। বাদামতলীর ওয়াইজঘাটের ৬০টি আড়তে প্রতিদিন বিক্রি প্রায় দুই লাখ পিস। কারওয়ান বাজারে ৪০টি আড়তে দৈনিক বিক্রি লক্ষাধিক পিস। তরমুজ রপ্তানির কোনো উদ্যোগ এখনো নেয়নি সরকার। খুলনার ডুমুরিয়ার কৃষক মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল গত বছর তরমুজের গুড় উদ্ভাবন করলেও তা বাজারজাতে নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ।

যেভাবে দাম বাড়ছে: এবার পাঁচ একর জমিতে তরমুজ আবাদে বরগুনার আতমলী উপজেলার কৃষক আতিকুর রহমানের খরচ হয় তিন লাখ টাকা। সম্প্রতি পুরো ক্ষেতের তরমুজ ঠিকা হিসেবে তিনি বিক্রি করেছেন চার লাখ টাকা। একেকটি তরমুজ আনুমানিক ৪-৮ কেজি ওজন। প্রতি পিস ৪০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়। এতে প্রতি কেজি তরমুজের দাম পড়ে ১০ টাকা। অথচ সেই ১০ টাকা কেজির তরমুজই ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে।

কিন্তু কৃষকের হাত থেকে খুচরা পর্যায়ে আসার পর তরমুজের দাম এত বাড়ে কেন?

জানা গেছে, অন্তত তিন হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত তরমুজের দাম এলাকাভেদে ১০ গুণও বেড়ে যায়।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এক হিসাবে দেখা যায়, বর্তমান উৎপাদন খরচ বিবেচনায় নিয়ে কৃষকের ৩০ শতাংশ, পাইকারি বিক্রেতার ১০ শতাংশ এবং খুচরা বিক্রেতার ২০ শতাংশ লভ্যাংশ ধরলেও ক্রেতা পর্যায়ে প্রতি কেজি তরমুজের দাম ২০ টাকার আশপাশে থাকার কথা। কিন্তু ঢাকায় তা বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়।

চাষিদের কাছ থেকে তরমুজ এনে ঢাকার বাদামতলীতে বিক্রি করেন পাইকারি ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন। 

তিনি বলেন, ক্ষেত থেকে তরমুজ আনলাম আর বেচলাম, ব্যাপার এমন নয়। মৌসুমের শুরুতেই ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা দিয়ে রাখছি মাঠে (দাদন হিসেবে)। ৫০ লাখ টাকা পুঁজি দিয়ে লাভ না করলে খাব কী?

ব্যবসায়ীরা জানান, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে। তরমুজ ঢাকায় আড়ত পর্যন্ত আনতে প্রতিটি ট্রাকের ভাড়া আগে ছিল ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩০-৪৫ হাজার টাকা। ট্রাকের চেয়ে তিন গুণ বেশি খরচ হয় ট্রলারে আনলে। ঢাকার বড় আড়তগুলোতে তরমুজ কিনতে হলে ১০-৩০ টাকা কমিশন গুনতে হচ্ছে ছোট ফল ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে খুচরা ক্রেতাদের।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, তরমুজ পরিবহন ও হাতবদলের সময় অন্তত ৩০ শতাংশ পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া বরগুনা থেকে এক ট্রাক তরমুজ ঢাকায় পরিবহনের ক্ষেত্রে ৩০ হাজার টাকার মতো খরচ হচ্ছে, যা আগে ছিল ১৫-২০ হাজার টাকা। দাম নিয়ে পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। 

তিনি বলেন, তরমুজ এক সময় মৌসুমি ফল ছিল, তবে এখন সারা বছরই কমবেশি পাওয়া যায়। ২/৩ বছর আগেও ভারত ও থাইল্যান্ড থেকে কিছু তরমুজ আমদানি করা হতো; এখন আর হচ্ছে না। ভারতের চেয়ে কম দামে দেশে উৎপাদিত তরমুজগুলো সারা বছর পাওয়া যায়। সবুজ ও হলুদ রঙের রকমেলন নামের এক ধরনের তরমুজ এখন দেশেই উৎপাদন হয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক সমিতির সভাপতি মো. হানিফ খোকন বলেন, নোয়াখালী থেকে একটি তরমুজের ট্রাক ঢাকায় যেতে তিন-চার হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। পচনশীল দ্রব্য হলে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যায়।

আন্তঃজেলা ট্রাকচালক মোহাম্মদ নিয়ামত আলী জানান, এক ট্রিপে তিন থেকে চার হাজার টাকা চাঁদা গুনতে হয়। আর পুলিশকে মাসিক চাঁদা দিতে হয় দুই হাজার টাকা। পুলিশের কেন্দ্রীয় চাঁদা ছাড়াও হাইওয়ে পুলিশকে আলাদাভাবে চাঁদা দিতে হয়। নানা অজুহাতে ট্রাক দাঁড় করিয়ে পুলিশ চাঁদা নেয়।

কৃষি বিপণন আইন ভঙ্গ: কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ অনুযায়ী, ফলের ক্ষেত্রে কেজিতে সর্বোচ্চ ১০ টাকা লাভ করা যাবেএমন বিধান রয়েছে। তবে তরমুজের ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনা হিসেবে বলা আছে, তরমুজে কেজিতে তিন থেকে পাঁচ টাকার বেশি লাভ করা যাবে না। তাছাড়া কৃষি বিপণন আইন ভেঙে কৃষকের কাছ থেকে তরমুজ পিস হিসেবে কিনে তা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে।

খুচরা বাজারে তরমুজের বেশি দামের বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘বিষয়টি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, প্রশাসন এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দেখভাল করে। বাজার যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সে জন্য আমরা তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখি।’

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ওমর মো. ইমরুল মহসিন বলেন, তরমুজের দাম বাড়ার একমাত্র কারণ চাহিদা বেড়ে যাওয়া। তবে আমরা তরমুজের বাজার নিয়ন্ত্রণের নানা রকম পদক্ষেপ নিয়েছি। ফলে এবার তরমুজের দাম কিছুটা কম আছে।

এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, নিয়মিত বাজার মনিটরিং চলছে। ভোক্তাদের জানাতে চাই, প্রতারিত হলে আমাদের কাছে অভিযোগ করুন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh