পাঠান সিনেমা এবং বাংলা চলচ্চিত্রের মৃত্যুঘণ্টা

ফ্লোরা সরকার

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ০২:২০ পিএম | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ০২:২২ পিএম

সিনেমা। ছবি: সংগৃহীত

সিনেমা। ছবি: সংগৃহীত

২০১১ সালে ‘সেন্সেস অব সিনেমা’ পত্রিকার ৫৮তম সংখ্যায় মালয়েশিয়ান ও তাইওয়ানিজ চলচ্চিত্র নির্মাতা সাই মিং-লিয়াং-এর ইংরেজিতে অনূদিত ‘অন দ্য ইউজেজ অ্যান্ড মিস ইউজেজ অব সিনেমা’ শিরোনামে দীর্ঘ একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়। যে প্রবন্ধটি ছাপা হয় সেটা মূলত তাইওয়ানের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে ২০১০ সালের ২৬ মে সাই মিং-লিয়াং-এর দেওয়া একটা বক্তৃতা। ২০০৯ সালে সাইয়ের ‘ফেস’ সিনেমা মুক্তির পরপর উল্লেখিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম বিভাগের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি এই বক্তৃতা দেন। 

সেখানে সাই বলছেন, ‘১৯৮০-র দশকে তাইওয়ানে সিনেমা নিয়ে সমালোচনার একটা ঝড় ওঠে এবং সেটা হলো, তাইওয়ানিজ সিনেমার মৃত্যুঘণ্টা বেজে উঠেছে। কেন? দর্শকরা আকস্মিক এই খবরে চমকে ওঠেন। তার কারণ তাইওয়ানে বছরে যেখানে দুইশ সিনেমা মুক্তি পেত সেটা মাত্র দুই ডজনে নেমে এসেছিল। সিনেমার বাজারের দিক থেকে এই সমালোচনা তাইওয়ানিজ সিনেমার মৃত্যঘণ্টার সমান। 

গত বছর আমি যখন জার্মানির এক প্রবীণ চলচ্চিত্র নির্মাতার সঙ্গে দেখা করতে যাই, তিনি বলেছেন যে, ১৯৮৪ সালের দিকে জার্মান সিনেমার মৃত্যুঘণ্টা নিয়ে প্রায় একই ধরনের সমালোচনা শুরু হয়েছিল-আমার মনে হয় এসবই সিনেমার বাজার বা বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়। কম-বেশি সব দেশকে জাতীয় সিনেমার মৃত্যুঘণ্টার সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং হয়, যদিও তার ভিন্ন ভিন্ন কারণ ও প্রেক্ষাপট থাকে।’ 

ঠিক একই সংকটের মুখোমুখি বর্তমান বাংলাদেশের বাংলা সিনেমা। ১৪৬০টি সিনেমা হলের জায়গায় এখন মাত্র ২০০টি সিনেমা হল কোনোরকমে টিকে আছে, যার মধ্যে আবার ৬০/৬৫টি চলমান আছে। বছরে যেখানে ১১২টা সিনেমা মুক্তি পাওয়া দরকার, সেখানে মাত্র ১৬টা সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। আজকের আলোচনা আমাদের বাংলা সিনেমার এই সংকটকালীন সময়কে ঘিরে এবং সংকট সঠিকভাবে শনাক্ত করে উত্তরণের পথ খুঁজে নেওয়ার প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে।

বাংলা সিনেমার সংকট নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই সমালোচনা চলে আসছে। এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাঠান’ সিনেমা বাংলাদেশে আমদানি এবং প্রদর্শনীর প্রশ্নটা যখন উঠল, তখন চলচ্চিত্র সমিতি থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া, বিভিন্ন পত্রিকায় বিষয়টা নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হলো। কেউ ভারতীয় সিনেমা আমদানি ও প্রদর্শনের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। 

পরাণ সিনেমার দৃশ্য।

আমরা এই পক্ষ-বিপক্ষের বিষয়টা তিন দিক থেকে দেখব এক. সিনেমা হলের মালিকদের দিক থেকে এবং দুই. চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দিক থেকে এবং তিন. দর্শকের জায়গা থেকে। এখানে একটা কথা খুব ভালো করে মনে রাখা দরকার যে, সিনেমা শুধু চিত্ত বিনোদনের জায়গা নয়, সিনেমা একটা পণ্যও। অন্যান্য পণ্যের মতোই এর বেচাকেনা চলে। 

কোনো শপিং মলে গিয়ে আমরা যেমন আমাদের পছন্দের কাপড়, ব্যাগ, জুতা ইত্যাদি কিনি, ঠিক তেমনি দর্শক তার পছন্দের সিনেমা সিনেমা হলে গিয়ে টিকিট কেটে দেখে। যারা ভারতীয় সিনেমা আমদানির পক্ষে তারা মূলত সিনেমা হলের মালিক। যেহেতু বাংলাদেশে বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যা ভয়াবহভাবে কমে গেছে এবং দর্শক সমাগমের স্বল্পতার পাশাপাশি সিনেমা হলগুলোতে নিয়মিতভাবে বাংলা সিনেমা প্রদর্শন করা সম্ভব হচ্ছে না, কাজেই যুক্তিসঙ্গত কারণে হলমালিকেরা তাদের হলগুলো চালু রাখার জন্য সিনেমা প্রদর্শন অব্যাহত রাখতে চাইবেন, সেটা দেশি বা বিদেশি, যে কোনো সিনেমা দিয়েই পূরণ করা হোক। 

অন্য দিকে আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতারা নিজেদের নির্মিত সিনেমার বাজার হারানোর আশঙ্কায় চাইবেন, শুধু তাদের ছবিই সিনেমা হলে প্রদর্শিত হোক। কাজেই এই দিক থেকে বিবেচনা করলে, বিদেশি বা ভারতীয় ছবি আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই। মূল সংকটটা ঠিক এই জায়গাতে। দর্শকের মতামতের জায়গায় আমরা একটু পরে আসছি।

মুক্ত বাজার অর্থনীতি, পূর্ণ প্রতিযোগিতা এবং ইন্টারনেটের এই যুগে সিনেমা নির্মাণ ও প্রদর্শন এবং তার বাজার দখল-দুই ক্ষেত্রেই নতুন এক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। সিনেমার ইতিহাসে যা আগের সিনেমার সঙ্গে মেলানো যাবে না। 

নতুন এই পরিস্থিতিতে নিজেদের খাপ খাওয়াতে না পারলে, বাংলা সিনেমার সংকট দিন দিন আরও বেড়ে চলবে। কারণ, দর্শক এখন শুধু সিনেমা হল নির্ভর না, সিনেমা দেখার সমান্তরাল অনেক ব্যবস্থা ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে। ঘরে বসেই সে এখন তার পছন্দমতো সিনেমা দেখতে পারে। কিন্তু এতসব কিছুর পরও, বড়পর্দার আবেদন অন্যরকম। বড়পর্দায় সিনেমা দেখা আর মোবাইল স্ক্রিনে ছবি দেখার মধ্যে বিশাল ফারাক। মাল্টিপ্লেক্সের কারণে সিনেমা প্রদর্শনের পদ্ধতিগত ব্যবস্থারও বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে। 

এখন দর্শক ফোর ডি এক্স, আইম্যাক্স, থ্রি ডি, ফাইভ ডি, সেভেন ডি, নাইন ডি-ইত্যাদির মাধ্যমে সিনেমা শুধু চোখ দিয়ে দেখে না, মানসিক অনুভূতির পাশাপাশি শারীরিক অনুভ‚তিরও ব্যবস্থা করা হয়। কাজেই সিনেমা হলের চাহিদা এবং আবেদন আগের চেয়ে আরও বহুল পরিমাণে বেড়েছে। 

এমন পরিস্থিতিতে যদি আমরা উল্লেখিত ব্যবস্থা সমৃদ্ধ সিনেমা হল ও সিনেমা নির্মাণ করতে না পারি, তাহলে অবশ্যই বাংলা সিনেমা বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না। যে কারণে ‘পাঠান’ আমদানি নিয়ে এত আলোচনা হয়েছিল।

পাঠানের গল্পে কী আছে? পাঠান সিনেমার সারমর্ম যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখতে পাব-গল্পের বুনন একদিকে যেমন পোক্ত করে বোনা হয়েছে অন্য দিকে বিভিন্ন স্পেশাল ইফেক্ট দিয়ে দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে বাধ্য করা হয়েছে। ছবির নায়ক পাঠান (শাহরুখ খান) ভারতীয় গুপ্ত সংস্থা ‘র’-এর বিশেষ এজেন্ট। যেহেতু ছবির নায়ক, কাজেই সে সাহসী ও বুদ্ধিমান। 

একটা প্রাইভেট সন্ত্রাসী গ্রুপ আধুনিক প্রযুক্তির (আধুনিক প্রযুক্তি বলতে ছবিতে করোনা ভাইরাসের মতো ভাইরাস ছড়ানোর প্রক্রিয়াকে দেখানো হয়েছে) সাহায্যে ভারতে আক্রমণ চালানোর হুমকি দেয়। বিষয়টা ‘র’-এর ব্যক্তিগত ইগোতে গিয়ে লাগে। পাঠান সেই সন্ত্রাসী গ্রুপকে নিশ্চিহ্ন করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। শুরু হয় ইঁদুর-বিড়াল খেলা। 

গল্প কখনো তিন বছর আগে চলে যায়, কখনো বর্তমানে আসে আবার দুই বছর পেছনে গিয়ে, অনেকটাই ম্যাজিক রিয়ালিজমের আদলে নির্মিত হতে দেখা যায়। গল্পের প্রতি মোড়ে বিভিন্ন টুইস্ট খেলে খেলে দর্শককে বিস্মিত এবং ধরে রাখার কৌশলও দারুণ মুন্সিয়ানার সঙ্গে করতে দেখা যায়। আবার কাশ্মীর নিয়ে কিছুটা রাজনীতি দেখাতেও পরিচালক সিদ্ধার্থ আনন্দ ভুলে যান না।

মনপুরা সিরনমার দৃশ্য।

এখন প্রশ্ন হলো ছবিটা কেন এত সফলতা লাভ করল? প্রথম কারণ, ছবির নায়িকা দীপিকার একটা গান। যেখানে সে গেরুয়া রঙের বিকিনি পরে নায়কের সঙ্গে নাচে। সিনেমা মুক্তির আগেই হিন্দু মৌলবাদীরা দীপিকার পরিহিত গেরুয়া রঙের পোশাক নিয়ে ভীষণ আপত্তি জানায়। কারণ গেরুয়া রঙ তাদের ধর্মীয় রঙ। নেগেটিভ সমালোচনা পজিটিভ দিকে ধাবিত করে। 

ফলে ভারতে ছবি মুক্তির পরে হলে দর্শকের ভিড় বেড়ে যায়। দ্বিতীয় কারণ, শিল্পী বাছাই। বিশেষ করে শাহরুখ খানের ইমেজ। গত চার বছর পর, এই ছবির চরিত্র শাহরুখ খানের ইমেজকে একেবারে আকাশচুম্বী করে দিয়েছে। তৃতীয় ও শেষ কারণ, দেশপ্রেম। বলিউডের ছবিতে যত বেশি দেশপ্রেম থাকে দর্শকের আকর্ষণের প্যারামিটার ততই বাড়ে। এসব ভারতের ভেতরের কারণ। 

কিন্তু আমাদের দেশে এই ছবি প্রদর্শনের আগ্রহ বা অনীহা কেন? এর উত্তর আমরা পাব ভারতীয় সিনেমা আমদানি ও প্রদর্শনের তৃতীয় পয়েন্টে অর্থাৎ দর্শকের দিক থেকে। দর্শকদের মধ্যে আবার দুই প্রজন্মের দর্শকদের ব্যবধান দেখতে পাব। সামাজিক যোগাযোগের (বিশেষ করে ইউটিউব) মাধ্যমে ‘পাঠান’ ছবি নিয়ে যেসব মতামত আমরা দেখতে পাই, সেখানে দেখা গেছে, বর্তমান নতুন প্রজন্ম ছবিটা দেখার বিষয়ে প্রচুর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। 

যেহেতু আমাদের বাংলা সিনেমার প্রতি তারা আস্থা ও আগ্রহ দিন দিন হারিয়ে ফেলছে, সেহেতু তারা ‘পাঠান’ ভারতীয় ছবি হওয়া সত্ত্বেও দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে যারা বয়সে কিছুটা প্রবীণ, তারা এই ছবি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে। তার মূল কারণ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। যেহেতু হিন্দি ভাষায় নির্মিত ছবি, কাজেই ভাষার আধিপত্যের একটা ভয় তাদের ভেতরে কাজ করেছে। ইংরেজি ছবি আমদানির ক্ষেত্রে তাদের আপত্তি না থাকলেও হিন্দি ছবি আমদানির প্রবল বিরোধী তারা। 

এখন প্রশ্ন হলো, ভারতীয় ছবি আমদানি করা উচিত নাকি অনুচিত? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা আমাদের বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ, প্রদর্শন ও বিতরণের বর্তমান প্রধান বাধা ও সংকটগুলো একটু তলিয়ে আলোচনা করলে উত্তরটা হয়তো পেয়ে যাব।

প্রথমত, ভাষা ও সংস্কৃতিগত সংকট 

ভারতীয় ছবি, বিশেষ করে হিন্দি ছবি আমদানির ক্ষেত্রে ভাষাকে প্রধান বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভাষা যেহেতু সংস্কৃতির অন্যতম একটা বাহন, কাজেই হিন্দি ছবি আগমনের সঙ্গে তাদের সংস্কৃতি আগমনের একটা আশঙ্কা থেকে যায়। কিন্তু শিল্পের ভাষা আন্তর্জাতিক। শিল্পের কোনো কাঁটাতার নেই। যে কারণে ইকবালের কবিতা যেমন আমরা মন দিয়ে পড়ি, একইভাবে আল মাহমুদের কবিতাও আমরা মন দিয়ে পড়ি। ভ্যান গগের চিত্রকর্ম আমাদের যেমন ভালো লাগে, তেমনি ভালো লাগে এসএম সুলতান বা জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম। তাছাড়া কোনো ভাষা শুনলেই তার সংস্কৃতি সহজে প্রভাব ফেলে না। আমরা যখন সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে বসি, সেই সিনেমার ভাষা এই কারণে শুনি না যে সেটা শিখতে বা জানতে হবে, গল্পের কারণেই শুধু সেটা শোনা হয়। তবে এই ক্ষেত্রে আবদুন নূর তুষার কথিত বাংলা সাবটাইটেল দিয়ে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা গেলে, নিজেদের ভাষা হারানোর কোনো ভয় আর থাকে না।

দ্বিতীয়ত, ছবির আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর সংকট

ফোর ডি এক্স, থ্রি ডি, ফাইভ ডি ইত্যাদির কারণে ছবির আঙ্গিকের এক বিশাল পরিবর্তন হয়ে গেছে। যে পরিবর্তনের সঙ্গে আমরা এখনো খাপ খাইয়ে নিতে পারিনি। বর্তমান সময়ে সাধারণ দর্শক, বিশেষ করে বাণিজ্যিক ছবির দর্শক হলে গিয়ে, সিনেমার ভেতরে চমকের পর চমক দেখতে চায়। যে ছবিতে যত বেশি চমক থাকে সেই ছবি তাদের কাছে তত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষ গল্প শুনতে ও পড়তে সব থেকে বেশি পছন্দ করে। ফলে দর্শকদের মধ্যে বিষয়বস্তু বা গল্প ছবির অন্যতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। যে ছবির গল্পের বুনন যত নিপুণভাবে বোনা হয়, সেই ছবির চাহিদা দর্শকের কাছে ততই বেড়ে চলে। কিন্তু আমাদের বাংলা সিনেমার গল্পগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ষাট ও সত্তরের দশকে ছবির আঙ্গিক সাদামাটা হলেও গল্পের বুননের কারণে আমাদের হলগুলোতে দর্শকের ভিড়ে টিকিট পাওয়া যেত না। খুব সাধারণ সিনেমাও শুধু গল্পের কারণে অসাধারণ হয়ে যেত। যে কারণে ‘রূপবান’ সিনেমা হলে পঞ্চাশ সপ্তাহ ধরে প্রদর্শিত হয়েছিল। ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ এই দেশের সর্বোচ্চ ব্যবসা সফল ছবি হওয়া ছাড়াও বাংলাদেশ ছাড়িয়ে কলকাতায় রিমেক হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ের ‘মনপুরা’, ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’ আমাদের সফল সিনেমার অন্যতম কিছু উদারহণ।

তৃতীয়ত, সিনেমার উৎপাদন ব্যয়জনিত সংকট

 আমরা সবাই জানি, সিনেমা একটি ব্যয়বহুল শিল্প মাধ্যম। অন্যান্য শিল্প মাধ্যম থেকে এই মাধ্যমে ব্যয় সব থেকে বেশি। কাজেই একটা সিনেমা নির্মাণের পর তার ব্যয় তুলে আনা না গেলে পরবর্তী সিনেমা নির্মাণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। যাদের হাতে টাকা থাকে অর্থাৎ প্রযোজক সংস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো শপিংমল বা ব্যাংক খোলার দিকে যতটা আগ্রহ দেখায় কোনো সিনেমা নির্মাণের ব্যয়ের জন্য ততটা আগ্রহ দেখায় না। তবে ভালো গল্প, পরিচালক, পাণ্ডুলিপি, শিল্পী ও কলাকুশলী ইত্যাদি ঠিকঠাকমতো পেলে অবশ্যই তারা এই খাতে ব্যয় করতে আগ্রহী হবেন। আবার শুধু উৎপাদন ব্যয়ের সংকট এখানে একমাত্র সংকট নয়। মেধার গুণে কম খরচে অনেক ভালো ছবি নির্মাণ করা যায়। যে কারণে ইরানি, কোরিয়ান ছবি সারা বিশ্বে বাজার দখল করে নিতে পেরেছে। সরকারি অনুদানে যেসব ছবি নির্মাণ করা হয়, তার অধিকাংশই রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত পরিচালকদের দ্বারা নির্মিত হয়ে থাকে। ফলে প্রকৃত প্রতিভাবানেরা আড়ালে চলে যায় এবং অদক্ষ, অপরিপক্ব পরিচালকের হাত দিয়ে নিম্নমানের ছবি মুক্তি পায়।

চতুর্থত, দক্ষ পরিচালক, চিত্রগ্রাহক ও সম্পাদকের সংকট

আমাদের এখানে এখনো সেভাবে ভালো ফিল্ম ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠেনি। ফিল্ম ইনস্টিটিউটের জন্য খুব ভালো শিক্ষক দরকার। যে শিক্ষকদের সিনেমা নির্মাণের উপর শুধু স্পেশালাইজড হলেই হয় না, একই সঙ্গে আধুনিক সিনেমা (বিশ্বের চলমান সিনেমা) সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান রাখতে হয়। একজন ভালো শিক্ষক ভালো পরিচালক, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং অন্যান্য কলাকুশলী গড়ে তুলতে পারেন। আমাদের এখানে ভালো চিত্রনাট্যের পাশাপাশি নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহকের অভাব প্রবল। বিশেষ করে চিত্রনির্মাতা। হাতে গোনা কয়েকজন ভালো নির্মাতা দিয়ে সিনেমার মতো এত বিশাল ইন্ডাস্ট্রিকে টিকিয়ে রাখা খুব কঠিন। শিল্পী ও কলাকুশলীর অভাব থাকলেও একজন দক্ষ নির্মাতা জানেন, কী করে অভিনয় ও সিনেমা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ আদায় করে নিতে হয়।

পাঠান সিনেমার দৃশ্য।

পঞ্চমত ও সর্বশেষ, দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট 

শিল্প ও জীবন পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলে। শিল্প যেমন জীবনকে প্রভাব ও প্রতিফলিত করে, জীবনও শিল্পকে তেমনি প্রভাব ও প্রতিফলিত করে। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিরতা তাই চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট শিল্পের সংকট ডেকে আনে। বিগত দুই দশক ধরে আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা সিনেমা শিল্পের উপর প্রভাব ফেলতে তাই বাধ্য হয়েছে। অস্থির সময়ে পরগাছার মতো মন্দ শিল্প গড়ে ওঠে। আমাদের সিনেমা শিল্প পতনের এটাও অন্যতম একটা কারণ। এই দুই সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারলে, আমাদের সিনেমা শিল্পের সংকট কাটিয়ে ওঠাও অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই শুধু ভালো নির্মাতা বা কুশলী নয়, পাশাপাশি এই সংকটের দিকেও আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে। 

আমরা যদি আমাদের সংকটগুলো ভালো করে শনাক্ত করতে পারি, তাহলে তার আশু সমাধানও করতে পারব। যে সংকটগুলোর কথা বলা হলো, সেসব সংকট সদিচ্ছা ও চেষ্টা দ্বারা দূর করা সম্ভব। নিজেদের মাতৃভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রক্ষা করেও অন্য ভাষা, 

সংস্কৃতির দিকে লক্ষ রাখতে পারি। যেহেতু মানুষ সিনেমায় গল্প দেখতে পছন্দ করে, কাজেই ভালো গল্পের উপর জোর দেওয়া খুব জরুরি। সিনেমা নির্মাতা ও অন্যান্য কলাকুশলীকে দক্ষভাবে গড়ে তুলতে পারলে, অবশ্যই ভালো সিনেমা নির্মাণ সম্ভব। মেধা ও দক্ষতার মাধ্যমে স্বল্প উৎপাদন ব্যয়ে আমরা ছবি নির্মাণ করতে পারি। সিনেমা হলগুলোর সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনাসহ আধুনিকায়নও খুব জরুরি। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, এসবের পাশাপাশি রাজনৈতিক নিরপেক্ষ সরকারি প্রণোদনা অবশ্যই দরকার। তবে যতদিন না আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব ততদিন পর্যন্ত সিনেমার বর্তমান সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। সেজন্য রাজনীতিবিদসহ দেশের সাধারণ মানুষের সহযোগিতা খুব দরকার। অসহিষ্ণু সমাজ অসহিষ্ণু শিল্প গড়ে তোলে। 

উল্লেখিত সংকটগুলো কাটিয়ে উঠে আমরা যখন ব্যবসা সফল সিনেমা নির্মাণে সমর্থ হবো, তখন ভারতীয়, ইরানি, হিন্দি, উর্দু, ফারসি যে দেশের বা ভাষার ছবি আমদানি করা হোক না কেন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হবে না। আর বাংলা সিনেমার মৃত্যুঘণ্টাও বেজে উঠবে না। আশির দশকে মৃতপ্রায় তাইওয়ানীয় সিনেমা এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা সফল সিনেমা নির্মাণ করছে। কিছুদিন আগেও বলিউডের সিনেমা মৃতপ্রায় হয়ে উঠেছিল, ‘পাঠান’ এসে তাকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। এভাবেই সিনেমা শিল্প টিকে থাকে এবং থাকবে। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh