মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতীয় পুনর্জাগরণের বাহন

শেখর দত্ত

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১০:২৭ এএম

শেখর দত্ত। ফাইল ছবি

শেখর দত্ত। ফাইল ছবি

সর্ব বাঙালির মিলনের চেতনায় উদ্ভাসিত পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ । আমাদের জাতীয় উৎসবের দিন। সৌহার্দ, একাত্মতা, ভ্রাতৃত্ববোধে দিবসটি চির উজ্জ্বল। জীর্ণ পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে পরস্পরের মঙ্গল কামনায় আনন্দ-উৎসবের ভেতর দিয়ে নতুন ও শুভকে আবাহন করে নববর্ষ।

বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে উপযোগিতা ছিল বলেই বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন হিসেবে দিবসটি বাংলার গণমানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জড়িয়েছিল। রাজনীতির নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মানচিত্রের নানা পরিবর্তন সত্ত্বেও দিবসটি টিকে রয়েছে, এর মধ্যে চিরঞ্জীব হওয়ার উপাদান ছিল বলেই।

রাজনীতি-অর্থনীতির সঙ্গে 

সংস্কৃতি ওতপ্রোতোভাবে জড়িত। এর একটা অপরটাকে প্রভাবিত করে, রূপান্তরও ঘটায়। কখনো তা পরিদৃষ্ট হয়, কখনোবা ফল্গু নদীর মতো বয়ে চলে। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে মানচিত্র পরিবর্তিত হয়ে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান নামে কৃত্রিম রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং আমাদের ওপর বিদেশি শাসন চেপে বসে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিদেশি শাসক ও তার তল্পিবাহকরা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিকে বিজাতীয় বা হিন্দু সংস্কৃতি বলে সমাজজীবন থেকে উৎখাতের চেষ্টা করে । তখন আপতদৃষ্টিতে এমনটাই মনে হয়েছিল, আবহমান কাল থেকে চলে আসা বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক নববর্ষ আমাদের জাতীয় জীবন থেকে হারিয়ে যাবে।

কিন্তু প্রবহমান নদীকে কি কেউ হারিয়ে দিতে পারে! যে রাজনীতি ও অর্থনীতি পহেলা বৈশাখকে উৎখাত করতে চেয়েছিল, স্বল্প সময়ের মধ্যেই তা পাল্টে যায়। সংস্কৃতির প্রধান উপাদন ভাষাকে আঘাত করে বিজাতীয় শাসক-শোষকরা। বাঙালি সংস্কৃতি জেগে ওঠে। আমাদের সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বাহন রবীন্দ্র সঙ্গীতকে বিজাতীয় বা হিন্দুদের সঙ্গীত আখ্যায়িত করে বর্জন করতে চাইলে, কবিতার শব্দ-লাইন পরিবর্তন করে ধর্মীয়করণ করা হতে থাকলে সংস্কৃতি বাধা পায় এবং চলার পথকে অবারিত করতে রাজনীতির সঙ্গে মিশে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের মধ্যে ষাটের দশকের প্রথম দিক থেকে দেশের এখানে ওখানে নগর জীবনে শিক্ষিত বিশেষত ছাত্র-যুবকদের মধ্যে বাংলা নববর্ষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে পালিত হতে থাকে।

জাতীয়তাবাদী রাজনীতি অগ্রসর ও বেগবান হওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ভিত্তির। এক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন অর্থনীতিবিদ ও সংস্কৃতিসেবীরা। পূর্ব-পশ্চিম ‘দুই অর্থনীতি’ তথ্য-তত্ত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনকে অর্থনৈতিক ভিত্তি দিতে থাকে। পাকিস্তানি শাসক-শোষকরা নানা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা নিরসনের চেষ্টা করে, যা ছিল লোকদেখানো ভাঁওতাবিশেষ।

তবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভিত্তি পাওয়া ছিল বেশ কঠিন। কারণ পাকিস্তানি শাসকরা সহজেই বাঙালি সংস্কৃতিকে বিজাতীয় বা হিন্দু সংস্কৃতি বলে আঘাত করতে পারত। এই পর্যায়ে প্রথমে লড়াই শুরু হয় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের ভেতর দিয়ে। এতে আতঙ্কিত হয় বিদেশি শাসক-শোষকগোষ্ঠী। অজুহাত পেয়ে ১৯৬৪ সালের শুরুতেই বাধায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’ স্লোগান নিয়ে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে নামে পূর্ব বাংলার ক্রম জাগরিত ঐক্যবদ্ধ শক্তি। বুমেরাং হয় শাসক-শোষকদের কারসাজি। পরের বছরই আবার রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে বাধায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ। তাও হয় বুমেরাং। স্লোগান ওঠে ‘পূর্ব বাংলা অরক্ষিত কেন?’

এই দুই প্রতিরোধ আন্দোলনের ভেতর দিয়ে রাজনীতির সঙ্গে বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন বিজড়িত ও জোরদার হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবের ৬-দফা দাবি এবং ওই দাবিতে আন্দোলন ছিল জাতির এসব তৎপরতার সার্বিক বহিঃপ্রকাশ। 

১৯৬৭ সালে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় ছায়ানটের উদ্যোগে রমনার বটমূলে গানের অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে পালিত হয় পহেলা বৈশাখ। ছাত্র ইউনিয়ন হোসেনী দালানে অফিস থেকে গান গেয়ে মিছিল নিয়ে শহীদ মিনার হয়ে আসে রমনার বটতলায়। তবে অনুষ্ঠানের জমায়েত ছোট হলেও তা ছিল অবেগমথিত, তাৎপর্যপূর্ণ। পহেলা বৈশাখ পালনের ভেতরে দিয়ে বাঙালি পেয়ে গেল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে অগ্রসর করার সাংস্কৃতিক ভিত্তি। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে শাসক-শোষকরা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে গলা টিপে মারার লক্ষ্যে আগরতলা মামলা দায়ের ও বিচারকাজ শুরু করে। একই সঙ্গে দমন-পীড়ন তীব্র ও ব্যাপক করে তোলে। এই প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি হয় ১১-দফার ভিত্তিতে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, যা বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যায়। স্বাধীনতা অর্জনের আগে ঘাতক-দালালদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির ওপর বিদেশি শাসক-শোষকদের তীব্র বিদ্বেষ ও ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এই জন্যই পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গৃহীত জাতীয় তিন মূলনীতিতে জাতীয়তাবাদ শব্দটি যুক্ত করেন এবং বলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিপন্ন হলে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।

এজন্যই দেখা যাবে স্বাধীন দেশে হত্যা-ক্যুয়ের ভেতর দিয়ে রাজনীতির পটপরিবর্তন হলে স্বাধীনতার শত্রুরা প্রথমে আঘাত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে। কিন্তু সংস্কৃতি যে বহতা নদী, বাঁধ দিলে যে তা মানে না। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের মধ্যেই ১৯৮৬ সালে যশোরে চারুপীঠ পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠানে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ যুক্ত করতে প্রয়াসী হয়। ১৯৮৯ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউট ঢাকায় প্রথম ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’র আয়োজন করে। এভাবেই চলছিল।

কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ বাবরি মসজিদ ইস্যুকে অজুহাত হিসেবে সামনে এনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো এবং ১৯৯১ সালে নির্বাচনের ভেতর দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার অবসান হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ার পটভূমিতে আনন্দ শোভযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপান্তরিত হয়। এমনটা হওয়াই ছিল জাতির সংস্কৃতির গতিধারার স্বাভাবিক ও শুভ পরিণতি। 

২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকারের আবেদনক্রমে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ অন্তর্ভুক্ত হয়। এখন তা বিশ্ব সংস্কৃতির অঙ্গ। শক্তি, শান্তি ও অগ্রগতির জন্য অশুভকে দূরে সরানোর প্রতীক। নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলে তা সর্বজনীন রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে এবং ২০১৭ সালে তা মহাসমারোহে পালনের প্রস্তুতি চলে ।

শুরু হয় সেই পাকিস্তানি আমলের মতোই পহেলা বৈশাখ, বিশেষত মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বাতিল করার লক্ষ্যে অপপ্রচার। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মুখ খুলতে হয়। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘এই শব্দটিতে মঙ্গল আছে বলেই কি হিন্দু হয়ে গেল। তাহলে মঙ্গলবারটাও কি হিন্দুবার হয়ে গেল...?’ তিনি বিভেদ ছড়াতে নিষেধ করেন এবং দেশবাসীকে এই অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে সজাগ থাকার আহ্বান জানান।

ওই সময়ে সপরিবারে আমি ছিলাম নিউইয়র্কে। লং আইল্যন্ডে ‘রঙ্গালয়’ নামে এক প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। একটি চার্চে অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রদীপ প্রজ্বলনের পর হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। অংশগ্রহণ শেষে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকা আমেরিকান-আফ্রিকান এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার কাছে ‘প্রসেশন অব ওয়েল বিইং’ শব্দটির ব্যাখ্যা যথাসম্ভব করেছিলাম। সঙ্গত কারণেই তিনি খুব আপ্লুত হলেন। 

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এবারে সংস্কৃতি, ধর্ম ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকা জেলা প্রশাসক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের ডিন প্রমুখের কাছে যে আইনজীবী (শুনেছি তিনি জামায়াতি) নোটিশ পাঠিয়েছেন, তাতে নববর্ষ পালন ও মঙ্গল শব্দটিকে টার্গেট করা হয়নি। নববর্ষ ও মঙ্গল শব্দ ছাড় দিয়ে বেশ পিছিয়ে এসে টার্গেট করা হয়েছে পুতুল, হাতি, কুমির, লক্ষ্মীপেঁচা, নীল গাই, মযূর, ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোশ সংবলিত মঙ্গল শোভাযাত্রাকে। বলা হয়েছে, তা বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ক-এর সরাসরি লঙ্ঘন। এটা দণ্ডবিধির ২৯৫-ক ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধও।

এই নোটিশ পাওয়ার পর ‘অসাংবিধানিক, বেআইনি ও কৃত্রিম উদ্ভাবিত’ মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যথায় এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে। যিনি বা যে গোষ্ঠী তা করছে, তারা যে ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপব্যবহার করতে চায়, তা ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে সুস্পষ্ট। জাতিবিরোধী এই শক্তির কাছে প্রশ্ন-গ্রামে-গঞ্জে গেলে এখনো দেখা যায় কাকতাড়ুয়া, যা মানুষের অবিকল। পাখি বা পশু, রোগ ও পোকামাকড় থেকে ফসল রক্ষা করতে তা ব্যবহৃত হয়। সেই সংস্কৃতি কি অসংবিধানিক ও বেআইনি? এটাও কি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত?

ইতোমধ্যে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বিবৃতিতে বলেছে, অপচেষ্টা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করা হবে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে মন্তব্য করে সংস্কৃতি অঙ্গনের নেতারা বলেছেন, আইন পেশার মতো দায়িত্বশীল কাজে এই আইনজীবীর যুক্ত থাকা উচিত নয়। এই মাত্র জানলাম, মঙ্গল শোভাযাত্রা অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নববর্ষ পালনের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। বাধা পেলে বেগবান ও দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে বাঙালি সংস্কৃতি। এবারে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে জাতি পুনর্জাগরণের পথে অগ্রসর হবে, এমনটা নববর্ষ পালন সামনে রেখে একান্ত কামনা।


শেখর দত্ত
কলাম লেখক, রাজনীতিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh