এমপির নির্দেশে ফের স্কুলের নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত, ক্ষুব্ধ চাকরিপ্রত্যাশীরা

বরিশাল প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৩, ০৬:১৬ পিএম | আপডেট: ০২ মে ২০২৩, ০৬:১৭ পিএম

পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সোমবার (১ মে) দুপুরে বরিশাল জিলা স্কুল কেন্দ্রে পুনরায় নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হাজির হন চাকরি প্রত্যাশীরা। ছবি: বরিশাল

পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সোমবার (১ মে) দুপুরে বরিশাল জিলা স্কুল কেন্দ্রে পুনরায় নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হাজির হন চাকরি প্রত্যাশীরা। ছবি: বরিশাল

বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য মো. শাহে আলম তালুকদারের নির্দেশে দুটি স্কুলের নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ চাকরি প্রত্যাশীরা বরিশাল জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ নুরুল ইসলামকে তার কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখেন।

গতকাল সোমবার (১ মে) দুপুরে বরিশাল জিলা স্কুলে এই ঘটনা ঘটে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উজিরপুরের রামেরকাঠী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঁচটি এবং বামরাইল ইউনিয়নের আটিপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একটিসহ মোট ছয়টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। বিজ্ঞপ্তিতে সহকারী শিক্ষক, অফিস সহকারী এবং অফিস সহায়ক নিয়োগের বিষয় উল্লেখ করা হয়।

পরবর্তীতে গত ১৮ মার্চ বরিশাল জিলা স্কুল কেন্দ্রে নিয়োগ পরীক্ষা শুরু করা হয়; কিন্তু পরীক্ষা গ্রহণের দিন বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য শাহে আলম তালুকদার তার পছন্দের প্রার্থীকে চাকরি দিতে হাজির হন নিয়োগ বোর্ডে। তিনি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনৈতিক হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সুখেন্দু শেখরের সাথে বাকবিতণ্ডা জড়ান। একপর্যায়ে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করে পরবর্তী ১ মে পুনরায় নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।

এদিকে, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সোমবার (১ মে) দুপুরে বরিশাল জিলা স্কুল কেন্দ্রে পুনরায় নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হাজির হন চাকরি প্রত্যাশীরা। তবে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ তোলেন এমপি শাহে আলম। এ কারণে জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষককে পরীক্ষা স্থগিত করার নির্দেশ দেন সংসদ সদস্য।প্রধান শিক্ষক পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দিলে ক্ষুব্ধ হন পরীক্ষার্থীরা। তারা প্রধান শিক্ষককে জিলা স্কুলে তার কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখেন দীর্ঘ সময়।

নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে আসা চাকরি প্রত্যাশী বিনয় হালাদার বলেন, ‘অফিস সহকারী পদে পরীক্ষা দিতে এসে সকাল ৯টা থেকে স্কুলে বসে আছি। দুপুরে শুনি এমপি শাহে আলম পরীক্ষা স্থগিত করেছেন। এর আগেও তিনি একইভাবে পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

একইভাবে চাকরি প্রত্যাশী খালেদ সরদার, সুকান্ত চন্দ্র দাসসহ একাধিক পরীক্ষার্থী বলেন, এমপি শাহে আলমের নির্দেশের কথা বলে পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেন জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এতে পরীক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে তাকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখে। প্রায় দুই ঘণ্টা পর প্রধান শিক্ষক পুনরায় নিয়োগ পরীক্ষার জন্য সময় ধার্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুক্ত হন তিনি।

রামেরখাঠী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সুখেন্দু শেখর বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের পাঁচটি পদে নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিলো। ১ মে জিলা স্কুলে নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিলো। আমি পরীক্ষা কেন্দ্রে এসে শুনতে পাই এমপির নির্দেশে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এর আগে গত ১৮ মার্চ একইভাবে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করেন এমপি শাহে আলম। ওইদিন পরীক্ষা শুরু হলে হঠাৎ করেই কেন্দ্রে হাজির হন এমপি। সেখানে তিনি অনৈতিক হস্তক্ষেপ করে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে এমপির সাথে আমার বাকবিতন্ডার একপর্যায় বাধ্য হয়েই নিয়োগ স্থগিত করতে হয়।

বামরাইল ইউনিয়নের আটিপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. লুৎফর রহমান বলেন, কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে এমপি সাহেব আমাদের স্কুলের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন। তার অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে উজিরপুর ও বানারীপাড়া উপজেলার আরও কয়েকটি বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষাও বন্ধ রয়েছে বলে জানান ম্যানেজিং কমিটির এই সভাপতি।

দুই উপজেলার একাধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটির নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেছেন, ‘এমপি শাহে আলমের পছন্দের প্রার্থীর চাকরি না হলেই নিয়োগ স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন বা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যারা ম্যানেজিং কমিটিতে আছেন তাদের কথারও গুরুত্ব দিচ্ছেন না সংসদ সদস্য। তবে সংসদ সদস্যের প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

উজিরপুর উপজেলার হারতা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সুনিল বিশ্বাস বলেন, আমার বিদ্যালয়ে কিছুদিন আগে চারটি পদে নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। নিয়োগ পরীক্ষায় এমপি শাহে আলম নিজে উপস্থিত ছিলেন। সেই পরীক্ষায় তার পছন্দের প্রার্থী প্রথম হয়ে চাকরি পেয়েছেন। নিয়ম বহির্ভূতভাবে দীর্ঘদিন ধরেই সংসদ সদস্য স্কুলের নিয়োগ পরীক্ষায় উপস্থিত হয়ে হস্তক্ষেপ করছেন বলে অভিযোগ সুনিল বিশ্বাসের।

একই অভিযোগ করেছেন উজিরপুর উপজেলার সকরাল আব্দুল মজিদ বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বরাকোটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মৃধা।

তিনি বলেন, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই নিয়োগ কার্যক্রমে সরাসরি হস্তক্ষেপ করছেন এমপি শাহে আলম। তিনি অযাচিতভাবে নিয়োগ বোর্ডে হাজির হয়ে প্রশ্ন করেন। তার কারণে উজিরপুর ও বানারীপাড়া উপজেলার অসংখ্য বিদ্যালয়ের নিয়োগ বন্ধ হয়ে আছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীরা।

জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, রবিবার এমপি শাহে আলম মহোদয় আমাকে ফোন করে নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ না করার জন্য বলেন। পরীক্ষার দিন অর্থাৎ সোমবারও তিনি আমাকে ফোন করে নিয়োগ কার্যক্রমে বিভিন্ন অনিয়মের কথা বলে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করতে বলেন। এ কারণে এমপি সাহেবের সম্মানে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এতে নিয়োগ পরীক্ষার্থীরা একটি ক্ষুব্ধ হলেও পরে বিষয়টি সমাধান হয়েছে।

উজিরপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জাহিদ হাসান বলেন, বরিশাল জিলা স্কুলে সোমবার সকাল ১০টায় রামেরকাঠী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বামরাইল ইউনিয়নের আটিপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষা দিতে প্রার্থীরা কেন্দ্রে এসেছিলেন। তবে স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ফোন করে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন এমপি শাহে আলম। প্রধান শিক্ষক এমনটিই আমাদের জানিয়েছেন। তবে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য না হয়েও নিয়োগ কার্যক্রমে এমপির হস্তক্ষেপের বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

এদিকে, নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিতের অভিযোগ অকপটেই স্বীকার করেছেন বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য শাহে আলম তালুকদার। তবে তিনি বলেন, স্কুল দুটিতে নিয়োগ কার্যক্রমে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় এলাকাবাসী মানববন্ধনও করেছে। স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষককে নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ রাখার জন্য আমি অনুরোধ জানিয়েছি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh