জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ পৃথিবীর জন্মের আগের মহাবিশ্ব!

আসিফ

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৩, ০৩:১৩ পিএম

সাউদার্ন রিং নীহারিকা। ছবি: সংগৃহীত

সাউদার্ন রিং নীহারিকা। ছবি: সংগৃহীত

আলো সেকেন্ডে এক লাখ ৮৬ হাজার মাইল বা ৩ লাখ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। এই গতিতে এক সেকেন্ডে সাতবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা যায়। সূর্য হতে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট। এই কারণে আমরা বলতে পারি সূর্য পৃথিবী হতে ৮ মিনিট দূরে। এক বছরে আলো মহাশূন্যে পথ অতিক্রম করে ১০ লাখ কোটি কিলোমিটার অথবা ৬ লাখ কোটি মাইল।

যে দূরত্বটি আলো এক বছরে অতিক্রম করতে পারে তাকে এক আলোকবর্ষ বলে। এই একক পরিমাপ করে সময়ের নয় বরং দূরত্বের- বিশাল দূরত্বের। কোনো বস্তু বা ঘটনা থেকে আলো এসে পৌঁছলে আমরা সেই বস্তু ও ঘটনাকে দেখি। ফলে আমরা সবসময় ৮ মিনিট আগের সূর্যকে দেখি। এক আলোকবর্ষ সমান ৯.৪৬ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার বা (৯.৪৬১দ্ধ১০১২) কিলোমিটার।

ওয়েব টেলিস্কোপে বৃহস্পতি এবং তার উপগ্রহ ইউরোপা।

আমাদের সূর্য হলো মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্রের একটি, কেন্দ্র থেকে ৩০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করে। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি হতে সর্পিল অ্যান্ড্রোমিডা ৩১ গ্যালাক্সির দূরত্ব হলো ২০ লাখ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ অ্যান্ড্রোমিডার এই আলোটি যখন রওনা দিয়েছিল সেই সময়টা ছিল ২০ লাখ বছর পূর্বে আমাদের প্রজাতি হোমো স্যাপিয়েন্সের উদ্ভবেরও (৬ লাখ থেকে ১০ লাখ বছর) অনেক আগে।

সবচেয়ে দূরবর্তী কোয়াসারের দূরত্ব হলো ৮০০ কোটি অথবা এক হাজার কোটি আলোকবর্ষ। আজ যে আলোটা আমরা দেখছি তা রওনা দিয়েছিল শুধু পৃথিবী সৃষ্টির আগেই না, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি সৃষ্টিরও আগে। ঠিক তেমনই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) মহাশূন্যের গভীরে হাজারো গ্যালাক্সির ছবি তুলে পাঠিয়েছে, যে দূরত্ব থেকে ওই আলো রওনা দিয়েছিল তা পৃথিবীর উদ্ভবের আগে। ঘটনার অবস্থান থেকে আলোক তরঙ্গ এসে না পড়লে আমরা তা দেখি না বা ক্যামেরায় ছবি তুলতে পারি না। 

আমাদের এই বাধাটা শুধু মহাজাগতিক বস্তুর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয় বরং আমার বন্ধু যে তিন মিটার (১০ ফুট) দূরে অবস্থান করছে তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ তাকে যখন আমি দেখছি তা বর্তমানের নয়, বরং বলা উচিত এক সেকেন্ডের ১০ কোটি ভাগের এক ভাগ সময় আগে। অর্থাৎ তার বর্তমান আর আমার বর্তমানের মধ্যে সময়ের পার্থক্য হলো ১০ কোটি ভাগের একভাগ, যা আমরা অনুধাবনই করতে পারি না। আমরা সবসময় অতীতকে দেখি।

বস্তু থেকে আলো যখন আমাদের চোখে এসে পড়ে তখন আমরা ওই বস্তুটি দেখতে পাই। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, চাঁদের দূরত্ব পৃথিবী থেকে মোটামুটি তিন লাখ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। আর আলোর গতি হচ্ছে, সেকেন্ডে প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার। ফলে যে চাঁদটি আমরা ঠিক এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি তা আসলে এক সেকেন্ডের সামান্য আগের চাঁদ। 

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা প্রথম ছবিতে দেখা যাচ্ছে গ্যালাক্সিগুচ্ছ ‘এসএমএসিএস-৭২৩’। মহাশূন্যের গভীর থেকে ‘এসএমএসিএস-৭২৩’-এর যে ছবিটা ওয়েব টেলিস্কোপে ‘ডিপ ফিল্ড ইমেজে’ ধরা পড়ে, তা শুধু পৃথিবীর জন্মের আগের দৃশ্যই নয়, স্থানের দূরত্ব ৪৬০ কোটি বছরের বেশি ছিল। পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে,  আজ সুদূর অতীতের যে দৃশ্যই ধারণ করা হয়েছে, তা ৪৬০ কোটি বছর আগের চেহারা দেখাচ্ছে।

আজ তাহলে এর চেহারা কেমন? সেটি জানা যাবে ওই একই নিয়মে ৪৬০ কোটি বছর পরে! তবে যদি সেটা পৃথিবীর সাপেক্ষে একই অবস্থানে থাকে। অর্থাৎ আইনস্টাইনীয় স্থির বিশ্ব বা স্ট্যাটিক ইউনিভার্স। আইনস্টাইন মহাবিশ্বকে বর্ণনার জন্য দুটো নীতিতে ব্যাখ্যা করেছিলেন: 

১) সব স্থানে পদার্থের গড় ঘনত্ব সমান এবং কোথাও শূন্য নয়। এই নীতি অনুসারে মহাবিশ্বের যে কোনো দিকে, যে কোনো জায়গা মোটামুটি একই ধরনের। 

২) স্থানে আয়তন সময় নিরপেক্ষ, অর্থাৎ সময়ের ওপর নির্ভরশীল নয়। তিনি আসলে নির্দিষ্ট আয়তন কিন্তু সীমাহীন এক মহাবিশ্বের কল্পনা করেছিলেন। এমন এক মহাবিশ্ব যা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল নয়। এই বিশ্বের প্রত্যেকটি বিন্দুই এর কেন্দ্র অথবা এর প্রান্ত হিসেবে বিবেচনা করা যায়। রিম্যানীয় জ্যামিতি দিয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করা যায়। 

তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে কোয়াসারের ছবি আমরা আগে তুলতে পারলেও এই গ্যালাক্সিগুচ্ছের ছবি পারিনি কেন? তার কারণ হচ্ছে ‘এসএমএসিএস-৭২৩’ থেকে ভেসে আসা দীর্ঘ আলোক তরঙ্গ ধরার জন্য সূক্ষ্ণ সংবেদনশীল টেলিস্কোপ ছিল না। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে ৬.৫ মিটার চওড়া সোনার প্রলেপ লাগানো প্রতিফলক আয়না রয়েছে এবং আছে অতি সংবেদনশীল ইনফ্রারেড তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে যন্ত্রপাতি।

২০২২ সালের ১১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সময় বিকাল ৫টা; বাংলাদেশ সময় ১২ জুলাই রাত ৩টায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা প্রথম ছবি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করেন। বাইডেন একটি ছবি হোয়াইট হাউসে দেখালেও, নাসা ছবির পুরো অ্যালবাম প্রকাশ করে পরদিন। পাঁচটা ছবি সেখানে রয়েছে। এ ধরনের একটি বৈজ্ঞানিক উন্মোচনে রাষ্ট্রপ্রধানের ঘোষণা আগে তেমন পরিলক্ষিত হয়নি।

ওয়েব টেলিস্কোপের ব্যাপারে এ ধরনের ঘোষণা মানবপ্রজাতির কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছা, না রাজনৈতিক অভিলাষ তা বলা মুশকিল। তবে প্রক্রিয়াগতভাবে এটাকে এক ধরনের রাজনৈতিক আচরণ বলেই প্রতীয়মান হয়। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা মহাকাশের ক্ষুদ্র অংশের ওই ছবিটির মতো আরেকটি ছবি আগেই হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা হয়েছিল।

নিঃসন্দেহে ওয়েবের চেয়ে হাবলের স্পষ্টতা কম ছিল। তবে সেটির বৈজ্ঞানিক অবদান এখনো অনেক। এখান থেকে বলা যায় বিজ্ঞান আসলে ক্রমাগত প্রচেষ্টার বিষয়, তাৎক্ষণিকভাবে কিছু পাওয়া নয়। ফলে এখান থেকে বোঝা যায় আমরা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে কী পরিমাণ জটিল বিশ্বে বসবাস করি, পারস্পরিক সম্পর্কের একটি স্বচ্ছ বিশ্বে আসতে আমাদের আরও যথেষ্ট সময় লাগবে। 

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের প্রথম তোলা ছবির প্রকাশিত অ্যালবামে, প্রথম ছবিতে আলোকচ্ছটা বের হওয়া আলোর উৎসগুলো আমাদের মিল্কিওয়ের নক্ষত্র। বাকি সবগুলো এক একটা গ্যালাক্সি। খেয়াল করলে দেখা যায়, সেগুলো হালকা করে বেঁকে আছে। কারণ এই ছবির কেন্দ্রে গ্যালাক্সির ঘনবসতি আছে এবং সেই কারণে দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর আলো বেঁকে গেছে।

পৃথিবীতে মাটিতে দাঁড়িয়ে কেউ যদি এক হাত দূরের একটি ধূলিকণার দিকে তাকায়, পৃথিবীর আকাশে ঠিক ওই ধূলিকণার মতোই ক্ষুদ্র জায়গা দখল করে রেখেছে ছবিতে দেখানো গ্যালাক্সিগুচ্ছ। ছবিটি তুলেছে ওয়েব টেলিস্কোপের ‘নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরা (এনআইআরক্যাম’। সাড়ে ১২ ঘণ্টায় বিভিন্ন মাত্রার ইনফ্রারেড আলো নিয়ে ‘কম্পোজিট’ ছবিটি ধারণ করেছে এনআইআরক্যাম।

ওয়েব যে ইনফ্রারেড তরঙ্গে ছবি তুলেছে তা হাবল টেলিস্কোপের ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। বিভিন্ন ইনফ্রারেড তরঙ্গের এমন একটি ছবি তোলা সম্ভব হলেও হাবল টেলিস্কোপের লেগে যেত কয়েক সপ্তাহ। এনআইআরস্পেক যন্ত্রটি দিয়ে বর্ণালি বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলা যেতে পারে- ছবির বাইরের দিকে নিষ্প্রভ লাল গ্যালাক্সিগুলো থেকে আলো আসতে সময় লাগছে ১৩০০ কোটি বছরের ওপরে।

এগুলো আকাশে পূর্ণ চাঁদের তুলনায় কয়েকগুণ ছোট। চাঁদটি আমরা সবাই দেখি বিধায় এই তুলনাটা অনেক গ্রহণযোগ্য। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে সবকিছু অবলোহিত আলোকে দেখি তাই রংটা আরোপিত। তারা নিয়ম অনুযায়ী বেশি দৈর্ঘ্যরে তরঙ্গকে লাল, অপেক্ষাকৃত স্বল্প দৈর্ঘ্যরে তরঙ্গকে নীল দেখায়। নিরূপণে এক ধরনের কৃত্রিমতা থাকলেও সঠিক বিশ্লেষণে মহাশূন্যের দূরবর্তী আসল রূপটা বের হয়ে আসে এবং ছবিগুলো দেখলে আমরা তা বুঝতে পারি।

তবে আমাদের বিশ্বটা আইনস্টাইনীয় স্ট্যাটিক বা স্থির বিশ্ব নয়। আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণ ব্যবহার করেই আলেক্সান্দার ফ্রিডম্যান প্রসারণরত বা এক্সপেন্ডিং মহাবিশ্বের ধারণা দেন। তিনি বলেন, সব গ্যালাক্সি পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, উদাহরণস্বরূপ দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্রে অনেকটা বেলুন ফোলানোর মতো।

বেলুনের উপর কয়েকটি বিন্দু রং দিয়ে চিহ্নিত থাকলে বেলুন ফোলার সঙ্গে সঙ্গে রং করা বিন্দুগুলোর মধ্যে অন্তর্বর্তী দূরত্ব বাড়বে। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে বিশ্বের আয়তনের পরিবর্তন ঘটে চলেছে। আর এই সরে যাওয়ার হার আমাদের কাছ থেকে দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে সমানুপাতিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এই গতিবেগটি বোঝা যাবে বস্তু বা বিন্দুটি থেকে বিকিরিত আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। যত বেশি গতিবেগ নিয়ে সেই গ্যালাক্সি আমাদের থেকে দূরে সরে যাবে, তত বেশি তার আলোর তরঙ্গ বেড়ে যাবে।

অতিবেগুনি রশ্মি হয়ে যাবে দৃশ্যমান, আর দৃশ্যমান হয়ে যাবে অবলোহিত বা ইনফ্রারেড। ১৩০০ কোটি বছরের পুরনো যে গ্যালাক্সির আলো আমরা দেখছি তা যদি বিকিরিত হয়ে থাকে অতিবেগুনি আলোয় সেটা এখন দৃশ্যমান আলো পেরিয়ে অবলোহিত অবস্থায় পৌঁছেছে, তাই ওয়েব টেলিস্কোপ সব ক্যামেরাই অবলোহিত রঙে সংবেদনশীল। 

তাহলে ১৩০০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের আকার এখন থেকে ছোট ছিল, সুদূর গ্যালাক্সিগুলোর ছবি ওয়েব টেলিস্কোপ তুলেছে, সেগুলো  আমাদের অনেক কাছে ছিল, সম্প্রসারণে ধীরে ধীরে তারা দূরে সরে গেছে। জেমস ওয়েব যে চিত্র ধারণ করছে সেটা সেই গ্যালাক্সির শিশু অবস্থার ছবি। আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সিও খুব পুরনো; যেসব অতীত সময়ের গ্যালাক্সি ওয়েব টেলিস্কোপের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সেখানে উন্নত সভ্যতা থেকে থাকলে, তারাও এই মুহূর্তে আমাদের গ্যালাক্সির ১৩০০ কোটি বছর আগের অবস্থাটি দেখতে পেত। আমাদের অতীতটি আমাদের পক্ষে দেখা কখনোই সম্ভব হবে না, কেননা অতীতের সেই আলো আমাদের ছেড়ে বহু দূরে চলে গেছে।  

প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, আলোটা ১৩০০ কোটি বছরের পথ অতিক্রম করে এসেছে, এই কথার মানে কী? এর মানে হচ্ছে আলোটা যখন রওনা দিয়েছিল তখন গ্যালাক্সিটি বা অবজেক্টটি ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে ছিল না। সেই আলো বিকিরণের সময় গ্যালাক্সিটি হয়তো আমাদের থেকে ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে ছিল, এই মুহূর্তে তার দূরত্ব তিন হাজার কোটি আলোকবর্ষের ওপরে। কাজেই দূরত্ব বলার ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। ১৩০০ কোটি বছরের পুরনো আলো মানে সেই গ্যালাক্সি ১৩০০ কোটি বছর দূরে নয়।

১১ জুলাই ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা ছবিটিতে ৪.৬ কোটি বছর আগের দূরবর্তী গ্যালাক্সি পরিষ্কারভাবে দেখা গেছে। মহাকাশ সংস্থা নাসা জেমস ওয়েবের তোলা দূরবর্তী মহাকাশের আরও চারটি অত্যাশ্চর্য ছবি প্রকাশ করেছিল। প্রকাশিত নতুন ছবিগুলোর মধ্যে আছে একটি ‘নাক্ষত্রিক নার্সারি’, একটি মৃত নক্ষত্রের চারপাশে গ্যাসের গোলক ও গ্যালাক্সির একটি দলের মধ্যে ‘মহাজাগতিক নৃত্যের দৃশ্য’। 

একটি ছবিতে দূরবর্তী গ্যাসীয় একটি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প দেখা গেছে। সৌরজগতের বাইরে গ্রহটির নাম WASP-96 b। এটা একটি বিশাল গ্রহ যা মূলত গ্যাস দ্বারা গঠিত, ২০১৪ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই গ্রহটি পৃথিবী থেকে প্রায় ১,১৫০ আলোকবর্ষ দূরে, এর ভর বৃহস্পতির প্রায় অর্ধেক এবং মাত্র ৩.৪ দিনে এটি তার নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। এই পর্যবেক্ষণটি আলোর ইনফ্রারেড তরঙ্গদৈর্ঘ্য দিয়ে করা সম্ভব হয় বিধায় আগে বিজ্ঞানীরা এটা করতে সমর্থ ছিলেন না। এই পর্যবেক্ষণে আলোর সুনির্দিষ্ট রঙের উজ্জ্বলতার ক্ষুদ্র হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট গ্যাসের অণুর উপস্থিতি প্রকাশ করে। এখন পর্যন্ত এই ধরনের সবচেয়ে বিস্তারিত ছবি এটি, যা শত শত আলোকবর্ষ দূরের গ্রহে আবহমণ্ডল বিশ্লেষণে ওয়েব টেলিস্কোপের অভূতপূর্ব ক্ষমতার প্রদর্শনই বলা যেতে পারে।

অন্য একটি ছবিতে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত ক্যারিনা নীহারিকা সম্পর্কে নতুন তথ্য প্রকাশ করেছে। ক্যারিনা নীহারিকা হলো রাতের আকাশে দেখা যাওয়া সবচেয়ে বড় ও উজ্জ্বল নীহারিকা। এটি দক্ষিণ ক্যারিনা নক্ষত্রমণ্ডলে প্রায় ৭,৬০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। ক্যারিনা নীহারিকা অনেক বৃহদাকার নক্ষত্রের আবাসস্থল, সূর্যের চেয়ে কয়েকগুণ বড়।

ওয়েব টেলিস্কোপের এই নতুন ছবিতে এমন অনেক নক্ষত্রকে দেখা যাচ্ছে যা আগে দৃশ্যমান ছিল না। ক্যারিনা নীহারিকা ছবিটির ঠিক প্রান্তে মেঘের শত শত নক্ষত্র দেখা যায়, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। নীহারিকাটির মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ধুলা ও গ্যাস বিদ্যমান, যা মানুষের চোখে দৃশ্যমান ছিল না। মহাজাগতিক চূড়া হিসেবে উল্লেখ করা এলাকাটি আসলে প্রায় ৭,৬০০ আলোকবর্ষ দূরে, NGC 3324-এর মধ্যে বিশাল একটি গ্যাসীয় গহ্বরের প্রান্ত। ছবিতে দেখানো এলাকার উপরে বুদবুদের কেন্দ্রে অবস্থিত অত্যন্ত বৃহদায়তন, উষ্ণ, তরুণ নক্ষত্র থেকে তীব্র অতিবেগুনি বিকিরণ।

নাক্ষত্রিক ব্যত্যয় নীহারিকার মধ্যে এই গুহা এলাকাটি সৃষ্টি হয়েছে। এই নক্ষত্রগুলো থেকে উচ্চশক্তির বিকিরণ নীহারিকাটির প্রাচীরকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে এই রকম অসমতল প্রান্ত তৈরি করে। যা দেখতে অনেকটা খরখরে পাহাড়ের মতো দেখায়, তা আসলে ক্যারিনা নীহারিকার কাছাকাছি, তরুণ নক্ষত্র গঠনের অঞ্চল NGC 3324-এর প্রান্ত। 

দৃশ্যমান আলোয় তুললে নীহারিকার মধ্যকার সৃষ্ট উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোকে দেখা যেত না। দেখা যেত না কালো ঘন অংশগুলোকে, যেখানে নতুন নক্ষত্রের কেবল জন্ম হচ্ছে। পৃথিবী ও সূর্য এরকম একটি নীহারিকাতেই আজ থেকে ৪৫০ কোটি বছর আগে জন্মেছে। ছবিটিতে আমরা দেখছি 

লাল-বাদামি নীহারিকার ওপর অতি উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোর বিকিরণ চতুর্দিকে গ্যাস ও ধূলিকণার মধ্য দিয়ে নীল রং ধারণ করেছে (একই কারণে আমাদের আকাশের রং নীল)। এই শক্তিশালী বিকিরণ আবার নিচের নীহারিকাকে ক্রমাগতই ধ্বংস করছে বা সরিয়ে দিচ্ছে। দৃশ্যমান আলোয় ছবিগুলো তুললে রংগুলো মোটামুটি একই থাকত, তবে নীহারিকা ভেদ করে কিছুই দেখা যেত না। অবলোহিত তরঙ্গ আমাদের অনেক বেশি স্বরূপের সন্ধান করে।

১৪ জুলাই নাসা জেমস ওয়েব বৃহস্পতি ও সংশ্লিষ্ট এলাকার ছবি, প্রথমবারের মতো ইনফ্রারেড আলোয় ধারণ করে। একই সময়ে প্রকাশিত একটি প্রি-প্রিন্টে নাসা, ইসা ও সিএসএর বিজ্ঞানীরা বলেছেন, জেমস ওয়েবের কর্মক্ষমতা প্রত্যাশার চেয়ে ভালো। সম্পাদনের সময় নথি বর্ণনা করেছিল, লক্ষ্যসমূহকে ৬৭ মিলি আর্কসেকেন্ড/সেকেন্ড দ্রুতিতে, প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে ক্যাপচার করেছিল। এটি গ্যালাক্টিক কেন্দ্রের দিকে একটি ঘনত্বসম্পন্ন ক্ষেত্রে শত শত নক্ষত্রের বর্ণালি পেয়েছিল (নক্ষত্র থেকে বিভিন্ন রঙের আলোকে বর্ণালি বলা হয়)।

তবে ওয়েব টেলিস্কোপে তোলা বৃহস্পতি গ্রহ বা জুপিটারের কিছু বিস্ময়কর ছবি প্রকাশ করেছে নাসা। নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ সৌরজগতের বৃহত্তম এই গ্রহটির অরোরা বা বর্ণচ্ছটা, দানবীয় ঝড়, বৃহস্পতির চাঁদ ও গ্রহটিকে ঘিরে থাকা বলয়ের দারুণ সব ছবি পাঠিয়েছে। এসব ছবি বৃহস্পতি গ্রহের ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন সূত্র দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এভাবেই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ছবি তুলে চলেছে। 

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি)  মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা, কানাডীয় মহাকাশ সংস্থা ও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টায় নির্মিত একটি মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র। এটিকে নাসার হাবল মহাকাশ টেলিস্কোপের উত্তরসূরি হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বর দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-র্পূব উপকূলে বিষুবরেখার কাছে ফরাসি গায়ানার কুরু শহর থেকে উৎক্ষেপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এই শহরে অবস্থিত গায়ানা মহাকাশ কেন্দ্র থেকে ফরাসি বাণিজ্যিক রকেট উৎক্ষেপণ কোম্পানি আরিয়ান স্পেসের তত্ত্বাবধানে সফলভাবে উৎক্ষেপণ সম্পন্ন করা হয়। উৎক্ষেপণের পরে ওয়েব প্রায় ৩০ দিন মহাকাশযাত্রা সম্পন্ন করে; পৃথিবী থেকে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরত্বে (চাঁদের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি দূরত্বে দ্বিতীয় লাগ্রাঞ্জীয় বিন্দুতে, যে বিন্দুতে পৃথিবী ও সূর্যের মহাকর্ষীয় লব্ধিবল এবং মহাকাশযানের কেন্দ্রাতিগ বল একে অপরকে নাকচ করে দেয়) পৌঁছানোর পরে সেটিতে অবস্থান করে সবসময় পৃথিবীর অন্ধকার পার্শ্বে থেকে পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে একই সময় বছরে একবার র্সূযকে প্রদক্ষিণ করবে।

এই লাগ্রাঞ্জীয় বিন্দুর ব্যবহার প্রসঙ্গে খাতনামা আর্থার সি ক্লার্ক তার ‘এ ফল অব মুনডাস্ট’ (A Fall of Moondust 1961) বইয়ে সম্ভবত প্রথম উল্লেখ করেন। দ্বিতীয় লাগ্রাঞ্জীয় বিন্দুটির সফলভাবে ব্যবহার সম্পন্ন হলো এই টেলিস্কোপের স্থাপনের মধ্য দিয়ে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মূলত চারটি মূল লক্ষ্য পূরণের প্রচেষ্টা রয়েছে।

১. মহাবিস্ফোরণের পরে মহাবিশ্বে গঠিত প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি থেকে বিকিরিত আলোর সন্ধান করা; ২. গ্যালাক্সি গঠন ও বিবর্তনের গবেষণায় সহায়তা; ৩. নক্ষত্র ও গ্রহ গঠন বোঝাতে সহায়তা; ৪. গ্রহমণ্ডল ও জীবনের উৎস সন্ধানে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এটা ঠিক লক্ষ্য পূরণে বর্ণালির দৃশ্যমান অংশের আলোর চেয়ে কাছাকাছি ইফ্রারেড আলোতে পর্যবেক্ষণে আরও কার্যকরভাবে সম্পন্ন করা যেতে পারে।

JWST 0.6 থেকে 28 μm (যথাক্রমে প্রায় 100°K বা −−173°C-এ কমলা আলো এবং গভীর ইনফ্রারেড বিকিরণের সাথে সম্পর্কিত) তরঙ্গের একটি পরিসরে সংবেদনশীল হবে। ২০১৫ সালে আবিষ্কৃত স্টার KIC 8462852-এর আলো কমে যাওয়া এবং বিরাজমান অস্বাভাবিক আলোর বক্ররেখার ওপর তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হতে পারে। উপরন্তু মিথেনকে শনাক্ত না করার ওপর নির্ভর করেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহটি বায়োসিগনেচার কিনা বলতে সমর্থ করে তুলবে। 

এই টেলিস্কোপের সহায়তায় আলোর মতো বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ তার বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরবর্তী ঘটনাবলিকে দেখতে সহায়তা করবে। আজ থেকে ১৩২০ কোটি বছরেরও আগে (মহাবিস্ফোরণের প্রায় ৪০ কোটি বছর পরে) মহাবিশ্বের প্রথম গ্যালাক্সি ও আদ্যনক্ষত্রগুলো কীভাবে রূপলাভ করেছিল, তা সম্ভবত জানা যেতে পারে। 

কিন্তু এই যে গ্যালাক্সিগুলো দেখছি তারা কত দ্রুত আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে; খুবই দ্রুত আলোর গতির শতকরা ৯৫ ভাগ গতিতে। তাহলে কি আমরা এমন গ্যালাক্সি পাব না, যা কিনা আলোর গতি থেকে দ্রুত সরছে? সেরকম আছে, কিন্তু সেগুলো আমাদের যে দৃশ্যমান মহাবিশ্ব তার বাইরে। আর দৃশ্যমান মহাবিশ্বটা কত বড়? মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ দূরত্ব থেকে আমরা আমাদের কাছে এক ধরনের আলো আসতে দেখি, সেই আলো হলো সর্বস্থানে বিরাজমান মাইক্রোওয়েভ পটভূমি।

সেই আলো রওনা হয়েছিল আজ থেকে ১৩৮০ কোটি বছর আগে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির চার লাখ বছর পরে মহাবিশ্বের বস্তুর ঘনত্ব কমে গিয়ে আলোকে সুযোগ করে দিল মুক্ত হওয়ার। এটাকে একটি অস্বচ্ছ দেওয়াল বলা যায়, যা কিনা বিগ ব্যাং-এর মাহেন্দ্রক্ষণ দেখার সুযোগ দেয় না। সেই দেওয়ালটি আমাদের থেকে প্রায় ৪৫০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। সেখান থেকে এই মুহূর্তে যে আলো বিকিরিত হচ্ছে সেটা আদৌ কোনোদিন আমাদের কাছে পৌঁছবে না। উল্লেখ্য, ১৩৮০ কোটি বছর আগে সেই দেওয়ালটি আমাদের থেকে মাত্র কয়েক কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত ছিল। 

যেখানে হাবলকে নিকট-অতিবেগুনি, দৃশ্যমান আলো ও নিকট-অবলোহিত বিকিরণ বর্ণালি পর্যবেক্ষণে তৈরি করা হয়েছিল, তার বিপরীতে জেমস ওয়েব অপেক্ষাকৃত নিম্নতর কম্পাঙ্কের পরিসীমার বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করবে, যার মধ্যে দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে দৃশ্যমান কমলা আলো থেকে শুরু করে মধ্য-অবলোহিত তরঙ্গগুলো অন্তর্ভুক্ত (০.৬-২৮.৩ মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট)।

ফলে এটি একই সঙ্গে হাবল মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র ও স্পিটজার মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের (একটি ০.৮৫ মিটার ব্যাসের অবলোহিত দূরবীক্ষণ যন্ত্র) ভবিষ্যৎ উত্তরসূরি। এর সংবেদনশীলতা ও সূ²তার জন্য মূল ও গৌণ মিরর বা দর্পণের তাপমাত্রা শূন্যের চেয়ে ২২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে বা ৫০ ডিগ্রি কেলভিনে রয়েছে।

১৯৯৬ সাল থেকে পরিকল্পিত এ প্রকল্পটি একটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার ফল, যার নেতৃত্বে রয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা। নাসার গডার্ড ফ্লাইট সেন্টার যন্ত্রটির নির্মাণ প্রচেষ্টার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ছিল। নরথ্রপ গ্রামেন কোম্পানিকে যন্ত্রটি নির্মাণের মূল ঠিকাদার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হলেও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ও কানাডীয় মহাকাশ সংস্থাও এই কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

সব মিলিয়ে বিশ্বের ১৪টি দেশ ও ২৯টি মার্কিন অঙ্গরাজ্যের তিন শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্থা ও কোম্পানির পাশাপাশি বহু দেশের শতশত বিজ্ঞানী ও হাজার হাজার প্রকৌশলী এই প্রকল্পের উপরে কাজ করেছেন। সব মিলিয়ে এখানে যারা কাজ করছেন বা মেধা খাটাচ্ছেন তারা বহু দেশের নাগরিক। বিজ্ঞানও একটা চলতে থাকা প্রক্রিয়া। হাবল, স্পিটজার হয়ে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ একটা অগ্রগতির ধাপ। হঠাৎ করে পাওয়া কিছু নয়। তাই এর মাধ্যমে আমাদের অর্জন কোনো একক দেশের নয় বা এভাবে প্রতিফলিত করা ঠিক নয়। নিশ্চয়ই রাষ্ট্রনায়করা বুঝতে পারবেন। এগুলো পৃথিবীর মানুষের অর্জন হিসেবেই পরিগণিত হবে। 

লেখক: বিজ্ঞান বক্তা; সম্পাদক, মহাবৃত্ত (সায়েন্স জার্নাল)

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh