অনুর অসুখ

কাজী মেহজাবিন

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৩, ০৩:৩০ পিএম | আপডেট: ০২ মে ২০২৩, ০৩:৩৯ পিএম

অনুগল্প। প্রতীকী ছবি

অনুগল্প। প্রতীকী ছবি

অনুরতার সঙ্গে সায়হ্নর শেষ পর্যন্ত আর দেখা হয়নি। তার অবশ্য অনেক কিছুই হয়নি। এই যেমন তার মা শাহানা বেগমের অসুখ ভালো হয়নি। বাবার অসময়ে হুট করে যাওয়া চাকরি আর ফিরে আসেনি। যেই ছোট বোনটার বিয়ে ঠিক করে দেওয়ার জন্য তার এত একলা থাকার যুদ্ধ, তার বিয়েটাও ভালো হয়নি। আরও কত কিছু আছে যেসব হয়নি! তবু এত সবের ভেতর শুধু সায়হ্নর সঙ্গে দেখা না হওয়ার এক শরীর অভিমানই তাকে ঘিরে থাকে। সমস্ত দিন, সমস্ত রাত। 

অনুরতা সারাদিনের বৃষ্টির পর আসা বিষণ্ন বিকালের মতো শান্ত। তার মেঘচুল পিঠ ছাপিয়ে যায়। সায়হ্নর সঙ্গে শুধু তার স্বপ্নে দেখা হয়। প্রথম দেখা হয় বছর সাতেক আগে। সেই থেকেই তার এই অসুখ। সায়হ্নকে খুঁজে বের করার অসুখ।

বাস্তবে অনু কখনো সায়হ্নকে দেখেনি। তবু সে প্রতি বৃহস্পতিবার অফিসের পর সায়হ্নর জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করে। কালচে সবুজ শাড়ি পরে, খয়েরি রঙের বড় একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কোনার দিকের এক বেঞ্চিতে বসে থাকে। ট্রেনদের আসা-যাওয়া দেখে। কত কত মানুষ নামে, ওঠে, কেউ কেউ আবার দাঁড়িয়ে থাকে অযথা। কত কী দেখা যায়। শুধু সায়হ্নকে দেখা যায় না। কখনো কোনোদিনও দেখা যায়নি। শুধু দেখা যাওয়ার কথা ছিল বোধহয়। ছিল কি? 

অনুরতা সায়হ্নকে চোখ বন্ধ না করেই স্পষ্ট দেখতে পায়। সে স্পষ্ট দেখে শ্রাবণ মাসের ঝুম বৃষ্টির এক সন্ধ্যায় সায়হ্ন ভিজেপুড়ে তার বাড়িতে এসেছে। দেখে তুমুল বিধ্বস্ত মনে হলেও তার মুখে হাসি। অনুরতা গেট থেকে সরে দাঁড়ায়। সায়হ্ন ড্রইংরুমে এসে বসে। 

-এক কাপ চা দিতে পারবে অনু? বড় হয়রান লাগছে। 

অনু চা আর একটা তোয়ালে এগিয়ে দেয়। তোয়ালেটা পাশে সরিয়ে রেখে সে আগুন গরম চা কয়েক চুমুকে খেয়ে ফেলে। ছেলেটা কি পাগল! 

অনু জানে ঠিক এখনই সে অনুর কাছে দেশলাই চাইবে। তার পকেটে যে সিগারেট ভিজে নেতিয়ে গেছে সেই হুঁশ তার নেই। 

সায়হ্ন ঠিক তা-ই করে। অনুর থেকে দেশলাই নিয়ে কিছুক্ষণ সিগারেট ধরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। তারপর ক্লান্ত গলায় বলে

-অনু, যাই?

অনুরতার কাছে এক প্যাকেট সিগারেট সবসময় থাকে। কিন্তু সেকথা সে জানায় না। ঘাড় নেড়ে বলে

-যাও। 

বৃষ্টি কমে আসলেও পড়ছে এখনো। সায়হ্ন তার ভেতরেই বের হয়ে যায়। একবারও পেছনে তাকায় না। ভাগ্যিস তাকায় না! 

এসব দৃশ্য কোনোদিন হয়নি। তবু অনুরতা পুরোটা ঠিক ঠিক দেখতে পায়। সায়হ্নর হাসিটাকে দেখতে পায়। কোনোদিন আসেনি আর আসবে না জানার পরও অনুরতা তাই অপেক্ষা করে সায়হ্নর জন্য। 

সায়হ্নকে খুঁজতে গিয়ে অনু বারবার ভুল ট্রেনের কামরায় উঠে পড়ে। বারবার। সেই ট্রেন টেনে তাকে অনেকটা দূর নিয়ে যায়। তারপর অচেনা একটা স্টেশনে ছেড়ে দেয়। অনু একা একা সেই স্টেশন থেকে ফিরতি ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে আসে। আবার সেই পুরনো বেঞ্চিতে বসে অপেক্ষা করে। মেয়েটার ধৈর্য অনেক!  

অনু শুধু স্টেশনেই ওকে খুঁজে বেড়ায় তা কিন্তু না। সায়হ্ন তো এই শহরের ছেলে। মাঝে মাঝে সে শহরের বাইরে এদিক ওদিক চলে গেলেও সে তো আগাগোড়া এই শহরেরই ছেলে! তাই অনু তাকে পথে পথেও খোঁজে। শুনতে যত অদ্ভুত শোনাক না কেন! অনু খোঁজে। ত্রিশের কোঠার শরীর নিয়ে ১৮ বছর বয়সী চোখ বাঁধা নির্বোধ কিশোরীর মতো অনু সায়হ্নকে খোঁজে।

সে জানে! সায়হ্ন এখানেই থাকে। এই শহরেই। ওর বাড়ির সামনে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। তার নিচটা বাঁধানো। সায়হ্ন কি প্রতি রাত্রে সেই বেদিতে বসে থাকে? ওদের বাড়ির গেটের সামনে অনু যদি গিয়ে দাঁড়ায় তবে নিশ্চয়ই সায়হ্ন ওকে বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে দেখতে পাবে। সে নিশ্চয়ই ছুটে আসবে! আসবে না?

অনু সব জানে। অনু জানে সায়হ্নদের বাড়িটা কেমন। ও কখন বাড়ি ফেরে, কখন আবার হারিয়ে যায় সব অনু জানে। শুধু জানে না ওর বাড়িটা কোথায়। জানে না ও ঠিক কোথায় থাকে। জানে না কেন শেষ পর্যন্ত ও দেখা দিল না অনুর কাছে। তবুও অনুরতা সায়হ্নকে খোঁজে। কখনো বড় রাস্তায়, কখনো অলিগলি পার হয়ে তস্যি গলিতে। খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে সে আবারও তার পুরনো স্টেশনে ফিরে আসে। কোনার দিকের সেই ভাঙাচোরা বেঞ্চটাতে বসে থাকে। প্রতি বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যায়। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh