বঙ্গোপসাগরে কেন ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়

প্রতীক সিফাত

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৩, ০৯:০৯ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

সিডর, আইলা, মহাসেন, কোমেন, রোয়ানু, ফণী, আম্ফান, বুলবুল, মোরা, সিত্রাং-বড় বড় সব ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের একাধিক উপকূল। কয়েক দশক ধরেই ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির তীব্রতা বেড়েছে। ফলে প্রতিবছরই সামাল দিতে হচ্ছে একের পর এক ঝঞ্ঝা। ভারত মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড় অবশ্য বিরল কোনো ঘটনা নয়।

তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রবল ও ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় আঘাত করতে পারে। ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড নামের একটি ওয়েবসাইটে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ৩৫টি মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা রয়েছে। এর মধ্যে ২৬টিরই জন্ম বঙ্গোপসাগরে। 

ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের পরিস্থিতি তৈরির পেছনে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন। প্রভাব পড়ছে উষ্ণায়নে। বিশ্বে যত পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি হয়, তার ৯০ শতাংশ যায় সমুদ্রগর্ভে। এর ফলে বৃদ্ধি পায় সমুদ্রের তাপমাত্রা। ২০২২ সালে সমুদ্রের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল বলে জানিয়েছে ডব্লিউএমওর ‘স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ক্লাইমেট’-এর প্রতিবেদন।

ভারতের ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন বলছে, ১৯৫০ সালের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ৯৪ থেকে ১৪০ হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের হার ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে। বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় হঠাৎ কেন এত শক্তিশালী হচ্ছে, কেনই বা এ দুই সাগরের সৃষ্ট ঝড়ের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাচ্ছে? এ নিয়ে অনেক দিন ধরেই গবেষণা করে যাচ্ছেন সমুদ্রবিজ্ঞানীরা।

তাদের মতে, এর নেপথ্যে রয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। আর তার জেরে ভারত মহাসাগরের চরিত্র বদলাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে এ দুই সাগরের ওপর।

‘চেঞ্জিং স্টেটাস অব ট্রপিক্যাল সাইক্লোনস ওভার দ্য নর্থ ইন্ডিয়ান ওশান’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, আরব সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের প্রাবল্য এবং সেগুলোর আয়ুষ্কাল ১৯৮২-২০১৯ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০১-০৯ সালের মধ্যে আরব সাগরে ঘূর্ণিঝড় বেড়েছে ৫২ শতাংশ। ইসরোর এক বিজ্ঞানী এমএম আলি আবার বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পদ্ধতিতে কোনো বদল আসেনি। আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের উপরিতলের উষ্ণতা বাড়ছে। এর সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রের তাপ ধরে রাখার মাত্রা। ফলে সাম্প্রতিক অতীতে ঘূর্ণিঝড় দ্রুতগতিতে শক্তি বৃদ্ধি করছে।’ 

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটেওরোলজির (আইআইটিএম) আবহ বিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথু কোল বলেন, ‘বর্তমানে যে সব ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে, সেগুলো অনেক দিন ধরে শক্তি সঞ্চয় করে রাখছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে আম্ফানের কথা। স্থলভাগে বিপুল শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়েছিল সেটি। যার ফলে ধ্বংসলীলাও অনেক বেশি হয়।

সমুদ্রের উপরিতল যত গরম হবে এবং তার সঙ্গে যদি হাওয়া অনুকূল হয়, ঘূর্ণিঝড় তত বেশি শক্তি সঞ্চয় করতে পারে এবং সেই শক্তি অনেক দিন ধরে রাখতে পারে।’ ঘূর্ণিঝড় মোখার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় এটি। সেই বিপুল শক্তিতে ঘণ্টায় ১৭৫ কিলোমিটার বেগে স্থলভাগে আছড়ে পড়ে। 

বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে রেখেছে যে তটরেখা, সেখানে বাস করে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ। বিশ্বের ইতিহাসে যতসব ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় উপক‚লে আঘাত করেছে, তার বেশিরভাগেরই সৃষ্টি বঙ্গোপসাগরে। আবহাওয়াবিদদের মতে, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে অবতল আকৃতির অগভীর উপসাগরে। মৌসুমি ঘূর্ণিঝড়ের তীব্র বাতাস যখন এ রকম জায়গায় সাগরের পানিকে ঠেলতে থাকে, তখন ফানেল বা চোঙার মধ্যে তরল যে আচরণ করে, এখানেও তা-ই ঘটে। সাগরের ফুঁসে ওঠা পানি চোঙা বরাবর ছুটতে থাকে। 

ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ডের আবহাওয়াবিদ বব হেনসন বলেন, ‘এ রকম ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের টেক্সটবুক উদাহরণ হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। তবে এ উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও বাড়তি কিছু বৈশিষ্ট্য। যেমন সমুদ্রের উপরিতলের তাপমাত্রা। আর বঙ্গোপসাগর খুবই উষ্ণ এক সাগর।’ 

তিনি জানান, পৃথিবীর নানা অঞ্চলে আরও অনেক উপসাগর আছে যেখানে উপকূল বরাবর এ ধরনের জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি রয়েছে। যেমন লুইজিয়ানার গালফ কোস্ট। কিন্তু বিশ্বের যে কোনো উপকূলের চেয়ে বঙ্গোপসাগরের উত্তর উপকূল জলোচ্ছ্বাসের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে। আর এই উপক‚লজুড়ে যে ঘনবসতি, সেটা ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বের প্রতি চারজন মানুষের একজন থাকে বঙ্গোপসাগর উপকূলের দেশগুলোতে।

বিগত ১০০ বছরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশ্বজুড়ে উষ্ণতার এ ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধিকেই বিজ্ঞানীরা বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নামে অভিহিত করেছেন। আর এই বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আগামী ১৫ বছরের মধ্যেই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে প্রায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এমন ভয়াবহ আশঙ্কার কথা শুনিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক গবেষণা সংস্থা জাতিসংঘের বিশেষ প্যানেল আইপিসিসিও। আইআইটিএমের সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৮২ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে পশ্চিম ভারত মহাসাগর অঞ্চলে অন্তত ৬৬টি তাপপ্রবাহ তৈরি হয়েছিল। আর ওই সময়ে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয়েছিল ৯৪টি তাপপ্রবাহ। আর ভারত মহাসাগরের উষ্ণতা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় তীব্রতর হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা। 

উষ্ণ পানিতে ঘূর্ণিঝড় শক্তিশালী হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ভারত মহাসাগরের অংশ হিসেবে আরব সাগরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকার কথা। আরব সাগরে ১৮৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৯৩টি ঘূর্ণিঝড় সংগঠিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা স্থায়ীভাবেই ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকে। তাই একই সময়ে বঙ্গোপসাগরে উদ্ভূত ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ছিল ৩৫০টি।

সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছানোর ফলে ২০০১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আরব সাগরে মাত্র ২০ বছরের পরিক্রমায় ২৮টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। একই সঙ্গে প্রবল হতে থাকে এসব ঝড়ের তীব্রতা। ২০১৬ সালে ন্যাচার সাময়িকীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে ঘন ঘন শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এ বিষয়ে কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল বলেন, ‘বিজ্ঞানীরা এখন অনেকটাই নিশ্চিত, বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির কারণে যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে, তার প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে ঘূর্ণিঝড়ের উপর।

বিশেষ করে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়গুলোর উচ্চ গতিবেগ, রেকর্ডভাঙা বৃষ্টিপাত, স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু জলোচ্ছ্বাস, উপকূলের কাছে এসে হঠাৎ মন্থর বা শক্তিশালী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসের গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ‘জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে এর সংখ্যার খুব বেশি পরিবর্তন না হলেও শক্তি বৃদ্ধি পাবে।

এর মূল কারণগুলোর একটি হলো বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। এতে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বাড়ে। তাতে সমুদ্রের পানির বাষ্পায়ন বৃদ্ধি পায়। এর ফলে আবার বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়ছে। পদার্থবিজ্ঞানের একটা বিখ্যাত সূত্র হলো ক্লাউসিয়াস-ক্লাপারন সমীকরণ। যে সমীকরণ ব্যাখ্যা করে, বায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলীয় বাষ্প ধারণক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। আর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে যে তাপমাত্রা বাড়ছে, তার প্রায় ৮০ শতাংশই শোষণ করে নেয় সমুদ্রের পানি।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh